দিপা মেহতার ফায়ার চলচ্চিত্রে রাধাকে আদর করতে করতে প্রেমিকা
সীতা আক্ষেপে বলছে, আমরা যে কাজটি করছি, সেই কাজটির শব্দ আমাদের ভারতীয় ভাষায় পাইনি।
ঐতিহাসিক বিনীতা রুথ প্রশ্ন করছেন, কোন ভাষার কথা দিপা উল্লেখ করছেন! বাংলা,
উর্দু, গুরমুখী না তামিল না অন্য ভারতীয় ভাষা? সিনেমায় দীপার চরিত্র দুটি ইংরেজিতে
কথা বলে। যদিও ২৫০ বছর ভারত ইংরেজি বলছে, তবুও তার পকড় শহরের গণ্ডী ছাড়ায়নি। আজও
গ্রামে ইংরেজি শহুরে বিদেশী ভাষা। গ্রামীণেরা রুখে দিতে পেরেছেন ইংরেজির অগ্রগতি। দুর্ভাগ্য ভারতের ইংরেজি মাধ্যমে বেড়ে ওঠাদের
চিন্তা প্রায় দীপারই মত।
রুথ আরও একটা উদাহরণ দিচ্ছেন, ক্লদ সামারসএর
ইন্টারন্যাশনাল লেসবিয়ান অ্যান্ড গে লিটারেরি হেরিটেজএ শুধু আধটি পাতা বরাদ্দ করচ্ছেন
ভারতীয় ভিন্ন ভাষায় সম যৌনতার, তৃতীয় লিঙ্গের উদাহরনে আর দু পাতারও বেশী ব্যয়
করছেন ভারতের ইংরেজি লেখা থেকে উদাহরণ তুলতে। সামারসএরমতো ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন
গবেষক মস্ত মস্ত কেতাব লিখে জানিয়ে দিয়েছেন এই অঞ্চলের সাম্প্রতিক ইংরেজি সাহিত্যে
একমাত্র এ ধরণের মানুষদের দেখা যাচ্ছে। এর আগে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রাচীন
সাহিত্যে, ইতিহাসে এধরনের ঐতিহ্য ছিলনা। সামারস কাণ্ড কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
ঔপনিবেশিক সময় থেকে গড়ে ওঠা এ অঞ্চলের নারী আন্দোলনের ইতিহাসও এ ভাবনা
পোষণ করে। নারী আন্দোলনের ভিত্তিভূমিই এই তত্ব, নারী কতটা দুর্বল, অত্যাচারিত,
অবদমিত। নারী আন্দোলন বলে, শুধু নারীরা নয়, পুরুষ বাদে সব ধরণের মানুষ, যৌনতা,
আচার-আচরন এ অঞ্চলে অবদমিত। সীতার তত্ব(এ অঞ্চলে সমলিঙ্গে ভালবাসার শব্দের অভাব)
আদতে ভারতীয় ঐতিহ্যকে পশ্চিমি দৃষ্টিতে দেখার ফল। বিনীতা রুথ এবং সালিম কিদওয়াই
ভারতীয় অতীত এবং সমকালীন ঐতিহ্য খুঁড়ে তুলে নিয়ে আসেন নতুন এক দৃষ্টি, পুরনো সব
তথ্য নতুন আলোকে।
রক্ষণশীল ভারতের বিতর্কে নেমে আমরা অর্ধনারীশ্বরের
উদাহরণ ভুলে যাই। ভুলে যাই উর্দু গজলে সম যৌনতার মসনউভির গর্বিত ঐতিহ্য। এর জন্য
গভীরে উর্দুও জানতে হয় না, সংস্কৃত জানতে হয়না, পুরাণও জানার প্রয়োজন নেই – শুধু
জীবনের প্রতি, আশেপাশের সবকিছুর দিকে নজর দিলেই অনুভব করা যায়। অর্ধনারীশ্বরে
ঈশ্বর অর্ধেক পুরুষ অর্ধেক নারী। গজলে পুরুষ কবিরা যে সাকির আরাধনা করেন তারা
বালক। বাউলেও বলেছে নিতাইও অধেক পুরুষ, অধেক নারী। একই ভাবে হরিহরএর ধারনা গড়ে
উঠেছে ভারতীয় সাহিত্যে। ভগবৎ পুরাণে, বিষ্ণু মোহিনী রূপ ধারন করে দৈত্যদের অমৃত
পান থেকে বঞ্চিত করেন। শিব মোহিনীর প্রতি আকর্ষিত হন। তাদের একটি সন্তান জন্মায়।
তাঁর নাম আয়াপ্পা। পরে শিব আবার নতুন করে বিষ্ণুকে মোহিনী রূপ ধারন করতে অনুরোধ
করেন। তাঁর ইচ্ছে তিনি নিজের চোখে এই রূপপরিবর্তনটি দেখবেন। এই গল্পতে যদিও
বিপরীতগামিতার কথা পাচ্ছি, আসলে এটি সমকামিতার অন্য রূপ। পুরাণে বলা হচ্ছে
ব্রহ্মাণ্ডে শিবের যৌন কামনা জাগাতে পারেন একমাত্র বিষ্ণু। তাই থেকে হরিহরএর
ধারনার জন্ম।
আয়াপ্পা জন্মের গল্পে পাচ্ছি মোহিনীরুপী বিষ্ণুর দ্বারা
শিব উত্তেজিত হলে শিব এবং মোহিনীর ঔরসে যে সন্তান জন্মায় তিনিই দেব আয়াপ্পা। মোহিনীকে
আলিঙ্গন করার সময় কামোত্তেজিত শিবের বীর্য স্খলন হয়। সেই বীর্য থেকে আয়াপ্পার জন্ম।
এই গল্পেরই অন্য একটি স্থানীয়(দক্ষিণ ভারতীয়) সংস্করণে পাই, পাণ্ড্য রাজা রাজশেখর
সেই শিশুকে দত্তক গ্রহণ করেন। সেই গল্পে আয়াপ্পাকে অযোনি জাত বলা হচ্ছে। অর্থাৎ
যিনি যোনিদ্বারা জন্মগ্রহণ করেন নি। হরিহর পুত্র আয়াপ্পা, অপূর্ব বীরে রূপান্তরিত
হলেন।
তামিল মহাভারতে বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণ দৈত্যদের ভোলাতে
মোহিনী রূপ ধারন করেন। কৃষ্ণ বার মোহিনীরূপে ইরাবন(ইরাবন = ইরাবন্ত = আরাবন,
মহাভারতের চরিত্র। অর্জুন নাগ রাজকন্যা উলুপির সন্তান। তিনি তামিল সমাজ
কুট্টানটাবর(Kuttantavar)এর প্রধান আরাধ্য দেবতা। এবং ভারতের বিশাল দ্রৌপদি (আরাবানের
বিমাতা, অর্জুনের অন্য স্ত্রী) সমাজের(কাল্ট) অন্যতম অন্যতম প্রধান চরিত্র। দক্ষিণ
ভারতে ইরাবন, আরাবন নামে গ্রাম দেবতারুপে পুজিত হন। তিনি হিজড়া(দক্ষিণ ভারতে আলি
সমাজ) সম্প্রদায়ের দেবতা। মহাভারতে ১৮ দিনের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নিহত হন। অন্য
এক বিশ্বাসে বলা হয় কুরুক্ষেত্রে পাণ্ডবদের বিজয়ের জন্য আরাবন, দেবী কালির সামনে
আত্মাহুতি দেন)কে বিবাহ করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আরাবানের মৃত্যুর পর কৃষ্ণ
মোহিনীরূপে দুঃখ প্রকাশ করেন। আরাবানের বিবাহ আর মৃত্যুকে দক্ষিণ ভারতের হিজরারা তালি(thali) উতসবের মাধ্যমে পালন করেন। ১৮
দিনের এই উতসব শেষ হয় হিজড়াদের বুক চাপড়ানি, আচার নৃত্য, চুড়ি ভাঙ্গা এবং সাদা
কাপড় পরে আরাবানের সমাধির দেয়নের মাধ্যমে।
শুধু দেবতাই নয়, যৌন রূপান্তর, বিপরীত সাজ আর ক্লিবলিঙ্গ
আর বৃহন্নলাদের উদাহরণ পাই প্রখ্যাত পৌরাণিক চরিত্রগুলোর মধ্যে। মহাভারতের
শিখণ্ডী। পাঞ্চাল রাজ দ্রুপদ-কন্যা।
শিখণ্ডিনী নামে স্ত্রীরূপে তাঁর জন্ম। পূর্বজন্মে শিখণ্ডীর নাম ছিল অম্বা। ভীষ্মকে
না পেয়ে বহু কঠোর আরাধনা করে অম্বা ভীষ্মের মৃত্যুর কারন হিসেবে নিজের পরজন্মকে বেছে
নেন। তিনি দ্রুপদ রাজের বংশে জন্মান শিখণ্ডীরূপে। দৈববাণী শুনে দ্রুপদ রাজ শিখণ্ডীকে
পুরুষরূপে প্রতিপালন করতে থাকেন। বিয়ের রাতে তাঁর স্ত্রী তাঁকে মহিলারূপে আবিষ্কার
করে লাঞ্ছনা করেলে, তিনি জঙ্গলে পালিয়ে যান। জঙ্গলে এক যক্ষ শিখণ্ডীর সঙ্গে লিঙ্গ
পরিবর্তন করেন। শিখণ্ডী ফিরে এসে, বৌ, সন্তান নিয়ে সুখী বিবাহিত জীবন যাপন করেন। কুরুক্ষেত্রর
যুদ্ধে ভীষ্ম শিখণ্ডীকে পূর্ব জন্মের অম্বা হিসেবে চিনতে পারেন। কোনও মহিলার সঙ্গে
তিনি যুদ্ধ করেন না, এই ধর্ম-প্রতিজ্ঞায় ভীষ্ম অস্ত্র নামিয়ে রাখলেন। অর্জুনের
বাণে নিহত হয়ে ইচ্ছা মৃত্যু বরণ করেন। জাভা গল্পে শ্রীখণ্ডী (শিখণ্ডীর সে দেশের
নাম) পুরুষ নন। মহিলা। কিন্তু চরিত্রে পুরুষের সমান। অর্জুনের স্ত্রী। শিখণ্ডীর
মৃত্যুর পর তার পুরুষত্ব যক্ষের দেহে ফিরে যায়।
উর্বশীর শাপে অর্জুন এক বছর ক্লিব লিঙ্গ ধারন করবেন। এক
বছরের অজ্ঞাতবাসে লুকিয়ে থাকার সময় এই অভিশাপ বর হয়ে ওঠে। মতস্য রাজ বিরাটের
রাজত্বে বৃহন্নলা নামে, মহিলা সাজেন অর্জুন। তাঁর সুদৃঢ় লোমশ হাতে বিরাট রাজার
কন্যা উত্তরাকে নৃত্য গীত, বাদন শেখান। অর্জুন যখন মতস্যরাজ বিরাটের (একমাত্র
মতস্য বংশীয় রাজা যিনি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পাণ্ডবদের পক্ষ গ্রহণ করেন, অন্য মতস্য
রাজা কৌরব পক্ষে সামিল হন) সামনে উপস্থিত হন, তখন রাজা ভাবতেই পারেননি যে তাঁর
সামনে যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি অর্ধনারী। তাঁর জীবনে তিনি এমন কোনও মানুষকে তিনি
দেখেন নি, যিনি সুগঠিত কিন্তু চরিত্রে প্রকৃতি(নারী)সম্ভবা। তাঁর হাত দর্শনে বিরাটরাজ
আন্দাজ করলেন অর্জুন অবশ্যই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধনুর্ধর হবেন। উত্তরে অর্জুন বললেন,
যে তন্ত্রটি তিনি বাজাতে পারেন, সেটি বীণার তার। তাঁর দক্ষতা পরখ করার পর অর্জুনকে
বিরাট রাজের নানান সংস্কৃতি পটীয়সী মহিলাদের সামনে আবারও সংস্কৃতির এবং নতুন করে যৌনতারও
পরীক্ষা দিতে হল। নিজের নাম বললেন বৃহন্নলা। ভারতীয় প্রথা অনুযায়ী তিনি যদি শুধুই
নপুংশক হতেন তাহলে তার অণ্ডকোষ পরীক্ষা করত পুরুষেরা, মহিলারা নন। কন্যা উত্তরাকে
বিরাট রাজ অর্জুনের প্রশংসা করে তাঁকে রানীর মর্যাদা দিয়ে অন্তঃপুরে রাখার নির্দেশ
দেন। বিরাট রাজ বৃহন্নলাকে প্রকৃতি(স্ত্রী)রূপেই দেখছেন। তিনি বৃহন্নলাকে উপহাস
করেন নি। বা পুরুষের পরিধেয় পরার নির্দেশও দেননি। অর্জুনকেকে তাঁর প্রকৃতি অনুযায়ী
রাজবংশে গ্রহণ করেছেন। পদ্মাপুরানে অর্জুন
মহিলাতে রুপান্তরিত হয়ে, কৃষ্ণের সখীদের সঙ্গে নৃত্য করেন।
ইলা। বৈবস্বত মনু আর শ্রাদ্ধার একাধারে ছেলে এবং মেয়ে
উভয়েই। ইলা চন্দ্র বা সোমবংশের প্রতিষ্ঠাতা। ইলার ভাই ইক্ষাকু(সৌর বা অর্ক বংশের
প্রতিষ্ঠাতা), সূর্যের নাতি। রামায়নে, লিঙ্গ পুরাণে ইলা বহ্লিক (পামির/হিন্দুকুশ
এলাকা – উত্তর আফগানিস্তান, আমুদরিয়ার কাছে) রাজা হন। তিনি শিকারে গেলে বিশেষ
কারনে শিব তাঁকে অভশাপ দেন। পার্বতী সদয় হলে তিনি এক মাস পুরুষ এক মাস স্ত্রীবেশে
রূপান্তরিত হতে পারতেন। পুরুষ বেশে তিনি
সুদ্যুম্ন আর স্ত্রী বেশে তিনি ইলা। ইলার বুধের সঙ্গে বিবাহ হয়। সন্তানের
নাম হয় পুরুরভ(চান্দ্র বংশের প্রথম রাজা)। পুরুরভর জন্মের পর তিনি পুরুষ দেহ ধারন
করে তিন সন্তানের পিতা হন।
দেবতাদের মধ্যে সমযৌনতা খুব একটা অপ্রচলিত নয়। যদিও অনেক
সময় এগুলি সঙ্গমের চিত্র বহন করে না, বরং আচারে প্রকাশ পায়। অগ্নি অন্য দেবতার
বীর্য গ্রহণ করেন। যদিও তিনি স্বাহার স্বামী, কিন্তু সোমের(চাঁদ) সঙ্গে রমন করেন,
কেননা তিনি মুখ দিয়ে পৃথিবীর উৎসর্গ স্বর্গে বসে পান করেন। হিন্দু শাস্ত্র বলে এটি
আসলে মিথুন ভঙ্গিমা, যেখানে অগ্নির মুখ যোনির কাজ করে। রামায়ণ আর শৈব পুরাণে যখন
পার্বতী আর শিব উপগত হন, তখন দেবতাদের আশঙ্কা হল এই অনন্ত কাল ধরে চলা সঙ্গমে
বিশ্বে প্রলয় আসন্ন। এবং তাঁরা বিশ্ব পিতামাতার মিলনে বাধা দান করে। উচ্ছ্রিতদণ্ড
রাগান্বিত শিব স্বর্গে উপগত তাঁর অস্খলিত বীর্য কোনও দেবতাকে ধারন করার নির্দেশ
দিলে, অগ্নি সেই বীর্য ধারন করে পান করেন। তবে কথাসারিতসাগরে বলা হয়েছে শিব
অগ্নিকে এটি পান করতে বাধ্য করেন। বেদে মিত্রা আর বরুনের বহু অন্তরঙ্গতার গল্প
রয়েছে। ভগবৎ পুরাণে এদের দুজনের এক অযোনিসম্ভূত সন্তানের কথা বলা হয়েছে। বরুনের
বীর্য বল্মীক স্তুপের ওপর পড়লে বাল্মীকির জন্ম হয়। উর্বশীকে দেখে মিতা এবং বরুণ
বীর্য স্খলন করে জলে পড়লে অগস্থ্য আর বশিষ্ঠর জন্ম হয়।
বাঙলায় কৃত্তিবাস রামায়নে সূর্য বংশের অন্যতম প্রধান
রাজা দিলীপের মৃত্যু হলে শিব দুই বিধবা রানিকে পরস্পরের সঙ্গে উপগত হওয়ার নির্দেশ
দেন। একটি হাড় হীন শিশুর জন্ম হয়। পরে অষ্টাবক্র মুনির বরে শিশুটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ
হয়ে ওঠেন। নাম হয় ভগীরথ – যে দুটি ভাগে জন্মেছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মে রাধা
অনুগামিরা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ত্রয়োদশ শতকের কাশ্মীরী পুঁথি,
জয়দ্রথের হরচরিতাচিন্তামনিতে, পার্বতীর মাসিক নিঃসরন গঙ্গায় ধুতে ধুতে সেই জল
পার্বতীর হাতি মাথা সহচরী মালিনী গলার্ধকরণ করেন এবং মালিনীর ঔরসে হাতিমাথা গনেশের
জন্ম হয়। অর্থাৎ গনেশের জন্ম পুরটাই মহিলা সংসর্গে। শৈব পুরাণে বলা হয়েছে পার্বতী
স্নান করতে গেলে মাটির গনেশকে পাহারায় বসিয়ে যান যাতে কেউ না এসে পড়ে। শিব আসলে মাটির
গনেশ বাধা দেয়। শিব তাঁর মাথা কাটে। পরে জুড়ে দেয়।
কথাসারিতসাগরে এক মহিলা অন্য মহিলাকে সম্বোধন করছেন
স্বয়ম্বর সখি। আমরা জানি স্বয়ম্বর মানে শুধুই দুটি লিঙ্গের বিয়ে নয়, নিজে নিজের
প্রেমাস্পদকে বেছে নেওয়ার অধিকার।
ভারতীয় শাস্ত্রে প্রায়শঃ তৃতীয় লিঙ্গে(প্রকৃতি)র উল্লেখ
পাই। নারদ স্মৃতি, বা সুশ্রুত সংহিতায় মহিলা চরিত্রের পুরুষ বা পুরুষ চরিত্রের
মহিলার উল্লেখ পাই। সমকামী পুরুষকে মহিলা চরিত্রের পুরুষ বলা হয়েছে। কামসুত্রে
সরাসরি বলা হয়েছে, ক্লীবলিঙ্গের মানুষের দ্বৈত সত্তা থাকে। ভারতীয় সমাজে তৃতীয়
লিঙ্গের অবস্থান রয়েছে নিজেদের মত করে। ভারতে হিজড়া, আলি, কোটি – নানান ধরণের সমাজ
রয়েছে, নিজেদের পঞ্চায়েত রয়েছে। ভারতের সমাজে দুটি পুরুষের মধ্যে যৌনতাকে মিলন বা
সঙ্গম হিসেবে দেখা হয় না।
আমরা যেন মনে রাখি, কোম্পানি আমলে আইন করে তৃতীয় লিঙ্গকে
বিনাশ করার চেষ্টা হয়। আমরা দেখেছি অস্কার ওয়াইলড জেলে গিয়েছেন। বরং যাকে আমরা
রক্ষণশীল ভারত বলে দেগে দিয়েছি, সেই ভারতে হিজড়েরা নিজেদের মত করে সামাজিক সম্মান
লাভ করতেন। আজও করেন। শিশু জন্মালে এদের আশীর্বাদ অবশ্যই প্রার্থনীয়। হাজার হাজার
বছর ধরে ভারতীয় সমাজে তৃতীয় প্রকৃতি নিজেদের মত করে অবস্থান করত। অন্ততঃ ভাজপা, বামপন্থী
আমল ছাড়া হাজার হাজার বছর ধরে হিজড়া বা সমকামিদের নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে নি।
রুথ বিনীতা লাভ রাইটসে স্পষ্ট বলছেন বর্তমান কালে হাজারো
সমলিঙ্গে বিয়ের উদাহরণ। গ্রামে দুই মহিলার বিয়ে বন্ধ করতে পুলিস এলে স্থানীয় এক
মহিলা বলেন বিয়ে হল দুটি হৃদয়ের মিলন। কে বলেছে দুটি আলাদা লিঙ্গ হতে হবে? নিউ
আমেরিকা মিডিয়া, নিউজ ফিচারে, সন্দীপ রায় লিখছেন, ব্রাহ্মণদের মধ্যে সমলিঙ্গে
বিবাহের কথা। ব্রাহ্মণদের মধ্যে কেউ এই বিবাহে নিদান দিচ্ছেন পূর্বজন্মে এটি ঠিক
করা ছিল, কেউ বলছেন শুধুই দুটি চিত্তের মিলনের কথা। ভারতীয় ধর্ম শাস্ত্রে তৃতীয়
প্রকৃতিকে শাস্তি দেওয়ার বিধান নেই। পুরুষের দেহে নারী প্রকৃতি বা উলটো ধরণের
মানুষদের জোর করে বিবাহ দেওয়া হত না (তৃতীয় প্রকৃতিঃ পিপল অব থে থার্ড সেক্সঃ
আন্ডারসট্যান্দিং হোমোসেক্সুয়ালিটি – অমর দাস উইলহেম)।
আরও কিছু ছড়ানো ছিটনো চিন্তা
বেদ অনুযায়ী সূর্য, জুপিটার, মঙ্গল পুরুষ, চন্দ্র, ভেনাস
আর রাহু প্রকৃতি এবং মারকারি, শনি আর কেতু তৃতীয় বা লিঙ্গহীন নপুংশক(যৌনতারহিত,
কিন্তু পুরুষ আর প্রকৃতি(নারী) এই দুই চরিত্র বিশিষ্ট) গ্রহ। শিশুদের যতদিন যৌনতা
বোধ না জাগছে অথবা বয়ঃসন্ধিকালে না পৌঁছচ্ছে ততদিন তাদের নিয়ন্ত্রন করবেন মারকারি।
সুশ্রুত সংহিতায় পাঁচ প্রকার ক্লীবের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে ১) অসেক্য – যিনি পুরুষের
বীর্য পান করে উত্তেজিত হন। ২) সৌগন্ধিকা – যিনি অপরের লিঙ্গের ঘ্রানে উত্তেজিত
হন। ৩) কুম্ভিকা – যিনি পায়ু সঙ্গমে নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ৪) ইরশ্যকা –
অন্যদের যৌন ক্রীড়া করতে দেখে ঈর্ষায় যৌন উত্তেজনা বোধ করেন। ৫) শন্ধা – যার
প্রকৃতি(নারী)র মত চরিত্র। প্রথম চার প্রকার ক্লীব পুরুষের বীর্য পান করে যৌন
উত্তেজনা বোধ করে। শব্দকল্পদ্রুমে শন্ধার ২০টি আলাদা প্রকার উল্লেখ করা হয়েছে।
সুশ্রুত এবং চরক সংহিতাতে লিঙ্গ জন্মের ১০টি কারন বর্ণনা করা হয়েছে - ১) সুকর্ম, ২) কাম, ৩) সংস্কার, ৪) বিকর্ম,
৫) শুক্রবালা, ৬) মিথুনবিধি, ৭) পৌরুষ, ৮) দোষ, ৯) প্রকৃতি, ১০) দৈব।
এর পরে অন্য কোনও প্রবন্ধে ব্রিটেন এবং ভারতের ঔপনিবেশিক
আমলে এনাদের অবস্থা খুঁজে দেখা যাবে। তত দিনে আমরা আবারও নিজেরা নিজেদের মধ্যে
ঢুকে নিজেদের দেখার চেষ্টা করি।
No comments:
Post a Comment