অথচ ব্রিটিশরা ভারতে শাসন ক্ষমতায় এসে একাদিক্রমে বেছে বেছে তাদের সভ্যতার বিকাশে প্রয়োজনীয় জ্ঞাণ প্রযুক্তি নথিভুক্ত করে, সংগ্রহ করে, ধ্বংস করে নিয়ে গেল নিজের দেশে, কোনো সূত্র না রেখেই। নৌপরিচালন বিদ্যাই হোক, চিকিত্সা বিদ্যাই হোক, ধাতুবিদ্যাই হোক, অংক বিদ্যাই হোক, এলাহাবাদের বরফ তৈরির প্রাকৃতিক প্রযুক্তিই হোক বা মাদ্রাজের শিশু শিক্ষাদানের পদ্ধতিই হোক, সে সব প্রযুক্তি বা গ্রন্থিত ভাবনা, সাধারণ মানুষমারা শিল্পবিপ্লবেমাতোয়ারা ব্রিটিশ সভ্যতার সমাজ-সম্পদ বিকাশের কাজে লেগেছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন ধরমপালজী বছরের পর বছরের পরিশ্রমে। বিশ্ব যাতে সেই জ্ঞানের সূত্র চিনতে না পারে, তাই বুদ্ধিমান ব্রিটিশ জ্ঞাণীদের কাজ ছিল, টুকলি করা জ্ঞানগুলিকে আর সেই জ্ঞাণের আধার সমাজগুলোকে ধংস করা, সেই জ্ঞাণ কোথাথেকে সংগ্রহ করা হয়েছে তার সামাজিক-ভৌগোলিক সূত্র উত্পাটন করে ফেলা। অথচ শুধু যদি ইওরোপিয় অংক বিদ্যার কথাই বলি, তার মূল সূত্রটি কিন্তু ইওরোপে গিয়েছে আরব সভ্যতার হাত ধরেই। আরব কখোনোই তার জ্ঞাণ অর্জনের সূত্রটিকে গোপণ রাখতে চায়নি। ব্রিটিশ সভ্যতার দেখানো জ্ঞাণ চুরির পথে না হেঁটে, সে সারা বিশ্বকে বলেছে যে ভারত থেকেই সে তার প্রথমিক অংকের জ্ঞাণটি অর্জন করছে।
ব্রিটিশ ভারত, সমাজের বৈদেশিক বাণিজ্যের মূল অক্ষদণ্ড শিল্পসমাজকেই তাদের চিরাচরিত জীবিকা থেকে উচ্ছেদ করেছে, যাতে সমাজের মেরুদণ্ডকেই চিরতরে বাঁকিয়ে দেওয়া যায়, যাতে ভারতের সমাজগুলো অবার নতুন করে গড়ে উঠতে না পারে। আর যদি কখোনো ভারত আবার তার ভূমিশয্যা থেকে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে তবে সে বিকাশ হবে ব্রিটিশের দেখানো শিল্পবিকাশের দর্শণের অনুসারী। ভারতের সনাতন নিয়ন্ত্রিত সমাজভিত্তিক বিকাশ নয় – সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে দাঁড়িয়ে, অধিকাংশ মানুষের আত্মবিশ্বাস লুণ্ঠনকারী দর্শন প্রয়োগ করে, মাটিরতলার সম্পদের অনিয়ন্ত্রিত আহরণ, আর অপচয়ভিত্তিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক মুনাফা আরও মুনাফার হাতছানি – যা আদত ভারতীয় প্রজ্ঞা বিরোধী দর্শণ, যে দর্শণে ক্রমশঃ অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলেন তত্কালীন ব্রিটিশের দয়ায় জাবিকা অর্জন করা শহুরে বর্ণকুলীনেরা, যাদের উত্তরাধিরারীরা তার একশ নব্বই বছর পরে ব্রিটিশদের দেখানো পথে ভারত শাসনের, ভারত রাষ্ট্র বিকাশের অধিকার অর্জন করবেন।
ইংরেজ আর ইওরোপকেন্দ্রীয় ঐতিহাসিক-সমাজবিদ-অর্থনীতিবিদের কল্যানে ঔপনিবেশিক ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত অনেকেরই বিশ্বাস ভারতীয় সভ্যতার মূল ছিল কৃষিভিত্তি। এই ধারণা আরও গভীরে শেকড় পেয়েছে বিগত প্রায় এক শতাব্দের মার্কসীয় পাণ্ডিত্যে। তাঁর এক ভাবশিষ্য, বিদ্রোহী পূর্বভারতের সুনিপুণ চিত্র আঁকা সুপ্রকাশ রায় বলছেন ..তখন মানব সমাজের ইতিহাসে উন্নততর বুর্জোয়াশ্রণীর অভ্যুদয় ও আধিপত্যের যুগ আরম্ভ হয়ে গিয়াছে। এই নতুন যুগের সঙ্গে ভারতের প্রাচীণ গ্রাম-সমাজের ব্যবস্থা ছিল সামঞ্জস্যহীন। ভারতীয় সমাজে অগ্রগতির পথে এই অচল ও অপরিবর্তনীয় সমাজব্যবস্থা একটা বিরাট বাধা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। এই অচল ও অপরিবর্তনীয় সমাজব্যবস্থা, যার ভিত্তিভূমি কৃষি, সেই সভ্যতা ভাঙতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বৈত ভূমিকার কথা একদা ঋষি মার্কস, আজও তাঁর অনুগামীরা কম্বুকণ্ঠে উদগাত করে থাকেন। শুধু ইওরোপিয় বামপন্থীদের পাঠ থেকে ভারতীয়রা নিজেদের সমাজকে অশ্রদ্ধা প্রকাশ করে শুধুই অচল ও অপরিবর্তনীয় সমাজব্যবস্থা বলে অভিহিত করেই ক্ষান্ত হননি, তাঁরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সমালোচনা করেও বৌদ্ধকভাবে উন্নততর বুর্জোয়াশ্রণীর প্রতিনিধি ব্রিটিশ পোষিত বণিক সমাজের দেখানো পথকেই নিজেদের পথ হিসেবে ভাবতে পছন্দ করতেন, নিজের সমাজের তুলনায় সে সমাজের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা ছিল অমিতপ্রায়। অথচ ভারতীয় সমাজের ভিত্তি কৃষি হলেও শিল্পকলা, বিদ্যাদান আর নানান ধরণের কারখানার উদ্যমের মাধ্যমেও একটি বড় অংশের মানুষ নিজের জীবিকা অর্জণ করতেন। ভারতের প্রায় সব সমাজেই কৃষিতে নিযুক্ত মানুষের থেকে অন্যান্য জীবিকায় নিযুক্ত মানুষের সংখ্যাই ছিল বেশি। সনাতন ভারতাত্মা আবিষ্কারে প্রাণ ঢেলেদেওয়া ধরমপালজীর আবিষ্কৃত চেঙ্গলপট্টুর এক ব্রিটিশ সমীক্ষা থেকে এই তথ্যের প্রমাণ উঠে আসে – ১৭৬২ থেকে ১৭৬৬ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারের এক সমীক্ষায় প্রকাশ, কৃষিতে নিযুক্ত শ্রমিকরা ছিল ৩০ শতাংশের আশেপাশে মাত্র, বাকিরা অন্য জীবিকায়। চেঙ্গলপট্টুর মন্দিরগুলির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জমিগুলির অভিধা ছিল মান্যম। যত বিশালকায় মন্দির তত বেশি বেশি মান্যমের পরিমান – তত বেশি তার সামাজিক দায়। মান্যমের আয় থেকেই এই মন্দিরগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করতেন সামাজিক প্রযুক্তি, বিদ্যা, কারখানা, শিল্পকলাসহ নানান কার্যে নিযুক্ত পেশাদার মানুষদের। যদিও এই সব জীবিকায় নিযুক্ত বিশেষজ্ঞরা কেউই মাইনে করা কর্মচারী ছিলেন না – এমনই ছিল তাঁদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। সমাজিক নিয়ন্ত্রণে থেকেও তারা সকলেই সমাজ বিকাশের গতিশীল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। এমনকী মান্যমের বরাদ্দ থেকে বাদ পড়তনা মসজিদও। মন্দির-মসজিদকে কেন্দ্র করে যে অসম্ভব গতিশীল এক সংস্কৃতি ভারতীয় সমাজ হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে উঠছিল। ব্রিটিশরা শাসন ক্ষমতা পাওয়ার পর প্রত্যেক মন্দিরের বরাদ্দ হল ১৭০০ ডলারের কাছাকাছি অর্থ – যা ব্রিটিশ ভারতের শাসনক্ষমতার কাঠামো ছেড়ে যাওয়ার পরও বর্তমান ছিল। ভারতীয় সমাজ ভাঙার দিকে আর এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এবং এই কাজে শহুরে কোনো শিক্ষতসমাজই প্রতিবাদ করে নি – স্বাধীনতার পর সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছেন ব্রিটিশ দেখানোর পথ। সম্পদ বাঁচানোর পাশাপাশি যথাসম্ভব উপযুক্ত পরিমান ব্যয় করে, সামাজিক কৃতিগুলি রক্ষা করার কাজে অননুকরণীয়ভাবে দক্ষ, ভারতীয় সমাজকে মাটিতে মেশানোর কাজ করে গিয়েছে ইংরেজি শিক্ষিত শহুরে শিক্ষিত বাঙালি অথবা ভারতীয় মান্যবরেরা সে সময় ব্রিটিশপথানুগামীহতে গিয়ে, ব্রিটিশ চক্রান্তে সামিল হতে গিয়ে। গান্ধীর ঘোষিত শত্রু নোবেলবিজয়ী চার্চিল অথবা তার উত্তরাধিকার বহনকরা শ্রমিক দলের প্রধাণমন্ত্রী এটলিও গান্ধীর থেকে বেশি পছন্দ করতেন আদ্যপান্ত পশ্চিমি আর ভারতে ব্রিটিশ সভ্যতার উত্তরাধিকারের চাকা চালুরাখায় দায়বদ্ধ জবাহরলালকেই। তাই ভারত পিঠেভাগের সময় জবাহরলালগোষ্ঠীর কথা শুনতেন মাউন্টব্যাটেনসাহেব।
No comments:
Post a Comment