বাংলায় এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ গোষ্ঠী টিকা দেওয়ার বিদ্যা জানতেন। তাই সমাজ সেই ব্রাহ্মণদের ভরণ পোষনের দায় নিত – অর্থাত সমাজের কাজে লাগা নানান কাজের বিশেষজ্ঞরা সামাজিকভাবে শুধু বেঁচে থাকার নিরাপত্তা পেতেন তাই নয়, তাঁরা জ্ঞাণ ব্যবহার আর নিজের অধীত জ্ঞাণের চর্চার সুযোগও লাভ করতেন অবাধে, সামাজিক নানান বিধিনিষেধের আওতায় থেকেই। ভারত বহুকাল ধরেই সমুদ্র বাণিজ্য করতে আফ্রিকা পর্যন্ত ধাওয়া করেছে কিন্তু ভারত চেনার নতুন খুঁজতে গিয়ে পথ ভুল করে আমেরিকা আবিষ্কার করে বসেনি, বা সেদেশের অধিবাসীদের সভ্যতা ধংস করে সাদা চামড়ার সভ্যতা গড়ে তোলেনি। ভারতে বা চিনে বারুদের প্রচলন থাকলেও বারুদ মানুষমারার কাজে ব্যবহার হয়নি। বিশ্বখ্যাত দামাস্কাস তরোয়ালের মূল পিণ্ডটি কিন্তু তৈরি করত ভারতের সনাতন আকরিকবিদেরা – যারা সনাতন কাল থেকেই ডোকরা কামার নামে পরিচিত – যাদের তৈরি ধাতুপিণ্ডতে আজও জংএর চিহ্ণমাত্র নেই। ভারতের বস্ত্র বয়ন শিল্পতো প্রবাদ প্রতীম। যে তাঁতে এক ব্রিটিশ তাঁতি কোরা চটও বুনতে অক্ষম, সেই তাঁতেই বাঙালি তাঁতিরা কিন্তু মসলিন, বালুচরি, কোরিয়াল বুনতেন। যন্ত্রের সূক্ষতার ওপর আজও নির্ভর করে না উত্পাদনের গুণমান। প্রয়োজন হয় উত্পাদকের জ্ঞাণ, কাজের প্রতি ভালবাসা আর সামাজিক সুরক্ষার ধারণা। সারা ভারত জুড়ে সামাজিক উদ্যমে গড়ে উঠেছিল এক স্বয়ংসম্পূর্ণ সেচ ব্যবস্থা। যে সময় ব্রিটিশেরা ভারতীয় সমাজে আধুনিকতা আর ব্রিটিশ আধিপত্যের জীবানুটি অনুপ্রবেশ ঘটাতে প্রাণপাত করে চলেছেন, সে সময়েও সময়েও কাটা নাক জোড়া লাগাতে(রাইনোপ্লাস্টি), চোখের চিকিত্সায়, বসন্তের বিরুদ্ধে টিকা দিতে, মাথার ব্যামো সারাতে, ভাঙা হাড় জুড়তে, সাধারণ রোগের নিদানে ভারতীয় সমাজ মাহির ছিল। আর সে সমাজের অংক কষার কথা আমরা অনেকেই জানি। দীনেশ সেন মশাই বলছেন তাঁর এক ভারতীয় আত্মীয় আগের শতকেই জার্মানীর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষেতে বসে যে পদ্ধতিতে দ্রুত মানসাঙ্ক করতে পারতেন তা পশ্চিমিদের কাছে জাদুবিদ্যারমত মনেহত।
ব্রিটিশ শাসনকালে গ্রামীণ ভারত ছাড়া শহুরে সকলেই ধরে নিয়েছিলেন ব্রিটিশ সভ্যতা এসেছে নতুন প্রযুক্তি, দর্শণ, জ্ঞাণ নিয়ে – যার আদত নাম আধুনিকতা – কাব্য করে গলাকাঁপিয়ে বলাহল ...পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার। অথচ পশ্চিমের জ্ঞান, প্রযুক্তির এক বিশাল অংশ ভারত-চিন-আরবসহ নানান প্রচলিত সভ্যতার সমাজ থেকেই আহরণ করা। ভারতীয় লৌকিক-আদিবাসী সমাজের নাচের পদসঞ্চার আর গানের সুর ধারকরা মুম্বাইএর হিন্দি সিনেমার নাচ-গান অনুসরণ করে(আজ গান কিন্তু শুধুই দেখার সামগ্রী), সেই চলচ্ছবিতে ব্যবহৃত নাচাগানায় মুগ্ধ হয়ে আবার লৌকিক সমাজ তাঁদের সমাজেরই একদা নকলের নকল আজ কাল বাজারে ছাড়ছেন। আধুনিকতার ধারণা প্রচার-প্রসারে যে পশ্চিমি আর ভারতীয়দের অপদান সবথেকে বেশি তাঁরা সকলেই ব্রিটিশ সরকারি যন্ত্রের সরাসরি মদতপুষ্ট, সরকারি চক্রান্তের সরাসরি ভাগিদার। আধুনিক আর সনাতন ভারতের পাঁচ প্রবক্তা - জন ও জেমস স্টুয়ার্ট মিল, উইলিয়াম জোনস, মেকলেআর ফ্রেডরিশ ম্যাক্স মুলার ছিলেন হয় কোম্পানির উচ্চবেতনের চাকুরে(মেকলে এক চিঠিতে বলছেন তার ৫ বছরের ভারতে কেম্পানির চাকুরিরকালে তিনি সরকারিভাবে(বেসরকারি রোজগার কত কে আর জানছে) এতই অর্থ রোজগার করবেন, যে তার থেকে অধিকাংশই সঞ্চয় করে দেশে ফিরে গিয়ে স্বচ্ছলভাবে অবসরকালীন জীবনযাপন করতে পারবেন) অথবা কোম্পানির আর্থিক বদান্যতাভুক্ত বুদ্ধিজীবি(মুলার সম্পাদিত খগ্বেদের প্রকাশ হয় ইস্ট ইণ্ডিয়া কেম্পানির অর্থ দাক্ষিণ্যে – যার ফলে তিনি ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে বিভেদ আনতে সংস্কৃতকে ইন্দো-ইওরোপিয় ভাষাগোষ্ঠীর) - অন্যদিকে রামমোহন, দ্বারকানাথ এমনকী বিদ্যাসাগমশাইএরমত পথভেঙেপথতৈরিকরা নানান মানুষজন, সকলেই ছিলেন কোম্পানির চাকুরে, বেনিয়ান বা ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে চলতে থাকা নুন, নীল বা আফিমেরমত নানান লুণ্ঠন ব্যবসার যেমন অংশিদার, আর তেমনিই ইংরেজি শিক্ষা ভারতে প্রসারের অন্যতম সহায়ক আর সুপ্রাচীণ ভারতীয় সভ্যতার গালে তীব্র চড় মারার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সুগভীর প্রকল্পের সরাসরি অংশিদার। যে কোম্পানি ভারত তথা বাংলাকে ছিবড়ে করেছে, সেই কোম্পানির বিনিয়োগের ফলে তিল তিল করে গড়ে তোলা পশ্চমি দর্শনেই গড়ে উঠেছে এক অন্ধপাশ্চাত্য অনুগামী সমাজ যারা ব্রিটিশ ভারত ছাড়ার অর্ধশতক পরেও ব্রিটিশিয় কায়দার পশ্চিমি আধিপত্য আর শিল্পবিপ্লবনির্ভর সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বের ধোঁকার টাটিটি সযত্নে সগৌরবে বহন করে চলেছেন।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সুফল বর্ননা করতে গিয়ে বলাহয়, ব্রিটিশেরা ভারতে রেলসহ নানান শিল্পবিপ্লবে বিনিয়োগ করে ভারতকে আধুনিক বিকাশের যুগে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। John A. Hobsonএর Imperialism: A Studyরমত মগজ ধোলাইকরা দার্শনিক পুস্তকে প্রভাবিত হয়ে এক শ্রেণীর শহুরে ভারতীয় পর্যন্ত বিশ্বাস করতেন, ভারতেরমত উপনিবেশগুলোতে ব্রিটিশ, মুক্ত বাণিজ্যের ধারণা এনেছে(যা আদতে সর্বৈব মিথ্যা), যার সুফল পেয়েছে উপনিবেশিক দেশগুলো। আদতে এটি উপনিবেশের সুফলের একটি তৈরি করা প্রচারমাত্র। একসময়ে ভারতে রেলপথ বিকাশে যে মূলধণ বিনিয়োগ হয়েছে সেই বিনিয়োগের ওপর বাত্সরিক অতিরিক্ত ৫ শতাংশ হারে নিশ্চিত ফেরতের গ্যারান্টি পেয়েছেন ব্রিটিশ বিনিয়োগকারীরা(ঠিক এই ধরণের গ্যারেন্টি চাইছে ভারতে ব্যবসা করতে এসে ফেলকরা বিদেশি কোম্পানিগুলি)। এ দেশে রেল বা সড়ক পরিকাঠামো তৈরি করার জন্য একটাও অনুসারী শিল্প গড়ে ওঠে নি। কাঠ আর শ্রমিক ছাড়া সমস্তকিছু কাঁচামাল আর যন্ত্রপাতি আনাহত ব্রিটেন থেকে। ১৯০০ সাল পর্যন্ত রেলপথ চালানোর জন্য যে ক্ষতি হয়েছে সেই ক্ষতিপূরণ করতে হয়েছে ভারতীয়দের ওপর কর চাপিয়ে। এ ছাড়াও ব্রিটিশ রেলপথ যে অঞ্চল দিয়ে গিয়েছে, সেসব অঞ্চলে কমবেশি ২৫০টিরমত মন্বন্তর ঘটেছে, কোথাও ছোট, কোথাও বড়। ব্রিটেনের মধ্যউচ্চবিত্তকে আরও একটু ভাল রাখার জন্য ভারতীয় সমাজের মানুষ সরাসরি প্রাণ দিয়েছেন। সাম্রাজ্যের জন্য যত সেনাবাহিনী প্রয়োজন হয়েছে, ব্রিটেনে যত আমলা ইণ্ডিয়া হাউসে ভারতের সাম্রাজ্যের কাজে ব্যবহৃত, হতেন তাদের বেতন হত ভারতের জনগণের দেওয়া করে।
No comments:
Post a Comment