পলাশির পর দেওয়ান রেজা খাঁর আমলেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লুন্ঠন
আর অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে শুরু করে। সে সময়
ইংরেজদের অন্যতম দামি রপ্তানি দ্রব্য ছিল রেশমি সুতো। মুর্শিদাবাদ আর বোয়ালিয়া কুঠিতে নাগাউর নামে কারিগরেরা বুড়ো আঙুলদিয়ে এই
সূক্ষ্ম সুতো বার করে আনতেন। বংশ পরম্পরায়
এই অননুকরণীয় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন এই শিল্পীরা, যদিও এঁদের শ্রমিকবলেই অর্থ বরাদ্দ
করা হত। মুর্শিদাবাদের রেসিডেন্ট হয়ে এলেন
সাইক্স। সাইক্স সমস্ত দেশি, আরমানী এমনকী
অন্যান্য ইওরোপিয় বণিকদের হঠিয়ে দিয়ে এই দুই কুঠির রেশমের ব্যবসার সমস্ত দিকগুলি
হস্তগত করে ফেললেন।
অথচ ইংরেজরা অবাধ বাণিজ্য নিয়ে সে সময় শুধু নিজের দেশেই
নয়, বিশ্ববাজারে কম হল্লাবোল করে নি। জগতশেঠদের
একচেটিয়া আর্থিক নিয়ন্ত্রণে ব্রিটিশরা যে অখুশিছিল তা আগে দেখাগিয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেরই কোন এক সাহিত্যিক বলেছিলেন, কাঁচের ঘরে বাস করলে
অন্যের ছোঁড়া ঢিল থেকে নিজের ঘর বাঁচাতে, নিয়মকরে অন্যদের ঢিল মেরে যেতে হবে,
যাতে কেউ সহজে কাঁচের ঘরে ঢিল না মারতে পারে, নইলে সর্বনাশ। ব্রিটিশ বণিকদের সাহিত্যপ্রীতি ছিল কীনা কে তর্কমুলতুবি রেখেও বলা যাক,
তারা কিন্তু তাদের সাহিত্যিকের এই নীতি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছেন নিয়মিতভাবে,
অন্তঃত সেই উপনিবেশ শাসনের সময়েও। ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানির অত্যাচার আর লুঠ অনুসরণে নতুন যুগের বিশ্বায়ণের সময়েও বহুজাতিক
কোম্পানিরাও তাঁর উপদেশ প্রসাদীফুলেরমত ট্যাঁকেগুঁজে রেখে প্রয়োগ করতে নিরন্তর
উত্সাহী।
ইংরেজদের ভাষায় ফ্রি ট্রেড অথবা মুক্ত বাণিজ্য
কথাটা শুনতে বেশ মধুর মধুর, কিন্তু বাস্তবে মুক্ত বাণিজ্য মানে নিজেদেরমত নিজেদের
নিয়মে অন্যদের দাবিয়ে আমদানি রপ্তানির বাজার দখল করা। ইংরেজরা ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিকদের প্রচারে হাজারো অসত্যকে সত্যরূপে চালানোর
যে প্রক্রিয়া চালু করেছিল তার একটি হল, তারা মির কাশেমের সঙ্গে লড়াই বাধিয়েছিল তা
নাকি আবাধ বাণিজ্য চালু করার জন্য। আসন সত্যটি
অন্য। ইংরেজরা চাইছিল তাদের বাণিজ্য অবাধ হবে, আর দেশিয়
বণিকদের বাণিজ্যনীতি হবে বিভিন্ন আইনি জটিলতায় বাঁধা। ইংরেজদের এই মুক্তবাণিজ্য নীতি প্রয়োগ করতে গিয়ে দেখল মির কাশেম কিন্তু
তাঁর শ্বশুরের থেকে অন্যধাতের মানুষ ছিলেন। তিনি ইংরেজদের
এই দুমুখো নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। যুদ্ধ হল। সে অন্যগল্প।
এই অবাধ বাণিজ্যের নাম করে সাইক্স, তার বেনিয়ান
কান্তবাবু, আর অন্যান্য সাঙ্গপাঙ্গরা শুধু বোয়ালিয়া কুঠি থেকেই বছরে ষাট লক্ষটাকা
নজরানা আদায় করতেন। সাইক্সএর আর এক বড়কর্তা ভেরলেস্ট,
মুর্শিদাবাদে আর বোয়ালিয়ায় তদন্ত করে দেখলেন কুঠির সাহেবরা কোম্পানি আর নিজের
নিজের রেশমি কারবারের জন্য শুধু একএকটা গ্রাম দখল করে নিরস্ত থাকেন নি, তারা এও
স্থির করে দেন যে, কোন কোন যায়গার বাইরে দেশি সওদাগররা রেশমি সুতো কিনতে পারবেন না। আর নিজের নিজের এলাকার গোমস্তা দালালেরা আর পাইকাররা, তুঁত ও রোশমি সুতো
কারিগরদের ওপর এমন অত্যাচার করছে যা কস্মিনকালেও কেউ দেখেনি। সরকারি আমলাদের ওপর ভীষণ জুলুম করে হুকুম জারি করা হয়েছে যে, কোম্পানির
লোক ছাড়া অন্য কাউকে রেশম কিনতে দেওয়া না হয়। এই গোমস্তারা সবার সম্পত্তি আটক করে যথেচ্ছভাবে অত্যাচার করতে শুরু করেছে,
আর যদি বা কারো কিছু কোনও মতে তাদের হাত এড়িয়ে গেছে, সেই সব খেটেখাওয়া দুখী
রায়তদের কপালে জুটেছে জরিমানা, কয়েদ আর দৈহিক সাজা। সেখানকার সন্ত্রস্ত জমিদার নিরুপায় হয়ে তাঁর জমি দিনদিন ছারখার হতে
দেখছেন, আর পীড়িত প্রজাদের রক্ষা না করতে পেরে নীরবে তাদের দুর্ভাগ্য নিয়ে বিলাপ
করছেন। রেজা খাঁ বলছেন, এইরকম জুলুমবাজি করে
তারা দেশের লোকেদের কাঙালকরে দেশ থেকে ভাগিয়েছে। এখন দেশে দামি বলতে কোনও কিছু নেই। রেজা খাঁর ভাষায় সেসময় গোমস্তাদের অত্যাচার এতই চরমে উঠেছিল যে, এও শোনা
যাচ্ছিল, তাদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে শুধু তন্তুবায়েরাই নয়, নাকাদরা তাদের
নিজেদের বুড়ো আঙুল পর্যন্ত কেটে ফেলেছে।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাঙলা জুড়ে লুঠের রাজত্ব
শুরু করে তন্তুবায়দের বস্ত্র তৈরি করার পরিকাঠামো ধংস করার পর। ব্রিটিশ কাপড়ের বাজার তৈরি করতেও তারা বাঙলার রেশম শিল্পকে ধংস করার কাজ
শুরু করে। একটা কথা মনে রাখা দরকার, বংলার সেনা
প্রতিবেদন, ট্রানজাকশনস অব মিলিটারি
এফেয়ার্স ইন বেঙ্গলএ রবার্ট ওরমে বলছেন, একজন ভারতীয় যে সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার
করে মসলিনেরমত সূক্ষ্ম বস্ত্র তৈরি করে, সেই সব যন্ত্রপাতি(তাঁত) দিয়ে একজন
ইওরোপিয় কারিগরের অনিপুণ ও অনমনীয় এঙুল একখানা মোটা চটের কাপড়ও তৈরি করতে পারবে
না। পরম বিকশিত কৃষির পাশাপাশি
বিকেন্দ্রিকৃত শিল্পই ছিল বাঙলার ধণাঢ্যতার ভিত। একে একে সেই শিল্পগুলিকে ধংস করে প্রথমে বাঙলা, পরে সমগ্র ভারতের
সমাজ-অর্থনীতির ক্রমাবনতির পথ প্রস্তুত করে দিয়ে যায় ব্রিটিশ অত্যাচার আর বিভেদ নীতি
এবং তাদের উজ্জ্বলতম সহযোগী হয়ে ওঠেন রামমোহন, দ্বারকানাথ, বিদ্যাসাগরেরমত সমাজভাঙার
কাজে অতি দক্ষ এবং ব্রিটিশের দৃষ্টি আর কৃষ্টিতে গড়ে ওঠা উজ্জ্বলতম ভারতীয়
সহকর্মীরা।
শুধু ইংলন্ডেই নয় ইওরোপের বহুদেশে বহুকাল ধরেই ভারতীয়
রেশমের বাজার বেশ চাঙ্গা ছিল। চিনের রেশমের
সঙ্গে লড়াই করে ভারতীয় রেশম বিশ্ব বাজারে নিজের স্থান করে নিয়েছিল। ফলে ইংলন্ডের অকুশলী রেশম শিল্পীরা বহুকাল ধরেই ভারতীয় রেশম আমদানির
বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তাদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। এর পর থেকে ভারতীয় রেশমের ওপর কড়া হারে শুল্ক চাপানো হয়। একের পর এক আইন তৈরি করে রুদ্ধ করা হয় ভারতীয় রেশমের বাজার। তবুও ভারতীয় রেশমজাত দ্রব্যের চাহিদা ইংলন্ডে কমে না।
১৭৬৯র ১৭ মার্চ কোম্পানির বোর্ড অব ডায়রেক্টর্স
বাঙলার রেশম বস্ত্র কেনার বদলে রোশম সুতো কেনার নির্দেশ প্রদান করেন। শুধু এই নির্দেশ দিয়েই তারা খান্ত হয়নি, তারা ভারতের কর্মচারীদের নির্দেশ
দিলেন যেসব ভারতীয় রেশম বয়ন শিল্পী নিজের বাড়িতে বসে রেশম বস্ত্র তৈরি করে তাদের
কুঠি বা আড়ংএ আনিয়ে বস্ত্র বোনার ব্যবস্থা করতে হবে। কোম্পানি জানত শিল্পীরা এই শর্তে রাজি হবেন না। তাই তাঁদের কর্মচারীদের বলা হল, এই কাজ করতে যাতে শিল্পীরা বাধ্য হয়, তার
জন্য তাদের রাজনৈতিক, আর্থিক এবং সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহ বলছেন, বোর্ড অব ডায়রেক্টর্স একটি চিঠিতে
পার্লামেন্টের সিলেক্ট কমিটিকে জানায়, বিশেষভাবে
যে সমস্ত রেশমসুতো উত্পাদনকারী নিজের বাড়িতে স্বাধীনভাবে কাজ করে তাদের আমাদের
ফ্যাক্টরিতে আনার ব্যাপারে এই নির্দেশটি বিশেষভাবে কাজ দিয়েছে। যদি বর্তমানের বাড়িতে বসে কাজের নিয়ম আমাদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে এবং
যারা আমাদের নতুন নিয়ম লঙ্ঘন করবে তাদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে। এর উত্তরে সিলেক্ট কমিটি উত্সাহিত হয়ে লেখে, কোম্পানির এই নিয়ম বাঙলায় রেশম বস্ত্রের উত্পাদনকারীদের কঠোর হাতে দমন
করার জন্য নিখুঁত পরিকল্পনা। এই নীতি অবশ্যই কার্যকর করতে হবে,
যাতে বাঙলায় রেশম উত্পাদন ব্যবস্থা চিরকালের জন্য ধংস হয়ে যায়। যাতে শিল্পোন্নত দেশটির(বাঙলাদেশের) অবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটে এবং এই দেশটি গ্রেট ব্রিটেনের
শিল্পেত্পাদনের চাহিদা অনুযায়ী কাঁচামাল সরবরাহ ক্ষেত্রে পরিণত হয়, সেই ভাবেই এই
নীতি কার্যকরী করে তেলা অবশ্যই প্রয়োজন।
পার্লামেন্টের নির্দেশিত অবশ্য কর্তব্য এই কাজটি ইস্ট
ইন্ডিয়া কোম্পানি সুচারু রূপে সম্পাদন করেছে, ইতিহাস তার প্রমাণ। কোম্পানির আমলে বাঙলায় রেশম শিল্প ধংস হয়ে যায় এবং বাঙলাদেশকে ব্রিটেনের
রেশম শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ করার কলোনি হিসেবে গড়ে তোলা হয়। এই ধংস কাজের আগে ইতোমধ্যে বাঙলার রেশম বিদেশে পাঠিয়ে বহু অর্থ আর্জন
করেছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কোম্পানির
হর্তাকর্তাবিধাতারা দেখল বাঙলার রেশম স্পেন অথবা ইতালির রেশমের তুলনায় অনেকগুণে
আকর্ষণীয় এবং শস্তা। তাই বাঙলার রেশমের ইওরোপে একচেটিয়া
ব্যবসার সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাই খোলাবাজার
অর্থনীতির ব্যাপারীরা কোম্পানিকে দিয়ে বাঙলার রেশম শিল্প ধংস করে রেশমসুতো
আমদানির বড় পরিকল্পনা করে। কুমারখালিতে
কয়েকজন ইংলন্ডের রেশম ব্যবসায়ী এবং ইতালির রেশম ব্যবসায়ীকে পাঠানো হয় রেশম চাষ
শিখে আসার জন্য। এরপর থেকে কাশিমবাজার, জঙ্গিপুর,
কুমারখালি, মালদহ, রাধানগর, রাঙামাটি, বীরভূমের গুণাতিয়ায় রেশম উত্পাদনের বড়
কেন্দ্র স্থাপন করে। এই সব কেন্দ্র থেকে ইংলন্ডে ৭২০০০মন
রেশন সুতো ইংলন্ডে রপ্তানি করা হত।
রেশম চাষী আর রেশম শ্রমিক দুই ভাগে বিভক্ত –
চাষার আর নাগাউর। জমিদারদের কাছ থেকে
জমি ইজারাতে নিয়ে চাষারেরা তুঁত গাছে গুটিপোকা পালন করেন। এই গুটি পোকা থেকই রেশম সুতো বের হয়। রেশম গুটি তৈরি হওয়ামাত্র পাইকারেরা চাষাদের কাছথেকে
কিনে নিয়ে নাগাউরদের কাছে নিয়ে যায়। নাগাউররা এই রেশম গুটি থেকে সুতো বার করে তার পেটি
বেঁধে নেয়। ইংরেজদের সরাসরি
সহায়তায় পাইকাররা তাদের নিজেদের দামে রেশমগুটি বিক্রি করতে চাষারদের বাধ্য করত। পরে তারা সেই রেশমগুটি রেশম সুতোর ব্যবসায়ীদের হাতে
বিক্রয় করে প্রচুর মুনাফা করত। নাগাউরদের অবস্থাও ছিন চাষারদেরমত শোচনীয়। রেশমগুটি থেকে কমকরে দু ছটাক সুতো বার করতে প্রত্যহ
তাদের একআনা তিনপাই পারিশ্রমিক দেওয়া হত। কোম্পানির কারখানায় একমন রেশম সুতোর জন্য মজুরি দেওয়া
হত সের প্রতি ছ আনা সাড়ে ছ পাই। একজন নাগাউর একমাসে কোনওভাবেই বারোআনা তিনপাইএর বেশি
রোজগার করতে পারত না। এ ছাড়া কোম্পানির
চাহিদামত সুতো সরবরাহ করতে না পারলে শারীরিকভাবে নিগ্রহ করা হত। বোল্ট বলছেন, লর্জ
ক্লাইভের দ্বিতীয়বারের শাসন কালে কাঁচা রেশম উত্পাদনে কোম্পানির অতি উত্সাহে
নাগাউরদের ওপর যে অত্যাচার নেমে এসেছিল তাতে মানবসমাজের পবিত্রতম অনুশাসনগুলোও
লঙ্ঘন করা হত। নাগাউরেরা সুতো কাটার সময় সুতো বার করে, বুড়ো আঙুলে
জড়িয়ে রাখত। বোল্ট আরও বলছেন
মসলিন তন্তুবায়দেরমত নারাউরেরাও ব্রিটিশ অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে নিজেদের বুড়ো
আঙুল কেটে ফেলত। নাগাউরদের সঙ্গে
মিলে, বহু চাষার তাদের পরম যত্লে লাগান তুলত গাছ কেটে ফেলে সন্ন্যাসী বিদ্রোহে
যোগদান করে।
No comments:
Post a Comment