তিতুমীর(http://choturmatrik.com/blogs প্রণব আচার্য/তিতুমীর)
প্রণব আচার্য্য
আপনার নামে এখনো দুলে ওঠে বাঁশ ঝাড়
দুলে ওঠে বিস্তীর্ণ মাঠ, কৃষকের চৌকষ কাস্তে
লাঠি আর লাঠিয়াল, দুলে ওঠে 'তাহ্বান্দ'।
মানুষের সংগ্রামে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় দুলে
ওঠে উনিশ শতক, নারকেলবাড়িয়ার ঘাস।
দুলে ওঠে বিস্তীর্ণ মাঠ, কৃষকের চৌকষ কাস্তে
লাঠি আর লাঠিয়াল, দুলে ওঠে 'তাহ্বান্দ'।
মানুষের সংগ্রামে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় দুলে
ওঠে উনিশ শতক, নারকেলবাড়িয়ার ঘাস।
আপনি শিখিয়েছেন স্বাধীনতা- আপনার নাম
ফরিদপুর, নদিয়া অথবা চব্বিশ পরগনা।
আপনার পাঁচ হাজার ফিরে এসে হয়েছে
তিরিশ লক্ষ, আপনার নামে গান গায়
বাঙলার দোয়েল আজ।।
ফরিদপুর, নদিয়া অথবা চব্বিশ পরগনা।
আপনার পাঁচ হাজার ফিরে এসে হয়েছে
তিরিশ লক্ষ, আপনার নামে গান গায়
বাঙলার দোয়েল আজ।।
আপনি দুলে উঠুন, দুলে উঠুন আবার আমাদের মাঠে কঙক্রিটে
বৈরী হাওয়ায়। পলি জমে মুছে গ্যাছে-
ভাঙ্গনের তোড়ে-
বিপন্ন হয়েছে আবার
আমাদের ঘর আমাদের গ্রাম।।
বৈরী হাওয়ায়। পলি জমে মুছে গ্যাছে-
ভাঙ্গনের তোড়ে-
বিপন্ন হয়েছে আবার
আমাদের ঘর আমাদের গ্রাম।।
তিতুমীর পরিচালিত বাঙলার ওয়াহাবি আন্দোলন ভারতের তথা
বাঙলার কৃষক আন্দোলন পলাশির পর প্রায় আশিবছর ধরে সারা বাঙলা জুড়ে স্বাধীণতা
সংগ্রামের শৃঙ্খলের অন্যতম অভূতপূর্ব ঘটনা। ততকালীন
বাঙলায় কলোনাইজেশনের প্রতিভূ আর নীল চাষের পক্ষে যে সব রেনেসাঁর নেতৃত্ব দাঁড়িয়ে
ছিলেন, তাংদের ইংরেজি শিক্ষিত মেকলের অন্ধ অনুগামীরাই এই স্বাধীণতা সংগ্রামকে
তথাকথিত হিন্দু বিরোধী স্বাধীণতা সংগ্রামরূপি বর্ণনা করে এই স্বাধীণতা সংগ্রামের
উপনিবেশ বিরোধী চরিত্রকে হনন করতে চেয়েছিলেন। নদীয়া জেলার ইতিহাসকার কুমুদনাথ মল্লিকমশাই ও ভূপেন্দ্রনাথ দত্তেরমত
মানুষও এ ধরণের মতবাদ পোষণ করতেন। পরে হিস্টোরি অব ইন্ডিয়ার লেখক থর্নটন, ,
উইলিয়ম হান্টারের ইন্ডিয়ান মুলমানস,
ওকেনলির দ্য ওয়াহবিজ ইন ইন্ডিয়ায় নতুন
করে এই স্বাধীণতা সংগ্রামের রূপকে বিশ্লষণ করেন এবং তাদের অভিমত, এক ধর্মীয়
আন্দোলনে কোম্পানি সরকারের জবরদস্তি এবং অত্যাচারকে কৃষক বিদ্রেহের রূপ প্রদান
করেছে।
তিতুমীরের নেতৃত্বে বারাসাতকে ভিত্তি করে যে আন্দোলন
শুরু হয়, তা আদতে সমগ্র ভারতবর্ষীয় এক আন্দোলনের এক অংশ। রায়বেরিলির সৈয়দ আহমেদ মক্কায় গিয়ে ছিলেন এই আন্দোলনের রূপরেখা ভারতে আনতে। মক্কায় সৈয়দ আহমদের সঙ্গে মির নিসার আলি, তিতুমীরের সঙ্গে দেখা হয়, আর
দেখা হয় ফরিদপুরের ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তক দুদুমিঞার সঙ্গে। ইসলাম ধর্মকে নতুন করে গড়ে তোলার আন্দোলনই তিতুমীরকে ওয়াহাবি আন্দোলনে
টেনে আনে। আরবের আব্দুল ওয়াহাব এই আন্দোলনের প্রবর্তক। ১৮২০ থেকে ১৮২২ সাল পর্যন্ত ভারতের নানান স্থান পরিভ্রমণ করে তিনি ওয়াহাবি
আন্দোলনের আদর্শ প্রচার করেন।
ইংরেজ শাসন আর শোষণ ব্যবস্থায় সমস্ত মুসলমানদের জনসাধারণ
আর মুসলমান চাষীর জীবন বিপর্যন্ত আর ধর্মও বিপর্যস্ত। সুতরাং সৈয়দ আহমদ ইংরেজ অধিকৃত ভারতকে শত্রুর দেশ(দারউলহারব)রূপে ঘোষণা
করেন। এই শত্রুর দেশের শাসন উচ্ছেদ করে ধর্মরাজ্য(দারউলইসলাম)
তারি করতে হবে। এর পর আরম্ভ হয় বিধর্মীদের বিরুদ্ধে
জেহাদ। পাঞ্জাবে শিখশক্তির বিরুদ্ধে আর
পেশোয়ারে মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধেও স্বাধীণতা সংগ্রাম অভিযান আরম্ভ হয়। পাটনা, বারাসাত, ফরিদপুর, আর উত্তরবঙ্গে ওয়াহবি চাষীর সংগ্রাম জমিদার আর
ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। ১৮৩১এ
পাঞ্জাবের যুদ্ধে সৈয়দ আহমদ নিহত হন। এরপর
সহকর্মীরা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকায় সিতনা থেকে ধর্মযুদ্ধ, স্বাধীণতা সংগ্রাম
চালাতে থাকে। দেশের উতপীড়িতে চাষীদের
জমিদার-মহাজনদের কবল থেকে মুক্তির জন্য মুসলমানদের আহ্বান জানানো হয়। এই সংগ্রাম বাঙলা আর বিহারে প্রসারিত হতে থাকে। বহুএলাকায় জায়গীরদার-জমিদারৃনীলকর-মহাজনদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সঙ্গেও
অমুসলমান চাষী আর সাধারণ মানুষও যোগদান করতে থাকেন। স্বাধীণতা সংগ্রামের ধর্মীয় চরিত্র ক্রমশঃ অর্থনৈতিক দাবি আদায়ে রাজনৈতিক
আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে।
ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সঙ্গে বাঙলায়ও এই
আন্দোলনের রেশ ছড়িয়ে পড়ে জেরদার গতিতে। বাঙলার
অধিকাংশ জমিদাররাই হিন্দু আর অধিকাংশ মুসলমান ফলে এই আন্দোলনকে হিন্দু বিরোধী
আন্দোলনরূপে প্রচার চালানোক উদ্যোগ দেখা যায়। তবে ওয়াহবি আন্দোলনের মূল দাবিটা ধর্মীয় ছিল ফলে জমিদারদের পক্ষে একে
হিন্দু বিরোধীরূপে প্রচার চালানো সম্ভব হলেও আদতে দেশের অধিকাংশ মানুষই নব্যজমিদার
আর ইংরেজদের অবিচারের বিরুদ্ধে থাকার ক্রমশঃ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল আন্দোলনের ধর্মীয়
কারন। হান্টার বলছেন ১৮৩১এ কলকাতার আশেপাশে শুধুই যে অমুসলমান
জমিদারদের ওপরেই আক্রমণ হয়েছিল এ তথ্য মিথ্যে শুধুনয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত,
আন্দেলনকারীরা মুসলমান জমিদারদের ওপরেও আক্রমণ করে। ওয়াহবি আন্দোলনের বিরুদ্ধে বাঙলার নানান স্বার্থান্বোষী দল এক জোট হওয়ার
কথা ব্যাখ্যা করে হান্টার বলছেন, হিন্দুই
হউক, মুসলমানই হউক, - যে কোন স্থানে যে-কোন বিত্তশালী বা কায়েমী স্বার্থ সম্পন্ন
ব্যক্তির পক্ষে ওয়াহাবিদের উপস্থিতি একটি স্থায়ী ভীতির কারন। ...যে সমস্ত
মসজিদের বা মন্দিরের পাশের কয়েক বিঘা করে ভূসম্পত্তি আছে, তাদের প্রত্যেকটি মন্দির
বা মলজিদের মোল্লা আর পুরোহিতই গত আধ শতাব্দ ধরে তারস্বরে ওয়াহবিদের বিরুদ্ধে
চিতকার করেছে। অন্যান্য এলাকার মত ভারতের ভূস্বামী
আর মোল্লা-পুরোহিত গোষ্ঠী যে কোনও রকম পরিবর্তনকেই ভয় করে। রাজনৈতিকই হোক বা ধর্মীয়ই হোক,
কায়েমিস্বার্থের পক্ষে যে কোনও বিরোধিতাই মারাত্মক। আর ওয়াহাবিরা
প্রচলিত ব্যবস্থার বিরোধী। আদতে পুলিশের
রিপের্টেও বলা হয়েছে বাঙলার ওয়াহবি আন্দোলনে বহু অমুসলমান সমাজ অংশগ্রহন করে। বিহারে এনায়েত আর উলায়েত আলির, বাঙলায় তিতুমীরের আর ফরিদপুরের শরিয়েতুল্লা
আর দুদুমিঞার নেতৃত্বে ব্যাপর আন্দোলন গড়ে তোলেন। ক্যান্টোয়েল স্মিথ মডার্ন ইসলাম ইন ইন্ডিয়াগ্রন্থে বলছেন, অর্থনৈতিক
দিকথেকে এই আন্দোলন ছিল পুরোপুরি শ্রেণীসংগ্রাম। সাম্প্রদায়িক প্রশ্নটি ধীরে ধীরে পেছনে সরে যায়।
১৭৭২এ চব্বিশ
পরগণা জেলায় বাদুড়িয়ার হায়দারপুরে মির নিশার আলি অথবা তিতুমীরের জন্ম। কৈশোরে এক জমিদারের সঙ্গে ঝগড়ায় তাঁর কারাদন্ড ঘটে। ঊনচল্লিশ বছর বয়সে মক্কায় যান, এবং সৈয়দ আহমদের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে ও
তিনি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রণ করেন। ১৮২১এ বাঙলায়
আবার তাঁর সঙ্গে সৈয়দ আহমদের মোলাকাত ঘটে মতুন করে। কলকাতায় বহু মুসলমান তার বক্তৃতা শুনে নতুন করে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ
করলে তিতুমীর সেই স্বাধীণতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেওয়ার কাজ শুরু করেন। তিতুর ডাক ছিল পয়গম্বর মানতে নেই, মন্দির মসজিদ তৈরি করতে নেই,
শ্রাদ্ধশান্তি বা ফয়তার প্রয়োজন নেই, সুদ নিতে নেই ইত্যাদি। এই ডাকে ধনী মুসলমানেরা আর মোল্লারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। অবার অন্যদিকে দলে দলে মুসলমান প্রজা তার সঙ্গে যোগদেওয়ার জন্য আকরল
প্রার্থনা করতে থাকে। বিহারীলাল সরকার বলছেন অল্প দিনের মধ্যে নারকেলবেড়িয়ার
চতুষ্পার্শ্বে দশ পনের ক্রোশ ব্যাপী ভূ-ভাগে তিতুর শক্তি প্রসারিত হইল। বাঙলার প্রজাদের মধ্যে অধিকাংশ মুসলমান বলে অধিকাংশ
অমুসলমান জমিদার আর নীলকরও এই আন্দোলন দমন করবার আয়োজন করতে থাকে। সব থেকে বড় কথা ধর্মসংস্কারের আন্দোলনে মুসলমান প্রজাদের ওপর হিন্দু
জমিদারেরা খাজনা বসাতে শুরু করলেন।
অমলেন্দু দে 'শহীদ তিতুমীর'এ বলছেন,
"ইংরেজদের
বলে বলীয়ান বিখ্যাত জমিদার রামনারায়ণ বাবু, কৃষ্ণদেব রায়, গৌরপ্রসাদ চৌধুরী, দেবনাথ রায়, প্রমুখ জমিদারগণ তিতুমীরের আন্দোলনকে
খতম করার জন্য প্রকাশ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
শুরু করেন। প্রত্যেক জমিদার তাঁর এলাকায় পাঁচটি বিষয়ে আদেশ জারি করেন। আদেশগুলো হলো, যারা তিতুমীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া দাঁড়ি রাখবে,গোঁফ ছাঁটবে, তাদের
প্রত্যেককে দাড়ির ওপর আড়াই টাকা এবং গোঁফের ওপর পাঁচসিকা খাজনা দিতে হবে। মসজিদ প্রস্তুত করলে প্রত্যেক কাঁচা
মসজিদের জন্য পাঁচশ
টাকা ও প্রত্যেক পাকা মসজিদের জন্য এক হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। গরু জবাই করলে হত্যাকারীর ডান হাত কেটে দেয়া হবে
যাতে সে ব্যক্তি আর গো-হত্যা
করতে না পারে। দাড়ি রাখা প্রত্যেক ধর্মভীরু মুলমানের অবশ্য কর্তব্য। সুতরাং জমিদাররা স্থির করলেন প্রত্যেক প্রজার কাঠ থেকে আড়াই টাকা জরিমানা
আদায়ের অর্থ বহুখাজনা আদায়।
জমিদার কৃষ্ণদেব রায় শুধু ইসলাম বিরোধী
আদেশই জারি করেনি,
সরফরাজপুরে শত শত লোক জড় করে লাঠিসোঁটা, ঢাল-তলোয়ার, সড়কিসহ শুক্রবার জুমার নামাজরত অবস্থায়
মসজিদ ঘিরে ফেলে এবং মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেদিন দু'জন মুসলমান শাহাদত
বরণ করেন, অসংখ্য মুসুল্লী আহত হন । দুঃখজনক হলেও সত্য
যে, পুলিশের দারোগা রামরাম চক্রবর্তী ঘটনার কোন তদন্ত না করেই জমিদারদের পক্ষে
মামলার রিপোর্ট দেয়, জয়েন্ট-ম্যাজিস্ট্রেট জমিদারের পক্ষে রায় দেয়। এর পর থেকে দাগি এই তিনজন মুসলমান প্রজাদের কাছে চরম শত্রু হয়ে গেলেন। জমিদার-ইংরেজ জোটের বিরুদ্ধে তিতুমীর নতুন করে আন্দোলন চালাবার সিদ্ধান্ত
নিলেন। ইতোমধ্যে ফকির মিস্কিন শাহ,
তিতুমীরের দলে যোগদান করেন। তিতুমীরের
দলের লোকবল বৃদ্ধিপেল। তিতুমীর আগামী দিনে লড়াইএর
প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন। সদস্যদের কাছ
থেকে চাল আর অন্যান্য যুদ্ধউপকরণ দান নিয়ে নারকেলবেড়েয় জমা করতে শুরু করেন। কৃষ্ণদেবের
অত্যাচারে তীতুমীর তার লোকজন নিয়ে পুঁড়ায় আক্রমণ চালান। কিন্তু জমিদারের লোকেরা তাদের আক্রমণ প্রতিহত করে। তিতুমীরদের পিছু হঠতে হয়। ফেরার সময়
পুঁড়া বাজার আর ধনী মুসনমানদের বাড়িও লুঠ হয়।
পুঁড়া আক্রমনের পর তিতুমীর ঘোষণা করলেন কোম্পানির লীলা সাঙ্গ হয়েছে, য়ুরোপিয়রা
অন্যায়ভাবে মুসলমান রাজ্য দখল করেছে। উত্তরাধীকার
সূত্রে মুসনমানই এদেশের রাজা। তিতুমীর নিজেকে
রাজা ঘোষণা করে জমিদারদের কাছ থেকে রাজস্ব দাবি করলেন। শুধু ওয়াহাবি আন্দোলনেই জমিদারি টলমল। জমিদারির সঙ্গে অনেক ইংরেজ নীলকুঠি তৈরি করতে গিয়ে বকলমে জমিদারিই তৈরি
করে ফেলছে, ইংরেজ শাসনের অবসান ঘোষণা করায় তাদেরও হৃদকম্প উঠল।
এ সময় গেবরডাঙার জমিদার ছিলেন লাটুবাবুর বন্ধু
কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়। তিতুমীরদের দমন করতে কলকাতা থেকে দুশ
হাবসি পাইক পাঠালেন আর জমিদারের নিজস্ব চারশ পাইক। কালীপ্রসন্ন খাজনা দিতে অস্বীকার করলেন। মোল্লারহাটির ডেভিস সাহেব তারও সড়কিওয়ালা আর বন্দুকবাজ নিয়ে তিতুর গ্রাম
আক্রমণ করলেন। ডেভিসবাহিনী ঢেকা মাত্রই তিতুর
বাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে আর বাহিনী ছত্রখান হয়ে যায়। ডেভিস কোনও করম প্রাণ বাঁচিয়ে পালান, যে বজরায় এসেছিলেন সে বজরা টুরে
টুকরো করে কেটে ফিলা হয়। গোবরা-গেবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ
রায় ডেভিসকে সে যাত্রায় আশ্রয় দেন। দেবনাথের
সঙ্গে তিতুর বিবাদ বাধে। তিতু দেবনাথের গ্রাম আকেরমণ করেন। লাউহাটিতে এই যুদ্ধ হয়। দেবনাথ যুদ্ধ
করতে করতে প্রাণ দেন। দুই পক্ষেরই বহু হতাহত হয়।
এরপরই তিতুমীরের নাম ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় এক হাজার যুবক তার দলে নাম লেখাতে আসে। তিতুও তাদের যুদ্ধের জন্য তৈরি করতে থাকে। তিনি এবং তাঁর
অনুসারীরা তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ধুতির বদলে 'তাহ্বান্দ' নামে এক ধরনের
বস্ত্র পরিধান শুরু করেন। নির্বেশেষে সব জমিদারের কাছ থেকেই
তিনি রাজস্ব দাবি করলেন। প্রজাদের বললেন জমিদারদের খাজনা
দেওয়া বন্ধ করেদিতে। প্রজারা তিতুর কথামত খাজনা বন্ধ করে
দেয়। নদিয়া আক চব্বিশ পরগণা জেলার বহু জমিদার এলাকা থেকে
পালাতে থাকে। দেবনাথ রায়কে তিতুর বিরুদ্ধে
প্ররোচিত যে মুসলমান জমিদারটি করেছিল তার বাড়ি ১৮৩১ সালের ১৪ অক্টোবর তিতুমীর লুঠ
করে। বাহিনী রামচন্দ্রপুর আর হুগলীর ধনী মুসলমানদের বাড়ি
লুঠ করতে থাকে। নদিয়া আক চব্বিশ পরগণা জেলার বহু
জমিদারি এলাকা থেকে পুলিশ পালিয়ে যায়। এই এলাকাহুলোয়
তিতুর শাসন ব্যবস্থা চালু হয়। এ অঞ্চলের বহু
নীলচাষী নীলচাষ বন্ধ করে দেয়। তিতুমীরের
বাহিনীর দ্রুত কলেবর বৃদ্ধিতে শঙ্কিত স্বার্থান্বেষীরা কোম্পানি সরকারের কাছে
তিতুমীরের বাহিনী দমনে সেনা বাহিনী যাচ্ঞা করেন। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে শাসক পক্ষ তিতুমীরের স্বাধীণতা সংগ্রাম দমন করতে
তোড়জোড় করতে শুরু করে।
বাঙলার গভর্ণরেরে(ছোটলাট) নির্দেশে কলকাতা থেকে এক বিশাল
সৈন্যবাহিনী যশোরের নিমক-পোক্তানে সমবেত হয়। প্রশাসন
বিষয়টিকে এতই গুরিত্বসহকারে দেখছিল যে, কলকাতার নির্দেশে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট,
আলেকজান্ডার এই সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগদান করেন। তিতুমীরের বাহিনীর সঙ্গে মহড়া নিতে ১২০জনের বন্দুকধারী সেনাবাহিনী
বাদুড়িয়ায় কুচ করে আসে। তিতুমীরও এই সংবাদে নিজ সৈন্যবহর
সাজিয়ে রাখে। নারকেলবেড়িয়া গ্রামে তিতুমীরের
ভাগনে গোলাম মাসুম তরবারি নিয়ে এই সৈন্যবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করে। সরকারি সৈন্য ছারখার হয়ে যায়, ম্যাজিস্ট্রেট কোনও ক্রমে পালাতে পারে,
দারোগা কৃষ্ণদেব চক্রবর্তীর আত্মীয়, রামরাম চক্রবর্তী গ্রেফতার হয়। তাকে হত্যাকরা হয়। এবার আশেপাশের
গ্রাম, এলাকাগুলোর নীলকরেরা সকলে কুঠী থেকে পালিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নেয়। বেশ কয়েককাল এলাকায় নীল চাষ বন্ধ থাকে।
সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তমত তিতুমীরকে বাদশাহ ঘোষণা করা হয়। এক জোলা, মৈনুদ্দিন প্রধাণমন্ত্রী আর ভাগনে প্রধাণ সেনাপতি নিযুক্ত হয়। তিতুমীর এবার আত্মরক্ষায় মনদিলেন। স্থির হল
নারকেলবেড়ে গ্রামে একটি দূর্গ তৈরি করতে হবে। এটিই ভারতের স্বাধীণতা আন্দোলনের প্রথম স্বাধীণতার লড়াই। তৈরি হল বাঁশেক কেল্লা। বিহারীলাল
তিতুমীরএ বাঁশের কেল্লারক যে বর্ণনা দেয়েছেল – কেল্লা বাঁশের হউক, - ভরতপুরের মাটির
কেল্লারমত সুন্দর, সুগঠিত, সুরক্ষিত, সুসজ্জিত না হউক, কেল্লার রচনা কৌশলময়, দৃশ্য
সৌন্দর্যময়। কেল্লার ভিতরে যথারূকি অনেক প্রকোষ্ট
রচনা হইয়াছিল। কোনও প্রকোষ্ঠ আহার্য দ্রব্য স্তরে স্তরে বিন্যস্ত ও
সজ্জিত ছিল, - কোন প্রকোষ্ঠ, সড়কি, তরবারি, বর্ষা, বাঁশের ছোটবড় লাঠি সংগৃহীত ও
সজ্জিত ছিল, - কোন প্রকোষ্ঠে স্তুপাকার বেল(কাঁচা), ও ইস্টকখন্ড সংগৃহীত হইয়াছিল। এই কেল্লার কৌশল-কায়দা তিতুর বুদ্ধি ও শিল্প চাতুর্যের পরিচায়ক। তিতুমীর ও তাহার অনুচরবর্গের দৃঢ় ধারণা হইয়াছিল, এই কেল্লা বাঁশের হইলেও
প্রস্তর নির্মিত দুর্গ অপেক্ষাও দুর্জয় ও দুর্ভেদ্য।
শুধু ইংরেজ বাহিনী দিয়ে হলনা দেখে জমিদার আর ইংরেজ সেনা
নিয়ে নারকেলবেড়িয়া আক্রমণের পরিকল্পনা হল। সাতক্ষিরা,
গেবরডাঙা, নদীয়াসহ নানান জমিদার একযোগে তিতুমীরকে আক্রমণের প্রস্তাব করেন। কোম্পানির ভারত প্রধাণ, গভর্নর জেনারেল বেন্টিঙ্কের নির্দেশে আর এক বাহিনী
হাতিসহ বহু সৈন্য নিয়ে নাকরেলবেড়িয়া অভিযান করে। জমিদারদের বরকন্দাজরাও এই সেনার সঙ্গে মিলিত হন। সেনাপতি গোলাম মাসুম বাঘারিয়ায় এক পরিত্যক্ত নীলকুঠি অধিকার করে সেখানে
সেনাবাহিনীর প্রতীক্ষা করতে থাকেন। সংবাদ
পাওয়ামাত্র কালেক্টারের নির্দেশে কোম্পানি-জমিদারজোট সেনা বাঘারিয়া আক্রমণ করে। তিতুমীরের সেনার ইট আর বেল আর অন্যপক্ষের গুলি বিনিময় হতে থাকে। আবার একবার বিহারীলালের বর্ণনায় মাসুমের
সৈন্যদল অন্তরালে অবস্থান করায়, গুলিবর্যণে তাহাদের বিশেষ ক্ষতি হয় নাই। কিন্তু জোটবাহিনীর বেশি ক্ষতি হয়। কালেক্টর
যুদ্ধ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে পিছু হটতে থাকলে মাসুমের সৈন্যেরা চারিদিক হইতে ভীষণ
বেগে তাহাদিগকে আক্রমণ করে। এই আক্রমনে সাহেবের বহুলোকের ক্ষতি
হয়, এবং একটি হস্তী ও কয়েকটি বব্দুক মাসুমের হস্তগত হয়। এই জয়ের পর তিতুর প্রভাবপ্রতিপত্তি বেশ চাউর হয়। শোনা যায় ভূষণার জমিদার মনোহর রায়ও তিতুর
দলভুক্ত হন এবং তিতুর প্রভূত সাহায্য করেন।
১৮৩১এর ১৪ নভেম্বর, দুটি কামান নিয়ে একশ বিদেশি সৈন্য ও
তিনশ দেশি সৈন্য নারকেলবেড়িয়া আক্রণের জন্য প্রস্তুত হয়। রাতেই ইংরেজ সেনার ওপর আক্রমনের নির্দেশ দিন তিতু। ইটও বেল দিয়ে আক্রমণ করে ইংরেজ সৈন্যকে অনেকটা পিছুহঠতে বাধ্য করে ওয়াহবি
সেনা। সকালে কর্নেল কেল্লার সামনে গ্রেফতারি পরওয়ানা পড়ে
কেল্লায় কামানের গোলা বর্ষণের নির্দেশ দেন। পরপর কামানের
গেলা কেল্লায় আঘাত করলে একদেকে কেল্লা হেলে গেল। দুর্গের ওপর মুহুর্মুহু গোলা বর্ষণে তিতুর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তিতুর সেনারা নানান স্থানে আশ্রয় নিলেন। সবসমেত আটশ বন্দী গ্রেফতার হয়। বহুদিন মামলা
চলার পর গোলাম মাসুমকে ফাঁসির সাজা হয়, একশ চল্লিশজনের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড
হয়।
�����?���I�F�র হয়ে এই বিফলতার কারণ খুঁজতে
গিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের সন্দেহ জমিদার দিকে পড়ে। চোয়াড় রেবেলিয়ন বইতে প্রাইস বলছেন, স্বাধীণতা
সংগ্রামীরা জানত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত লৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে পেরে ওঠার
আশা নেই। সুতরাং তারা এমন আবস্থা তৈরি করল,
জমিদার অথবা অবস্থাপন্ন পরিবারে অথবা সরকারি কর্মচারীদের কাছথেকে সেনা বাহিনী
খাওয়ার সংগ্রহ করতে না পারে। তাহলেই খাদ্যের অভাবেই সরকরি
বাহিনীকে পালাতে হবে। ফলে তারা সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক করে
দেয় যাতে সেনী বাহিনীকে কেউ খাবার দিয়ে সাহায্য না করে। স্বাধীণতা সংগ্রামীরা একে রাণী শিরোমণির নির্দেশ রূপে প্রচার করে। ফলে বহু সেনা বাহিনীকে খাদ্যের অভাবে শহরে ফিরে আসতে হয়েছে।
প্রাইস
চোয়াড়দের শৃঙ্খলবোধের কথাও শ্রদ্ধায় উল্লেখ করেছেন। আনন্দপুর গ্রাম আক্রমণকালে সর্দার মোহনলালের অপরিসীম নীতিবোধ আর নিজেদের
সেনার ওপর প্রভাব দুটিরই উদাহরণ দিয়েছেন প্রাইস। এমতঅবস্থায় প্রচুর অত্যাচারিত প্রজাও এই বিদ্রেহে স্বইচ্ছায় যোগদানও করে
সে সংবাদও কালেক্টরের লেখা থেকে পাওয়া যায়। বোর্ অব
রেভিনিউকে লেখা চিঠিতে তিনি বলছেন, সমগ্র
মেদিনীপুর জেলাটি জনমানবহীন আর ধংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।।। সংক্ষেপে বলাযায়, জঙ্গল অঞ্চলের সব জমিদারও চোয়াড়দের সঙ্গে মিলেছে। শাসকদের
সন্দেহ হয় জমিদারদের সরাসরি সাহায্য না পেলে চোয়াড়রা এতটা প্রাবল্যে আক্রমণ করতে
পারত না। রানি শিরোমণি সেই স্বাধীণতা সংগ্রামের
গোপন পরামর্শদাত্রী ছিলেন, তারা সন্দেহবশে রানী শিরোমণিসহ অনেক জমিদারকে অন্তরীণ
করে রাখে। কিন্তু কর্ণগড় অধিকার করার সঙ্গে
সঙ্গে সব সৈন্যও দুর্গত্যাগ করে পালাতে থাকে। মেদিনীপুরে আরও সৈন্য আসতে শুরু করে, ফলে মেদিনীপুরের ওপর আক্রমণের আশংকা
অনেকটা দূর হয়। কালেক্টর কিছুটা স্বস্তি পেয়ে
গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে থাকে। তার
প্রতিশ্রুতি যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের অভিযোগ বিচার করে দেখা হবে।
১৭৯৯এর জুনে
চোয়াড়-পাইকদের সঙ্গে পাশের রাজ্য মারাঠা অধিকৃত ওড়িশার পাইকরা এসে যোগ দেয়। এরপর রায়গড়, বীরভূম, শতপতি, শালবনী পরগণায় নতুন করে খন্ডযুদ্ধ শুরু হয়। বিদ্রেহ দমন করা যাচ্ছেনা দেখে রেভিনিউ বোর্ড ভুল বুঝতে পেরে চোয়াড়দের
বিষয়ে জমিদারদের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু আক্রমণ আর লুঠ নিরবিচ্ছন্নভাবে
চলতেই থাকে। সেপ্টোম্বরে শিরোমণি গ্রামে সরকার
পক্ষের আটজনকে খুন করে চোয়াড় স্বাধীণতা সংগ্রামীরা। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে মানবাজার লুঠ হয়। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বীরভূমের নানান অঞ্চলের ধনীদের বাড়ি লাল সিংএর
নেতৃত্ব লুঠ হয়। গ্রামের পর গ্রামে সরকারের
অনুপস্থিতির বহর বাড়তে থাকায় ১৮০০র জানুয়ারিতে পুরাবিত্রা আর আনন্দিনী দুটি
তালুকের চাষীরা খাজনা বন্ধকরে স্বাধীণতা সংগ্রামীদের সঙ্গে যোগ দেয়। ১৮০০র পর প্রাইসের লেখায় স্বাধীণতা সংগ্রামীদের কোনও সংবাদ পাওয়া যায় না, কিন্তু ওম্যালির রচনায়
আমরা পাচ্ছি যে এি স্বাধীণতা সংগ্রামের আগুন কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে দ্বলতে থাকে।
আশংকার ব্যাপার
হল ইংরেজদের আলোচনার প্রস্তাব। রেভিউনিউ
বোর্ডে ঠিক হয় পাইক আর চোয়াড় এবং জমিদারদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে হবে। সুপারিশ হল পাইকদের খাজনাহীন জমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে। জঙ্গলমহলে সমস্ত শান্তিরক্ষার দায় থাকবে জমিদারদের ওপর। পাইকদের নানান সুযোগসুবিধে দিতে হবে। রাজস্ব বাকি পড়লে জঙ্গলমহলে জমিদারি নীলামে উঠবেনা। মেদিনীপুরের ম্যাজিস্ট্রেট নির্দেশ দিলেন পাইকদের, করদারদের থানার কাজে
নিযুক্ত করা হবে। হাড়ি, বাগহি প্রভৃতি যে সব অনুন্নত
সম্প্রদায়ের মনে ক্ষোভ আছে তাদের তালিকাভুক্ত করতে হবে এবং নিজের সম্প্রদায়ের
সর্দারদের অধীনে রাখতে হবে। এ ছাড়াও
আলাদা পুলিশ বাহিনীও মোতায়েন করা হবে।
প্রাইস বলছেন, অনুচরদের
ওপর চোয়াড় সর্দারদের প্রভাব অসাধারণ। একজন সর্দারের অধীনে
দুই থেকে চারশ চোয়াড় থাকেন। তারা বাসকরে জঙ্গলের গভীরতম অঞ্চলে। এর নাম কেল্লা। ।।এরা কোনও দিনই জমিদার বা ভূস্বামীদের সেবা করেনি,
সর্দারের নির্দেশ এদের কাছে চরমতম নির্দেশ। সেনাবাহিনী দিয়ে জয় করতে না পেরে কৌশলে এদের অনেক ক্ষোভ
প্রশমিত করে এদের স্বাধীণতা সংগ্রাম দমন করা হয়। তবে এই স্বাধীণতা
সংগ্রামের ফলে মেদিনীপুর বা বাঁকুড়ার সীমান্ত নতুন করে সাজানো হল। বাঁকুড়া, মেদিনীপুর আর মানভূম এঞ্চল নায়ে তৈরি হল
জঙ্গলমহল জেলা। এই জঙ্গলহমলই
বাঁকুড়া জেলা। ক্রমশঃ ইংরেজদের
সুকৌশলী শাসনে সর্দাররা নিস্তেজ হয়ে পড়েন এবং বাঙলার অন্যতম প্রধাণ বিদ্রেহ
ক্রমশঃ নির্বাপিত হল।
No comments:
Post a Comment