হাজার হাজার সমাজ নিয়ে সমবায়ী ভারত তার সভ্যতার ঊষাকাল থেকে এ ধরনের হাঘরে-হাভাতে সরকার দেখেনি। সমাজের বুকের ওপর চেপে বসে ১৯০ বছরের শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত যতটা পারি লুঠ করে, নিজের দেশে চালান করি দর্শনে মতোয়ারা লুঠেরা-শাসকের শাসন অনুভব করে একের পর এক ভারতীয় সনাতন সমাজ বিদ্রোহের কোনো প্রস্তুতি না নিয়েই অবলীলায় লুঠ প্রতিরোধে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। পলাশীর যুদ্ধে এ দেশ শাসন করার পতাকা ছিনিয়ে নিয়ে ব্রিটিশ বণিক সাম্রাজ্য প্রথমে বাংলা, তারপর প্রায় সমগ্র ভারতের তক্ত-তাউস দখল করে প্রায় দুশো বছর একাদিক্রমে ভারতীয় সমাজকে ছিবড়ে করার পরিকল্পনা করবে, তাকে প্রথম থেকেই সনাতন গ্রামীণ ভারত চিনতে ভুল করেনি। কেননা ভারতীয় সমাজ দেখেছে হাজার হাজার বছরের ভারতীয় সম্পদের আকর্ষণে বহু লুঠেরা-শাসক এসেছে-গিয়েছে, কেউ শুধুই লুঠে মত্ত হয়ে অজস্র ধনসম্পদ নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়েছে, কেউবা আবার অক্লেশে ভারতীয় হয়ে মিশে গিয়েছে ভারতীয় সমাজে। দাঁত নখ বের করা নব্য লুঠেরা ব্রিটিশ শাসককে, ভারতে সরকার চালানোর শেষ দিন পর্যন্ত গ্রামীণ ভারত তার সর্বশক্তিতে বিরোধ করে গিয়েছে, শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মত পায়ে মাথা লুটিয়ে দেয়নি।
এক সুগভীর চক্রান্তে বাংলার দেওয়ানি শাসনের অধিকার দখল পাওয়ার বহু আগে থেকেই ব্রিটিশ বেনিয়ারা একচোখোভাবে ভারত তথা বাংলার শাসন ক্ষমতা নিজের হাতে নেওয়ার দিকে চুপিচুপি পায়ে এগোচ্ছিল। ব্রিটিশ বণিকেরা হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার কথা ভাবছিল পলাশির প্রায় ১০০ বছর আগে থেকেই। ১৬৬৯তে বম্বের ব্রিটিশ কারখানার(গুদামের) প্রধান Gerland Ungier, কোম্পানির ডিরেক্টরদের লেখেন the time now requires you to manage your general commerce with the sword in your hands. পালাশীর চক্রান্তে, পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা, বাংলা সুবার দ্বৈত শাসনের জমিদারি চালাতে গয়ে ব্রিটিশ ঠিক করে রেখেছিল, প্রথমে বাংলা, তার কিছুদিন পরে ভারতজুড়ে তার লুঠের লাঠি চালাতে হবে। আর এই চক্রান্তের রথ চালাতে প্রয়োজন সরাসরি এক শ্রেণীর ভারতীয়র সরাসরি সহায়তা। বাস্তবে ভারতবর্ষে লুণ্ঠণকার্য চালাতে গিয়ে, তার এই কাজের সরাসরি সহায়ক কে হবে, তা নিয়ে সে নীল নকশায় আঁক কষতে গিয়ে দেখল, গ্রামীণ বাংলার সঙ্গে সমগ্র পূর্ব আর উত্তর-পূর্ব ভারত ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে এক জোট। আগামী দেড়শ বছর ধরে যে বিদ্রোহের বীজ রোপিত হবে সেই, সেখানে গ্রামীণ সমাজ দেশ শাসনের নামে লুঠের কাজে ব্রিটিশদের একটুকুও দম ফেলার সুযোগ করে দিচ্ছেনা। বিদেশির রোপণ করা আধুনিকতা বা ইওরোপ আগত সমাজভাঙা প্রকল্পের অধীন তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটিও সনাতন ভারত, শহুরে ভারতেরমত মাথা পেতে নেয়নি – তাকে ছুঁড়ে ফেলেছে আস্তাঁকুড়ে। তাই তাকে তার হাতের কাছে থাকা শহুরে উচ্চবর্ণ অথবা নতুন করে বর্ণতা অর্জণকরা ধণিক, হ্যাট-ক্যাট-ম্যাট গোছের কয়েকটা কেঠো ইংরেজি শব্দযন্ত্রদানব মুখস্ত করে, প্রথমে বেনিয়ানগিরি, পরে জমিদারি, তার পরে আরএকটু বেশি ইংরেজি সভ্যতার গা ঘষাঘষি করে বাঙালি মধ্যবিত্তের অন্যতম মোক্ষ কাজ, উচ্চবেতনে(বেতনটা কেমনছিল বলাযাক – ১৮২৭ সালে জনৈক এম ডব্লিউ উলাস্টন সংস্কৃত কলেজে মাসিক ২০০ টাকায় নিযুক্ত হন – এর প্রায় দেড়শ বছর পর প্রবন্ধ লেখকের মাতাঠাকুরাণী ১৯৬৪তে পাঠশালার কাজে নিযুক্ত হন ১২৭ টাকা মাইনেতে) সরকারি চাকুরি করেছে আর পোষা সারমেয়রমত ব্রিটিশের দর্শন চেটেপুটে খেয়ে সমাজের মানুষের ভুষ্টিনাশ করেছে। আরও সরসরি বললে ব্রিটিশ সরকার আর উচ্চমধ্যবিত্ত ভারতের যৌথ চক্রান্ত প্রকল্পের ফসল ভারত লুঠের সামগ্রিক পরিকল্পনা। ব্রিটেন থেকে উচ্চ বেতনে কর্মচারী আমদানিকরা মহামহিম(অনারেবল) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেপমারি অর্থনীতির বিরোধী – প্রয়োজন শস্তার ভারতীয় বুদ্ধিজীবি-শ্রমিক। তাই বেন্টিঙ্ক-মেকলের আমলে কালোচামড়ার চাকুরে সাহেবদের বাড়বাড়ন্তি। এ যেন আজকের বিশ্বায়িত বেনিয়া শাসিত অর্থনীতির ভিত্তিস্থাপন। ঔপনিবেশিক শাসকদের আজকের প্রতিনিধি শহুরে ভারত চোখ কুঁচকে তাকাবেন জেনেও কিন্তু এ কলমচি নিরুপায় – এ বড় নিষ্ঠুর কিন্তু বাস্তব তথ্য। পলাশির আগে থেকেই বাংলার ধণিক-বণিকদের সঙ্গে মিলেমিশে যে চক্রান্তের জালটি ব্রিটিশ বণিক তক্ততাউস দখলের জন্য বিছিয়েছিল, সেই মিলিত চক্রান্তের জাল আরও বড় আরও কঠিন হয়ে ব্রিটিশ শাসনের প্রথম বছর থেকে ফাঁস হয়ে বসে গেল গ্রামীণ লৌকিক-আদিবাসী বাংলার গলায়। সেই চক্রান্তের জালটি বিশ্বায়ণের ছলে ব্রিটিশ শাসনের ৬০ বছর পরেও আরও আরও নতুন ছকে, নতুন নতুন চক্রান্তে সারা সমাজের দেহে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে বসছে ক্রমাগত।
No comments:
Post a Comment