তখনও ভারতীয় সমাজ, লেখাপড়ার সঙ্গে গাড়ি চড়ার অস্বস্তিকর সম্পর্ক গড়ার থেকে, বিদ্যা আর্জণ করে বিনয়ী হতে বেশি অভ্যস্ত। কিন্তু শহুরে ভারতীয়দের নিদান হল, হাজার হাজার বছরের জ্ঞাণ চর্চার পদ্ধতি ছেড়ে নিতে হবে সাগর পারের ভুঁইফোঁড় বিদ্যাচর্চা পদ্ধতি। জোর যার মুলুক তার। ব্রিটিশ শিক্ষা পদ্ধতি বিনীত হতে শেখায় না, অধিকার করতে শেখায়, বিনা প্রতিবাদে অনুগামী হতে বাধ্য করে। মানি আর না মানি, বিগত প্রায় দুশো বছর ধরে শহুরে ভারত ইওরোপিয় জ্ঞাণ চর্চার ধারাকে বহন করে চলে ভারত রাষ্ট্র ক্রমশঃই পিছিয়ে পড়ছে প্রযুক্তির বিকাশে। সে আজকের বিশ্ব-প্রযুক্তিতে ইওরোপ থেকে কম করে চল্লিশ বছর পেছনে পড়ে। ৪০ বছর আগে ইওরোপ চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছিল, আজ ভারত শুধু চাঁদে মানুষহীন রকেট পাঠিয়েই খুশি।
আজ বাংলার হাতে গোণা মানুষ ডোকরা শিল্প দিয়ে বাড়ি সাজালেও, জানেই না বাংলায় ডোকরা কামারেরা জং ছাড়াই লোহার সামগ্রী তৈরি করতে আজও সক্ষম, সেই প্রযুক্তি এখনও বাংলার শিল্পীর দখলে রয়েছে – আজও বাংলার বহুপ্রান্তে দলমাদল বা বাচ্চাওয়ালিরমত বহু কামান ছড়িয়ে ছিটিয়ে খোলা আকাশের নিচে অবহেলায় পড়ে রয়েছে, অথচ এক ফোঁটাও জং পড়েনি। ইওরোপে যখন টিকা দেওয়ার প্রচলন হয় নি তখন বাংলার ব্রাহ্মণেরা সফলভাবেই টিকা দিতে জানতেন – খুব কম ক্ষেত্রে বিফল হত তাঁদের টিকাদান। বাংলার নবদ্বীপ, ভাটপাড়া, হাতিবাগান, বর্ধমান, বাঁকুড়ার বিস্তির্ণ অঞ্চলে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়প্রতীম শিক্ষাদান কেন্দ্র। শহরের মানুষের অবহেলায় সেগুলি কোথাও আজ জীর্ণ - অধিকাংশ স্থানে মুছে গিয়েছে ভারতীয় বিদ্যামানচিত্র থেকে। বাংলার মসলিন, বালুচরী প্রবাদ প্রতীম, কিন্তু বাংলার পটুয়া(মষ্করী) আর ভাষ্করদের হাতে অজন্তা-ইলোরা বা অঙ্কেরভাটেরমত নানান স্থাপত্য রূপ পেয়েছে, দীনেশ সেনমশাই সে তথ্য বলে গেলেও আজও তা খুব একটা সর্বজনবিদিত কী? বিশ্বের বাজারে বাংলার গৌড়ি মদের, চিনির, নুনের, সুপুরির, হাতির, ধাতুর, শিল্পকলার একদা যে সমাদর ছিল তাও কেউ জানি কীনা জানিনা। পাশ্চাত্য মার্কসীয় সাম্যবাদী দর্শনের আদ্যপান্ত অন্ধ অনুগামী অথচ লৌকিক বাংলার বিনম্র পুজারী বিনয় ঘোষ দেখেছেন পাঁচ রংএর সিল্কএর বর্ণনাবিশিষ্ট পুঁথি, রাণীগঞ্জে। বাংলার পোড়ামাটির স্থাপত্যের প্রযুক্তি নিয়ে মুকুল দে মশাইএর কাজ কয়েকজন বিদগ্ধজনের বাইরে ঠাঁই হয়নি। দিল্লির লৌহস্তম্ভ বাঁকুড়ার পেখন্না গ্রামের কর্মীদের তৈরি, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আর রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবিষ্কার করা এ তথ্য কোনো এক অজানা কারণে বাংলাতেও খুব একটা প্রচার পায়নি। বাংলার সুপ্রাচীণ লাঙল যে প্রযুক্তি বিদ্যার এক চরমতম নিদর্শণ কজন জানি। সেচের কাজে আসা ব্রিটিশ প্রযুক্তি ভোলকার সরকারকে জানিয়েছিলেন বাংলার সেচ ব্যবস্থা ভারতীয় প্রযুক্তিরবিদ্যার চরমতম নিদর্শণ।
বাংলার বাইরে বিশেষ করে এক হাতে ধরমপালজী আর তার সঙ্গীসাথীরা অথবা আলমোড়ার লোক বিজ্ঞান কেন্দ্র বা দক্ষিণ ভারতের নানান শিকড়ে যাওয়ার আন্দোলনে ভারতের সনাতন সমাজ, দর্শণ, ঐতিহ্য, প্রযুক্তির নথিকরণ করেছেন দায়বদ্ধভাবে। এই বাংলার অন্তরকে জানাতে চেয়ে যে কাজের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র, অক্ষয় কুমার দত্ত, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দীনেশচন্দ্র সেন অথবা নির্মল চন্দ্র বসুরমত মানুষ, সেই কাজের এক অংশের দায়ভাগ আজকের প্রজন্ম তুলে নিলেও, বাংলার ন্যুনতা নিয়ে ব্রিটিশ মিথ-মিথ্যাকে খণ্ডন করার কাজ খুব একটা আগ্রসর হয়নি। শহুরে বাংলার শিক্ষায়, জ্ঞানে, বুদ্ধির রণ্ধ্রে রণ্ধ্রে যে উপনিবেশবাদ ঢুকে রয়েছে, তাকে বিনাশ আর খণ্ডন করা অত্যন্ত জরুরিকর্ম। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ঔপনিবেশিকতাবাদের নগ্নতম রূপ দেখে, সারা জীবন ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে কাজ করা মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদেরমত মানুষ শেষ বয়সে এই দর্শনের খণ্ডনকার্যটি হাতে নিতে চাইছিলেন(১৯১০ সালের কাছাকাছি এসে তিনি জানান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সুফল না বলতে দিয়ে, যদি কেউ তাকে কুফল বলাতে চান, তাহলে তিনি স্বস্তিবোধ করবেন)। চাইলেও তিনি পারেন নি। পারেননি তাঁ অনুগামীরাও। এটাই চরমতম ঐতিহাসিক সত্য। এই খণ্ডনকর্ম করতে গেলে আজ প্রয়োজন ইওরেপিয় জ্ঞান আর ইতিহাস চর্চার মিথ-মিথ্যাগরীমাকে প্রশ্ন করা, যা আম বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের স্বপ্নেরও অগম্য।
বিগত দুশো বছরের ইওরোপিয় জ্ঞাণ-বিজ্ঞাণ-প্রযুক্তির আধিপত্যবাদ নিয়ে জ্ঞাণচর্চার ইতিহাস যে নির্জলা অসত্য প্রচার করেছে, সেই প্রচার ভারতীয় ইংরেজি শিক্ষিত বর্ণকুলীন বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছে, আজও নিচ্ছে। কেরল অঙ্কবিদ্যার যে ভিত্তিভূমি আজ বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাতে প্রমাণিত যে, কলন বিদ্যার সূত্র ধরেই তৈরি হয়েছে পশ্চিমি গণিতের অন্যতম ভিত – নিউটন বা লিবনিত্জকে কলণবিদ্যার জনক বলার কোনো হেতু নেই। কেরলিয় গণিতই ইওরোপে নিউটনিয় অংক নামে পরিচিত। আজ ভারতীয় কলণ বিদ্যাকে ইওরোপ-পূর্ব কলন বিদ্যার ছাপ মেরে দেওয়া হচ্ছে, কেননা ভারত কখোনোই ইওরোপেরমত লিমিটের ধারণা প্রয়োগকরে কলন বিদ্যার চর্চা করে নি – তার আলাদা প্রকার কলন চর্চার ইতিহাস রয়েছে – যে ইতিহাস আজ এক কলণবিদ্যার ছাত্রেক কাছে অজানা। আজ যে কোনো ভারতীয় বিদ্যালয়ের পাঠ্য অঙ্ক পুস্তকে বলা হয় ত্রিকোণোমিতির উদ্গাতা গ্রীক সভ্যতাশ্রিত মিশরের আলেজান্দ্রিয়া। পাঠ্যবইতে তাঁদের যে ছবি ছাপা হয় সবই ককেসাসিয়ান চেহারার। অথচ আলেকজান্দ্রিয়ায় যে মানুষেরা অঙ্কবিদ্যা চর্চা করছেন তাঁরা সকলেই আদত আফ্রিকার অধিবাসী, তাঁদের চেহারায় আফ্রিকার ছাপ থাকার কথা। কিন্তু ব্রিটিশ তথা পশ্চিমি প্রচারে তাঁরা সকলেই ইওরোপিয় চেহারার অধিকারী, ব্রিটিশদের সেই প্রচার শহুরে শিক্ষিত আমরা নির্বিবাদে গ্রহণ করেছি। এক সাধারণ যাজক কোপার্নিকাস ইওরোপিয়দের প্রচারে হয়ে উঠেছেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী। তিনি শুধুমাত্র ল্যাটিনে অনুবাদ করেছেন ইবন শাতির আর নাসিরুদ্দিন তুসির রচনার গ্রীক সংস্করণ। আর ইওরোপিয়দের প্রচারে প্রভাবিত হয়ে অধিকাংশ বাঙালি বুদ্ধিজীবি আজও তথাকথিত কোপার্নিকাসীয় বিপ্লবের ধারণায় বুঁদ হয়ে থাকেন। আর ভাবেন ইওরোপিয় ইতিহাসের ভুল ধরারমত ভুল আর বিশ্বে কিছুই নেই। সকলেরই ধারনা ইওরোপীয় সব বচনই সত্য আর সব মিথ্যা – সবই ব্যাদে আছে - অসামাজিক ব্যাঙ্গটিতে নিজের সনাতনী সমাজের প্রতি যে দুর্দমনীয় অশ্রদ্ধা প্রকাশ ঘটেছে তা আদতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সভ্যতার দান। আজ ভারতের অধিকাংশ অংকবিদ জানলেও বলেন না ইওরোপিয় পদ্ধতিতে অংক কষার বাইরেও একটা অংক চর্চার অ-ইওরোপিয় ইতিহাস রয়েছে।
No comments:
Post a Comment