১৮৩০এর অগাস্টের গোড়ার দিকে কলকাতায় পাদ্রি হিলের প্রথম বক্তৃতা, সবার
ওপর খ্রিস্ট ধর্ম। বিনয় ঘোষ বলছেন, ক্ষুরধার যুক্তিতে
ছাত্রদের মন কেড়ে নিলেন হিল। বক্তা একে প্রণম্য
ইওরোপিয় পাদ্রি তায় বক্তৃতার বিষয় রাজার ধর্ম, হিন্দু সমাজের পাঁজর পর্যন্ত
কেঁপে উঠল। কলকাতার সমাজ কাঁপল ইয়ং বেঙ্গলিদের
নতুন খ্যাদ্যাভ্যাসে ...হিন্দু কলেজের ছেলেরা হিনরী ভিভিয়ান ডিরোজিও এবং হেয়ার
সাহেবের শিক্ষায় প্রকাশ্যভাবে অখাদ্য খাইতে আরম্ভ করিয়াছিল ও হিন্দুধর্মের প্রতি
অনাস্থা দেখাইতে লাগিল। মহেশচন্দ্র
ঘোষ ও কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় খৃষ্টান হইল। রামমোহন ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করিলেন। সমাজে ও কলিকাতার হিন্দুধর্ম গেল গেল রব পড়িয়া গেল। রামকমল সেন হিন্দু কলেজ হইতে উক্ত ডিরোজিওকে ছাড়াইতে গেলেন, কিন্তু
উইলসন, হেয়ার ও শ্রীকৃষ্ণ সিংহের(কালীপ্রসন্ন সিংহের পিতামহ) জন্য তাহা পারিলেন না। উক্ত সেনকে মিন্টের ও ব্যাঙ্কের দেওয়ান করিয়া কোম্পানি বশ করিয়া ফেলিল। ডিরোজিও নিজে ইহাদের ধন্যবাদ দিয়া চাকরি ছাড়িয়া দিলেন।...ডিরোজিওর ছাত্রেরা সকলেই কোম্পানির বড় চাকরীয়া ডিপুটি কলেক্টর হইল(রায়বাহাদুর প্রমথনাথ মল্লিক, কলিকাতার কথা)। ডিরোজিওর কাজে কালেজের পরিচালকরা অখুশি। প্রতিবাদে ডিরোজিও পদত্যাগ করলেন, ২৫ এপ্রিল ১৮৩০। ২৬ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হল। মাস্টারমশাইএর
পদত্যাগের পর আলালেরা মিলে দ্য এনকয়ারার
পত্রিকা প্রকাশ করলেন। একমাস পরে দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়প্রকাশ
করবেন জ্ঞাণান্বেষণ। হঠাতই একরাতে
কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার সহযোদ্ধারা হিন্দুধর্মের মূলে কুঠারাঘাত করতে
গোমাংস ভক্ষণ করে অবশিষ্ট উচ্ছিষ্ট হাড়গুলি পাশের ব্রাহ্মণের বাড়িতে ছুঁড়ে দেন। (দক্ষিণারঞ্জনের পিতার বিবাহ সম্বন্ধে জীবনীকার মন্মথনাথ ঘোষ লিখছেন, পরমানন্দের
এক জ্ঞাতি খুল্লতাত কর্ম্মোপলক্ষ্যে কলিকাতায় বাস করিতেন। সূর্য্যকুমার ঠাকুরের কন্যা বিবাহযোগ্যা হইলে তিনি পরমানন্দের খুল্লতাতকে
একটি সদ্বংশীয়, সুচরিত্র ও সুপুরুষ পাত্রের অনুসন্ধান করিয়া দিতে বলেন এবং মনোমত
পাত্রের সহিত বিবাহসম্বন্ধ করিয়া দিলে তাঁহাকে পঞ্চ সহস্র মুদ্রা পুরস্কার দিতে
প্রতিশ্রুত হন। পরমানন্দ
দেখিতে অতি সুপুরুষ ছিলেন, তাঁহার বংশ ও চরিত্র যতদূর সম্ভব নিষ্কলঙ্ক ছিল। সুতরাং তাঁহার খুল্লতাত তাঁহাকেই উপযুক্ত পাত্র বলিয়া স্থির করিলেন। কিন্তু পাত্রের বিধবা জননী যে কখোনোই এই বিবাহে সম্মতি দিয়া কুলমর্য্যাদা
ক্ষুন্ন করিবেন না, ইহা তিনি বিলক্ষণ জানিতেন। সুতরাং তিনি একটি কৌশল অবলন্বন করিলেন। তিনি পরমানন্দের জননীকে বলিলেন যে কলিকাতায় কোনও পর্ব্বোপলক্ষ্যে
নানানপ্রকার আমোদ প্রমোদ হইবে, কালীঘাটে মহাসমারোহে পূজা অর্চ্চনাদি হইবে, তাঁহার
ইচ্ছা যে পরমানন্দকে এই সকল দেখাইয়া আনেন। সরলাহৃদয়া জননী কোন প্রকার কপটতা সন্দেহ না করিয়া সানন্দচিত্তে সম্মতি
দিলেন। পরমানন্দের খুল্লতাত তাঁহাকে
সূর্য্যকুমারের গৃহে আনিয়া তাঁহার হস্তে সমর্পণ করিয়া প্রতিশ্রুত পুরস্কার লইয়া
বিদায় গ্রহণ করিলেন। সেই দিবসেই
পরমানন্দের গত্রহরিদ্রা হইয়া গেল। বালর পরমানন্দ ক্রন্দন করিলে সূর্য্যকুমার বহুমূল্য অলঙ্কারাদি দিয়া
তাঁহাকে ভুলাইয়া রাখিলেন। বিবাহ কার্য্য
সুসম্পন্ন হইলে পরমানন্দের জ্ঞাতিরা সমস্ত জানিতে পারিলেন। এই সময় হইতে পরমানন্দ কলিকাতায় বাস করিতে আরম্ভ করিলেন এবং ভট্টপল্লীর
সমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন হইলেন।
পরমানন্দ কলিকাতায় জগন্মোহন নামেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় নামকরণ সম্বন্ধেও একটি কৌতুকাবহ গল্প প্রচলিত আছে। সেকালে ঠাকুর পরিবারে এইরূপ নিয়ম ছিল যে, বাটীর জামাতার নাম পরিবারস্থ
মহিলাদিগের পছন্দ না হইলে, তাঁহাদের অন্য নাম দেওয়া হইত। পরমানন্দের নামটি মহিলাদিগের পছন্দ হয় নাই, বিশেষতঃ উচ্চারণের সাদৃশ্যবশতঃ
তাঁহার সহধর্ম্মিীর পক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় “পরমান্ন” শব্দ উচ্চারণ
করাও দোষাবহ বলিয়া বিবেচিত হইয়াছিল। সেইজন্য পরমানন্দের নাম পরিবর্ত্তিত করিবার প্রয়োজন হয়। পূর্ব্বেই উক্ত হইয়াছে যে পরমানন্দ দেখিতে অতি সুপুরুষ ছিলেন। সেইজন্য তাঁহার নাম জগন্মোহন রাখা হয়। দুর্গাদাস নামে পরমানন্দের এক ভ্রাতা ছিলেন। ইনি খড়দহের বিখ্যাত গোস্বামী বংশোদ্ভব চৈতনচাঁদ গোস্বামীর এক পৌত্রীকে
বিবাহ করিয়া খড়দহে বাস করিতেন। কিছুদিন পূর্ব্বে তাঁহার বিষয়াদির উত্তরাধিকার লাভের জন্য দক্ষিণারঞ্জনের
ভ্রাতা নিরঞ্জন মুখোপাধ্যায় আলিপুর কের্টে এক দাবী উপস্থাপিত করেন। সেই মেকদ্দমায় স্যর যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর বাহাদুরের সাক্ষ্য লওয়া হয়। মহারাজা বাহাদুর যাহা বলিয়াছিলেন তাহা এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্যঃ- The
Witness on solemn affirmation says – My name is Jotindra Mohan Tagore. My age
is 75 and my fathe’s name Huro Kumar Tagore. My profession is Zemindary.
- I Know the plaintiff Niranjan Mukherjee.
- He is my জ্যেঠতুতো
ভগ্নীর ছেলে অর্থাত ভাগ্নে।
- আমার
তৈষ্ঠতাতের নাম সূর্য্যকুমার ঠাকুর মহাশয়।
- Niranjan Mukherjee’s father’s name is Jaganmohan Mukherjee.
- এখানে এই
নামই ছিল কিন্তু আমি শুনেছি যে তাঁর বাটীতে নাম ছিল পরমানন্দ।
- এখানে
মানে আমাদের বাড়ীতে।
- আমাদের
বাটীতে এরকম নিয়ম ছিলযে, যদি জামাইএর নাম মেয়েদের পছন্দ না হইত, ভাল না লাগিত
– তখন অন্য
একটা নাম দেওয়া হইত।
- জগন্মোহনের
পিতার নাম ভৈরবচন্দ্র মুখুয্যে ছিল।
- আমি জানি
না যে জগন্মোহনের ভ্রাতা ছিল কি না।
- Jganmohan was a high caste Kulin Brahmin before his marriage.
- আমাদের Familyর নিয়ম ছিল যে, ভাল কুলীন দেখে
বিবাহ দেওয়া।
- ভৈরবচন্দ্রের
সঙ্গে আগে কেন কুটুম্বিতে আমাদের ছিল
না, এই বিবাহে প্রথম হইল।
- আমার
ঠাকুরদাদার Familyতে নিয়ম ছিল যে ভাল কুলীনের ছেলে এনে আমাদের Familyতে বিবাহ দেওয়া এবং ভাল করে provision করে দেওয়া। জগন্মোহনের সময় এই হইয়াছিল।
- আমাদের
পিতামহ গোপীমোহন ঠাকুর জীবিত থাকার সময় এই বিবাহ হয়।)
গোমাংস ভক্ষণ প্রসঙ্গে রাজনারায়ণ বসু, সেকাল আর একাল
গ্রন্থে বলছেন, সাহেবরা গোমাংসভোজী, দুঃখের বিষয় এই যে, বাঙ্গালীরাও তাহাদের
সঙ্গে এ বিষয়ে যোগ দেন। বাঙ্গালীরা
গোমাংসভোজী হইলে আরো ভয়ানক হইয়া উঠেন। ...একজন প্রসিদ্ধ ইয়ংবেঙ্গল বলিতেন যে, প্রত্যহ এ বেলা অর্ধ সের আর ওবেলা
অর্ধ সের গোমাংস ভক্ষণ না করিলে বাঙ্গালী জাতি কখোনোই বলিষ্ঠ হইবে না এবং যাহা
বলিতেন তাহা কার্যে তাহাই করিতেন। কিন্তু
পরিশেষে তার ত্বক রোগ উপস্থিত হইয়া শরীর এমন অসুস্থ হইয়া পড়িল যে, পাচক ব্রাহ্মণ
রাখিয়া ভাত ডাইল খেতে বাধ্য হইলেন। বোধহয়,এই প্রসিদ্ধ ইয়ং বেঙ্গলি স্বয়ং রাধানাথ শিকদারই হবেন। রায়বাহাদুর প্রমথনাথ মল্লিক, কলিকাতার কথার ২৩৮ পাতায় রামগোপাল ঘোষ এবং
তাঁর সাথীদের ব্যবহার বিষয়ে বলছেন, ছেলেরা বাপ মায়ের কথা শুনিত না, তাহাদিগকে
মুর্খ ঠাওরাইত। তাহারা অখ্যাদ্য খাইতে কোনওরূপ শঙ্কা
করিত না। কেহ কিছু বলিলে বলিত – Be moderate in drink and food, glass of whisky chiken
both very good. লোকে বিখ্যাত রামগোপাল ঘোষের পিতাকে
গোখাদক গোবিন্দ ঘোষ বলিতে অযথা গালি দিতে ছাড়িত না। রাধানাথ শিকদার বলিত ঐ সকল মাংস না খাইলে শরীরে জোর হইতে পারে না। মহেশচন্দ্র সিংহ পিতার অবাধ্য ছিল বলিয়া তাহার খুড়া নন্দলাল সিংহ তাহাকে
ডিরোজিওর কাছে লইয়া গিয়াছিল। রাজা
দক্ষিণারঞ্জন পিতার দুর্ব্যবহারের জন্য পৃথক বাড়ীতে থাকিতে গিয়াছিল।
জনরোষে পাড়া ছাড়া কৃষ্ণমোহন এমনকী দক্ষিণারঞ্জনও। কৃষ্ণমোহনের ধর্মতলায় এক ইওরোপিয়র বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ। খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষার পথে আর এক পা। হিন্দুধর্মের প্রতি গায়ের ঝাল মেটাতে নাটিকা লিখলেন, The Persecuted or Dramatic
Scenes Illustrative of the Present State of Hindoo Society in Calcutta। উদ্দেশ্য হিন্দুবর্ণশ্রেষ্ঠরা কতদূর অসাধু, শঠ আর ধূর্ত
সেই তথ্য প্রকাশ। পাদ্রিরা মোটামুটি সকলেই
ধোয়া তুলসিপাতা, বিপ্লবের তূর্যবাদক। শোনাগেল, এই পুস্তকটি ছাপা হলে ইংরেজরা(কানান্তরে
পাদ্রিরা) দুকপি থেকে ছকপি পর্যন্ত বই কেনার প্রতিশ্রতিও দিচ্ছে। কৃষ্ণমোহনের উদ্দেশ্যতো বই বিক্রি নয়, নিজের ধারকরা
ভাবনা কতটা ইওরোপিয় সেই তত্ব আর নিজের সমাজ কতদুর পচাগলা, তার পরিমান ছাপ্পামেরা
পশ্চিমের কাছে বিক্রি। কলকাতার খ্যাপা লড়াই
দেখতে মাঠের বাইরে বসে বঙ্গরঙ্গে হাততালি দেওয়া ইংরেজরাই নয়, পাদ্রিরাও নতুন করে
উদ্যমী হয়ে উঠল, ক্রমশঃ অনুগামী বাড়তে থাকল। জেসুইট পাদ্রিদের ভারতীয় সমাজ-ধর্মের প্রতি ঘৃণাছাড়ানোর
দায় নিজেদের কাঁধে ক্রমশঃ তুলে নিল যুবকেরা। শহুরেবাঙালিইংরেজপ্রভুরসাম্রাজ্যবন্ধন সুদৃঢ় হল।
No comments:
Post a Comment