অথচ শাসন করতে আসা এই ব্রিটিশরাই জানত, বিধিনিষেধেভরা প্রাণচঞ্চল গ্রামীণ সমাজ ছিল জাগতিক বা বুদ্ধিবিভাষাময় ভারতীয় সভ্যতার ভিত্তিভূমি। সরস্বতী-হরপ্পা সভ্যতার বহুপূর্ব থেকেই যে ভারতীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছে নিরবিচ্ছিন্নভাবে, সে সভ্যতাকে কব্জা করা খুব একটা সহজ কাজ হবে না, এ তথ্য হাড়ে হাড়ে ব্রিটিশরা টের পেয়ে গিয়েছিল। ভারত ঘুরে ঘুরে চিরাচরিত জ্ঞাণভাণ্ডার নকল করতে থাকা (এমনকী বাংলার কোন অঞ্চলের কী ধরনের লাঙল ব্যবহার হয়, সে তুচ্ছ অথচ সাধারণ তথ্যও তাঁরা সংগ্রহ করেছিলেন) ব্রিটিশগুণিরা এ তথ্য বুঝেছিলেন বলেই, ব্রিটিশ সরকারের প্রাথমিক কাজ ছিল ভারতীয় সমাজের তাবত্ মানুষের নৈতিকতা, আত্মবিশ্বাস ভেঙে দেওয়া। তাই প্রয়োজন হয়েছিল ভারতভূমিতে অজ্ঞাতকুলশীল সম্রাজ্যবাদীঅভিঘাতে রান্নাকরা আর্যতত্বকে রোপণ করার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সভ্যতার ন্যুনত্বের ধারণা শহুরে ভারতীয়দের মনের অন্তঃস্থলে রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত রূপায়ণের। আপামর গ্রামীণ ভারতবাসী আকাশ থেকে খসে পড়া সে তত্বে বিশ্বাস না করলেও, শহুরে শেকড় ছেঁড়ারা যে তাতে আস্থা রাখবেন, এ বিশ্বাস ব্রিটিশ শাসকদের ছিল। আজ প্রমাণিত শহুরে ভারতের ওপর ভরসা রেখে ভারত সমাজ ভাঙার কাজে লিপ্ত ব্রিটিশ খুব কিছু ভুল কাজ করেনি।
বিশ্ব বিজেতা হতেগেলে বাজারে প্রতিযোগী থাকলেই বিপদের সম্ভাবনা। অথচ বুদ্ধিজীবি ব্রিটিশেরা দেখেছিলেন ন্যুনতমটুকু সম্পদ আর সাধারণ জ্ঞাণ সম্বল করে কীই না জাগতিক আর পারমার্থিক সম্পদ তৈরিতে দক্ষ সরল ভারতীয় সমাজ। এর পাশাপাশি পশ্চিমি সভ্যতার প্রযুক্তিতে অজস্র ফাটাফুটো। ভারতীয় প্রযুক্তির আশেপাশে আসতে পারতনা সে সময়কার ব্রিটিশ প্রযুক্তি। এ তথ্য বিশ্বকে জানানোর অর্থ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কফিনের শেষ পেরেক ঠোকা। তাই দরকার এক সভ্যতার, যে সভ্যতা দর্শণে-জ্ঞাণে-প্রযুক্তিতে উত্তমর্ণ। সে সভ্যতা ভারত। সে সমাজ থেকে সমস্ত জ্ঞাণ আহরণ করা প্রয়োজন।
ঠিক হল নকলের কোনো সূত্র না রেখেই আহরণ করা হবে ভারতীয় জ্ঞাণ আর ভাঙা হবে সেই জ্ঞাণের ধাত্রীভূমি ভারতীয় সনাতন সমাজ। জ্ঞাণ ভিত্তি করে হাজার হাজার বছরের যে সামাজিক শিল্পকারখানাগুলো গড়ে উঠেছে বাংলা তথা ভারতের নানা প্রান্তে, তাকেও শেকড় থেকে উপড়ে ফেলতে হবে, তবেই হবে বিশ্ব জয়, তবেই পরের দুশে বছর ধরে দর্শনের-বিজ্ঞানের-প্রযুক্তির ইতিহাস বলতে বোঝাবে শুধুই ইওরোপিয় জ্ঞান চর্চার ইতিহাসকে, শুধু ভারত নয়, বিশ্বের অ-ইওরোপিয় জ্ঞাণ চর্চার ইতিহাস শুধুই থাকবে পাদটিকারূপে(সাদামানুষদের বিশ্লষণের জন্য তৈরি হল সমাজবিদ্যা অন্য সবার জন্য নৃতত্ব, আর ইওরেপিয় সঙ্গীতই একমাত্র ধ্রুপদী গান আর স-অ-ব ফোক। শহুরে ভারতকে সন্তুষ্ট রাখতে ভারতীয় রাগ সংগীতমাত্র পেল ধ্রুপদী আখ্যা। তবে উপরি পাওনা ভারতীয় রাগের আঞ্চলিক খণ্ডীকরণ - উত্তরভারতীয় আর কর্ণাটকী রাগে ভেঙে ফেলা হল রাগ সংগীতকে)। বিপরীতে অপচয়মুখী পাশ্চাত্যদর্শণভিত্তিক যে সমাজ গড়তে ব্রিটিশ শহুরে সভ্যতা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, সেই শেকড় ছেঁড়া সমাজ ঢলে পড়ল ব্রিটিশের পায়ে। নতুন এই সভ্যতাকে চালাতে চাই সে দেশের মানুষের অংশগ্রহণ। প্রকল্পটিতে হাত দিতে না দিতে, ব্রিটিশদের পাতে না চাইতেই জল। প্রাথমিকভাবে সঙ্গ পেল শহুরে বাংলার। এই শহুরে মধ্যবিত্তকে ঢাকের বাঁয়া হিসেবে গড়েতোলাই ছিল কোম্পানি সরকার প্রাথমিক প্রচেষ্টা। সে কাজে কোম্পানি বাহাদুর একশো শতাংশ সফল। প্রথমে কলকাতা, পরে বম্বে আর মাদ্রাজের ইংরেজি শিক্ষিত সম্রাজ্যসাথীরা এই কালাপাহাড়ি কাজের সাথী হয়ে উঠেছিলেন ক্রমশঃ।
সে সময় বিশ্বরাজনীতিতে প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য করতে থাকা ব্রিটিশ রাষ্ট্র বুঝেছিল, লুঠের দর্শনে যে ভঙ্গুর সভ্যতা দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাকে বৈধতা দিতে প্রয়োজন শহুরে ভারতীয় সমাজে এক জাতি, এক আইন, এক ভাষাভিত্তিক নতুন জাতি রাষ্ট্রের ধারণার শিকড় গজানোর। অথচ সনাতন কাল থেকেই ভারতীয় সমাজ বহুধা বিভক্ত – কেউ জাতির ধারণায়, কেউ ভাষা ভিত্তিতে আবার বা কেউ কোনো এক ধর্মের নির্দিষ্ট ব্যখ্যার ভিত্তিতে আবার কেউবা অন্য কোনো ভাবনার ভিত্তিতে। এক এক সমাজে এক এক দর্শন। কোথাও মেয়েদের জন্য পর্দা প্রথা কঠোরভাবে প্রচলিত আবার বহু সমাজই সমাজিকভাবে মাতৃতান্ত্রিক, কোনো সমাজের এক ক্ষুদ্র অংশে বিধবাদের পোড়ানোর নিদান দেওয়া হয় আবার কোনো সমাজে বিধবা বিবাহ এক সাধারণ ঘটনা। ভারতীয় সমাজ চিরকাল নানান সমাজ-দার্শনিক-শাস্ত্রীয়-ভাষার বৈচিত্র্যের মধ্যে থেকেই পারস্পরিকতার লেনদেন করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে বোধ করে নি(নানান ভাষায় বিভক্ত ভারতবর্ষে ভ্রমণকরে শ্রীমন্ত শংকরদেব, শংকরাচার্য, শ্রীচৈতন্য, বিবেকানন্দও মহামানব হয়ে উঠেছেন – ভাষার অসুবিধে সত্বেও তাঁরা সাধারণের সঙ্গে আলাপচারিতা করেছেন – ভাবপ্রকাশে ভাষা কোনো সমস্যা হয়ে ওঠেনি)। এমনকী ভারতের চার প্রান্তে গঠিত শঙ্করাচার্যের মঠের ভাষ্যও ভারতীয় সব ব্রাহ্মণ্য সমাজে গ্রহণীয় নয়। সর্বজনপাঠ্য রামায়ণও ভারতের নানান প্রান্তে নানান ভাবে, নানান দৃষ্টিতে পঠিত হয়। সমাজ শাসনে স্থানীয় পঞ্চায়েতের ভূমিকাই ছিল চূড়ান্ত। সাধারণতঃ সে অঞ্চলের পঞ্চায়েতকে এড়িয়ে সেই জনপদের বা শহরের শাসক, উচ্চ কোনো বিচার ব্যবস্থা, সামাজিক নিদান দিতে পারত না। ভারতীয় সমাজ জানত একটি নির্দিষ্টমাত্র দর্শণের নিগড়ে সমস্ত ভারতীয় সমবায়ী সমাজকে বাঁধা যায় না, উচিতও নয়, সভ্যতার বিস্তৃতিই ঘটে অসংখ্য বৈচিত্র্যের বিকাশের মধ্যে।
অথচ বাইবেলভিত্তিক খ্রিষ্টিয় নিদানের ওপর গড়ে ওঠা ব্রিটিশরা সমগ্র ভারতকে একটিমাত্র হিন্দু বিপরীতে শরিয়তি আইনে বাঁধতে চাইল। প্রণীত হল আ কোড অব জেন্টু ল। তাতেও সমাধান হল না। বিচার ব্যবস্থাকে সরাসরি নির্ভর করতে হল পণ্ডিতদের ব্যাখ্যার ওপর। ভাগ্যান্বেষণে ভারতে এসে কোম্পানি সরকারের দয়ায়, ভারতীয়দের শিরদাঁড়া বাঁকানোর প্রকল্পে মহাপণ্ডিত বনে যাওয়া, উইলিয়ম জোনস ভারতীয় পণ্ডিতদের দিয়ে অনুবাদ করিয়ে মনুস্মৃতির অনুবাদক অখ্যা পেয়ে গেলেন। যাইহোক, ভারত সমাজ ভাঙতে নব্যসৃষ্ট ভারতবিদ্যায় হঠাত্ই খ্যাতি অর্জন করল মনুস্মৃতি – অথচ বহু সমাজেই মনুস্মৃতির ব্যবহার নেই। ঔপনিবেশিক ভারত বিশ্লষণেরত পণ্ডিতদের কাজকর্মে হঠাত্ই যেন শীতঘুম ভেঙে সমাজবিধাতার সম্মান পেয়ে গেলেন মনু মশাই। সমাজ ভাঙার কাজের আর এক পদক্ষেপ। ভারতীরা ব্রিটিশের কল্কে পেয়ে মহাখুশি। তাঁরাও মনুস্মৃতিকে সনাতন উচ্চমধ্যবিত্তভারতের সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বেদবাক্যগ্রন্থ বানিয়ে দিতে কসুর করলেন না। ভারতীয় সমাজগুলোয় প্রায় ঠাণ্ডাঘরে চলে যাওয়া এই গ্রন্থটিই পরবর্তীকালে হয়ে উঠবে উপনিবেশ চর্চার ভিত্তিপুস্তক। জোনসএর দেখানো পথে ভারতীয় পণ্ডিতদের কাঁধে চেপে কোলব্রুক স্বীকৃত হবেন মিতাক্ষরা আর দায়ভাগএর অনুবাদকরূপে। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে হিন্দুদের বিচার করার এক আইন তৈরির কাজ শুরু হল - যার কয়েক দশকের মধ্যেই শিক্ষাপ্রস্তাবে যুগান্ত আনা মেকলে তৈরি করবেন ভারতের প্রথম এক কেন্দ্রিক আইনভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা। সনাতন বহু ভারতীয় সমাজের নিজস্ব নীতি-আইন ভেঙে ভারতের সমাজে অনৈতিক আর সচেতনভাবে জাতপাতের বিষ ঢোকানোর যে কাজ ব্রিটিশরা ক্রমান্বয়ে করে চলেছিল তাকে সরাসরি সমর্থন জানালেন, বহন করলেন শহুরে ভারতীয় বুদ্ধিজীবিরা। অথচ নিজস্ব পঞ্চায়েতি ব্যবস্থায় অভ্যস্ত গ্রামীণ সমাজ পলাশির প্রথম দিন থেকেই ব্রিটিশের অনৈতিক শাসন আর বিচার পদ্ধতির বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত। এক রাষ্ট্রের আওতায় গ্রামীণ ভারতীয়দের নতুন পশ্চিমি সভ্যতায় অভ্যস্ত করাতে প্রয়োজন নতুন বিদেশি শিক্ষায় শিক্ষিত এক শ্রেণীর, যারা আগামী দিনে ভারত রাষ্ট্রের সুবৃহত গ্রামীণদের পশ্চিমি দর্শনে দীক্ষিত করাতে পারে। শহুরে ভারত রাষ্ট্র আপন করে নিল বিদেশি বিচার ব্যবস্থাকেও কোনো প্রশ্ন ছাড়াই বিনতমস্তকে।
No comments:
Post a Comment