হিন্দু কলেজের পরিকল্পনা করতে ৪ মে ১৮১৬, সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি
স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্টএর বাড়িতে এক মিটিং বসে। চাঁদা ওঠে ছহাজার পাউন্ড। কিন্তু এই
গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি, ভারতের বড়লাটের, নিদেনপক্ষে ছোটলাটের বাড়িতে হল না কেন! রায়বাহাদুর
প্রমথনাথ মল্লিক কলিকাতার কথায় এই ধাঁধার উত্তর দিচ্ছেন, কোম্পানির
রাজত্বে কলিকাতার সব বড়লোকের ঘরে মামলা ঢুকিয়াছিল, উহাতে গভর্ণর জেনারেল অপেক্ষা
প্রধান বিচারপতির মান্য তখন অধিক ছিল। ১৮১৭র ২০
জানুয়ারি হিন্দু কালেজের গোড়াপত্তন হয় মাসিক আশি টাকায় গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে। ১৮২১এর ২১ আগস্ট সংস্কৃত কলেজ শুরু। খরচ ৮৫৯৬১
টাকা। জমির জন্য হেয়ার সাহেবকে অতিরিক্ত দেওয়া হল ৩৩৫০০ টাকা,
সাকুল্যে ১১৯৪৬১ টাকা। সঙ্গে গড়ে উঠল ক্যালকাটা স্কুল
বুক সোসাইটি আর ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটিও। অর্ধশতাব্দধরে ইংরেজ শাসনে কলকাতার অচলা ভক্তি আর শহুরে বাঙালির আনুগত্যের
পুরস্কারস্বরূপ, শিক্ষা খাতে কলকাতায় ব্যয়বরাদ্দ হল ৭৬ শতাংশ, ১৯শতাংশ বম্বেতে আর
বাকি ৫ শতাংশ মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে।
১৮২৩এ তৈরি হল গৌড়িয় সমাজ। সদস্য হলেন রামমোহন গোষ্ঠীর দ্বারকানাথ, প্রসন্নকুমার, তারাচাঁদ চক্রবর্তী,
আর সনাতনী গুড়ুম সভার ভাবানীচরণ চট্টোপাধ্যায়, রামদুলাল দে, কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন। ঐতিহাসিকেরা বলছেন দেশের সমাজের উন্নতি কী করে করা যায়, তা নিয়ে চিন্তিত গৌড়িয়
সমাজের সভ্যরা আলাপ আলেচনা করতেন। একদিন
বিদ্যাসাগর(কু)খ্যাত রসময় দত্ত বলেন, সভায় যদি বিদ্যা বিষয়ে আলোচনা হয়, তাহলে
তাঁকে পাওয়া যেতে পারে। আর যদি রাজসংক্রান্ত কি ধর্মশাস্ত্র
নিয়ে আলোচনা হয়, তাহলে তিনি থাকবেন না। মোটামুটি এই
ছিল সমিতির আলোচনার পরিচয়, এবং সেগুলির শহুরে চাকুরীজীবী এবং ব্যবসায়ী সভ্যদের
মানসিকতা।
১৮১৯এশুরু হল সন্দ্বীপের তৃতীয় স্বাধীণতা সংগ্রাম। গোকুল ঘোষালের আমলথেকেই জমিদারেরা কোম্পানি সরকারের মদতে, সন্দ্বীপে জমি
ইজারা নিয়ে যা খুশি অর্থ লুঠ করতে পারত। কেদারনাথ
মজুমদার ময়মনসিংহের ইতিহাসএ বলছেন, কথিত
আছে, কিষণগড়ে পঞ্চাশ দ্রোণ জমি ব্রাহ্মণ ও ফকিরগণকে জমিদারেরা নিষ্কর দিয়াছিলেন। গোকুল ঘোষাল ঐ সকল জমি বাজেয়াপ্ত করেন। এর ফলে সন্দ্বীপের স্বাধীণতা সংগ্রাম তুমুলরূপে বেড়ে চলে। এখানকার নিরবিচ্ছিন্ন স্বাধীণতা সংগ্রামের ফলে সন্দ্বীপে খাজনা আদায়
অসম্ভব হয়ে পড়ল। দীর্ঘসময় ধরে জমিদারিগুলি খাজনা
অনাদায়ে প্রকাশ্যে নিলাম হয়ে চট্টগ্রামের নিমক মহলের দেওয়ান রামচন্দ্র বিশ্বাস (কলকাতার
অন্যতম পাইকারি নুন ব্যবসায়ী) পুত্র প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাসের জন্য জমিদারিটি নিলামে
ক্রয় করেন। নতুন করে খাজনা আদায়ের চেষ্টাতে প্রজারা
অস্ত্র হাতে নেয়। প্রাণকৃষ্ণ খাজনা উদ্ধার করতে না
পেরে পাইক বরকন্দাজ দিয়ে অত্যাচার আরম্ভ করেন। সংঘর্ষ শুরু হয়। বর্ধিষ্ণু কৃষক গোবিন্দচরণ চৌধুরী এই
বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। ১৮১৯এ জমিদারের বাহিনীর সঙ্গে
গোবিন্দচরণ আর কৃষকের মিলিত বাহিনীর লড়াই হলে প্রাণকৃষ্ণর বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়
হয়। শেষ পর্যন্ত এই জমিদারি কেউ না কেনায় সরকার এটিকে এক
টাকায় খরিদ করে। এর ফলে অত্যাচার যে কমেছিল তার কোনও নিশ্চিত
সংবাদ নেই।
ডিরোজিও
কলকাতার শিক্ষা দরবারের নতুন মসিহা, ডিরোজিওর প্রবেশ। একে ইওরোপিয়, তায় ভারত সভ্যতা বিদ্বেষের বীজ রোপন করছেন, তারপর কালেজের
অধ্যাপক। এই ত্র্যহস্পর্শে তিনি বাঙলার
বালখিল্যদের নেতৃত্ব অর্জন করলেন। ঐতিহাসিকেরা
বলছেন তিনি মুক্ত চিন্তার ধারকবাহক। ইংরেজ
সাম্রাজ্য শাসনে মুক্ত চিন্তা আদতে লুঠেরা মুক্ত বাণিজ্যের অন্য পিঠ। মুক্তবাণিজ্যের মূল কথা, আমব্যবসায়ীদের ধরেবেঁধে ইংরেজদের খুশিমত ব্যবসা
করতে দেওয়া। তেমনি, মুক্তচিন্তার অঘোষিত অর্থ,
ভারতবিরোধী ইংরেজ বুদ্ধিজীবিদের অবাধে বাঙলার তাত্বিক রাজত্ব করতে দেওয়ার সুযোগ। বাঙলা-বিহারজুড়ে এক লাখ পাঠশালা, বাঙলাজুড়ে বহু বিশ্ববিদ্যালয়, সেই পঠন
পদ্ধতির বলে বাঙলার পণ্যের বিশ্ব একচেটিয়া বাজার, বাঙলার অর্থনীতি উদ্বৃত্ত। তবুও মুক্ত চিন্তার ধারকবাহকেরা বললেন বাঙলায় ইংরেজি মাধ্যমে আর ব্রিটিশ
পদ্ধতিতে পড়াশেনার সুযোগ করে না দিলে বাঙলার সমূহ ক্ষতি। এডাম সমীক্ষায় প্রকাশ বাঙলায় অন্তঃত ১ লক্ষ পাঠশালএর সঙ্গে ১৯টি মেয়েদের
বিদ্যালয় রয়েছে, এত্ত লুঠ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, নীলকরদের
লুঠ এতসবের পরেও। মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা বললেন বাঙলায়
নতুন করে স্ত্রী শিক্ষা পরিকাঠামো গড়ে তুলে হবে। গ্রামে গ্রামে বিদ্যাসাগর ছুটলেন মেয়েদের পাঠশালা খুলতে – চলতি বিদ্যালয়গুলোর প্রসারনের কথা মনেই পড়লনা(বিদ্যাসাগর আডামের সমীক্ষা
যে দেখেছেন, এখনও পর্যন্ত তার কোন নিদর্শন পাই নি)। ইংরেজির বাজার তৈরি করার মুক্ত বুদ্ধি প্রচারে, দেশের ঠাকুর পুজোর
পরিকাঠামো ভেঙেফেলে বিদেশি কুকুর পুজোর এত্ত খরচসাপেক্ষ দুর্বুদ্ধির আয়োজন। বিশ্বে অন্য কোথাও এ ধরণের আযোজন যদি হয়েও থাকে, সেই তালিকায় প্রথমতমস্থানটিতে
বাঙলার নাম অবশ্যই উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। আজও
স্বাধীণতার প্রায় ৭০ বছর পরও এত্ত ঢক্কানিনাদ চোখ কপালে তোলা অর্থব্যয় সত্বেও
ভারতে পশ্চিমি পদ্ধতিতে শিক্ষায় স্বাক্ষরতার হার বিশ্ব সমাজে বলারমত নয়।
তো, ১৮২৬এ সতেরো বছর বয়সে, হিন্দু কালেজে চতুর্থ শিক্ষকের
পদে আবির্ভুত হলেন মুক্তবুদ্ধির গুরুঠাকুর ডিরোজিও সাহেব। দেশিয় গোঁড়ামি ভাঙতে বিদেশি মুগুর হাতে এগিয়ে এলেন তিনি এবং তাঁর ছাত্র রামগোপাল
ঘোষ, রামতনু লাহিড়ি, রাধানাথ শিকদার, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র,
কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, হরচন্দ্র ঘোষ। ছাত্রদের নিয়ে বিতর্কসভা অনুষ্ঠিত করলেন যার নাম হল একাডেমিক
ইন্সটিটিউশন। ইওরোপিয়দের মধ্যে এই বিতর্ক সভায় যোগদিতেন
চিফ জাস্টিস এডওয়ার্ড রায়্যান, উইলিয়ম বেন্টিঙ্কের ব্যক্তিগত সচিব কর্ণেল বেনসন,
কর্ণেল বীটসন(পরে এডজুটেন্ট জেনারেল), বিশপ কলেজের অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ডব্লিউ এইট
মিল, অসম্ভব শ্রদ্ধায় লিখছেন দক্ষিণারঞ্জনের জীবনীকার মন্মথমাথ ঘোষ মহাশয়।
ইতোমধ্যে শুরুহল রামমোহনের সতীদাহ প্রথা বিরোধী আন্দোলন –
কোন প্রণোদনায় তিনি এই আন্দোলনে জুটলেন, সেই কুরুচিকর ব্যক্তিগত বিতর্কে এখানে
আমরা ঢুকছি না, যা বলার গিরিজাশঙ্কর বলেছেন। রামমোহন-দ্বারকানাথ পর্বে আরও কিছু তথ্যএর বিশদ আলোচনা
করা যাবে।
No comments:
Post a Comment