হান্টারের লেখা শুধু নয় সমকালীন নানান সাক্ষ্য থেকে সাঁওতাল স্বাধীণতা সংগ্রামের তীব্রতা সম্পর্কে
জানা যায়। ডবি্লউ ডবি্লউ হান্টার জানাচ্ছেন, ৩০ জুন তারিখের সমাবেশ থেকেই সমতল ক্ষেত্রের ওপর দিয়ে কলকাতা অভিমুখে অভিযানের সিদ্ধান্ত
ঘোষণা করা হয় এবং ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন কলকাতার দিকে এই বিরাট অভিযান শুরু হয়। তিনি বলছেন, ‘এই অভিযানে কেবলমাত্র নেতৃবৃন্দের
দেহরক্ষীর বাহিনীর
সংখ্যাই ছিল প্রায় ত্রিশ হাজার। এই স্বাধীণতা সংগ্রামী বাহিনী থেকে তখন আক্রমণ চালানো হয় মহাজন ও ব্রিটিশ
প্রশাসনের সাথে যুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তিদের ওপর। স্বাধীণতা সংগ্রামীরা যখন পাঁচক্ষেতিয়া বাজারে মহাজনদের ওপর
আক্রমণ পরিচালনার প্রস্তুতি
নিচ্ছিলেন তখন দিঘী থানার দারোগা মহেশলাল দত্ত তার বাহিনী নিয়ে সিদো, কানুসহ আরও অনেক সাঁওতাল নেতাকে গ্রেপ্তার করার জন্য
পাঁচক্ষেতিয়ার বাজারে
আসেন। দারোগা
তার উদ্দেশ্য গোপন করলেও স্বাধীণতা সংগ্রামীদের তা বুঝতে বাকী থাকে না।’
দারোগা তার বাহিনীকে সিদো ও কানুকে
গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু দারোগার কথা শেষ হতে না হতেই সমবেত
সাঁওতালরা দারেগা ও তার অনুচরদে বেঁধে ফেলে। সাঁওতাল স্বাধীণতা সংগ্রামীরা সেখানেই দারোগা ও তার বাহিনীর
বিচার করে। বিচারে সাঁওতাল স্বাধীণতা সংগ্রামের নায়ক নিজ হাতে নিপীড়ক দারোগাকে
হত্যা করেন। এ ছাড়া আরও জ জন পুলিশ সদস্যদের সাঁওতাল স্বাধীণতা সংগ্রামীরা হত্যা করেন। এ ঘটনার পর থেকেই মূলত সাঁওতাল হুলের শুরু ও বিস্তার ঘটে। একের পর এক শোষক মহাজনদের হত্যা করতে থাকেন তাঁরা। সে সময় তাঁদের স্লোগান ছিল, ‘রাজা মহারাজা খতম করো! দিকুদের (বাঙালি মহাজনদের) গঙ্গা পার করে দাও!
নিজেদের হাতে শাসন নাও!’
এ ঘটনায় ইংরেজ প্রশাসন বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে
পড়ে। ১৮৫৫
সালে ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকায় একজন ইংরেজ লেখক শঙ্কিত হয়ে
লিখেছিলেন, ‘এ ধরনের আর কোনও অদ্ভুত ঘটনা ইংরেজদের স্মরণকালের মধ্যে দক্ষিণবঙ্গের সমৃদ্ধিকে
বিপদগ্রস্ত করতে পারেনি।’ ভাগলপুরের কমিশনারও প্রথমে ব্যাপক
স্বাধীণতা সংগ্রামের সংবাদ পেয়ে বিশ্বাস করতে পারেননি। স্বাধীণতা সংগ্রামীরা ভাগলপুরের দিকে
আসছে শুনে ভাগলপুরের কমিশনার আতঙ্কিত হয়ে সে অঞ্চলের সামরিক অধিনায়ক মেজর বারোজকে তার
সৈন্যদলসহ অবিলম্বে
রাজমহল পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে স্বাধীণতা সংগ্রামীদের বাধা দেওয়ার নির্দেশ দেন। মেজর বারোজও চারদিক থেকে বিপুল
সৈন্যবাহিনী নিয়ে সামরিক অভিযান শুরু করেন। ছোটনাগপুর, সিংভূম, হাজারিবাগ, ভাগলপুর ও মুঙ্গেরের ম্যাজিস্ট্রেটরা
তাঁদের
সাধ্যমতো সৈন্য ও
হাতি পাঠান এই অভিযানে। এভাবে বহু সৈন্য ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একটি বাহিনী নিয়ে মেজর
বারোজ ভাগলপুরের দিকে আসতে থাকা সাঁওতাল বাহিনীর গতিরোধ করতে এগিয়ে যায়। ১৮৫৫ সালের ১৬ জুলাই ভাগলপুর জেলার পিয়ালপুরের কাছে পীরপাঁইতির ময়দানে
সুসজ্জিত ইংরেজ বাহিনী ও সাঁওতাল স্বাধীণতা সংগ্রামী দলের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই হয়। দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা লড়াইয়ের পর মেজর বারোজের বাহিনী চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়ে
পালিয়ে যায়। এ লড়াইয়ে ইংরেজদের একজন অফিসার, কয়েক
দেশীয় অফিসার ও প্রায় ২৫ জনের মতো সিপাহি নিহত হয়। ভাগলপুরের কমিশনারের একটি চিঠিতেও সাঁওতাল
স্বাধীণতা সংগ্রামীদের বীরত্বের চিত্র পাওয়া যায় : ‘স্বাধীণতা সংগ্রামীরা নির্ভীক চিত্তে
প্রাণপণ যুদ্ধ করেছিল। তাদের যুদ্ধাস্ত্র কেবল তীর-ধনুক আর একপ্রকারের কুঠার (টাঙ্গি)। তারা মাটির ওপর বসে পা দিয়ে ধনুক হতে তীর ছুড়তে অভ্যস্ত। তাদের বীরত্বে আমাদের বাহিনীকে
পশ্চাৎপসারণ করতে হয়েছে।’
মেজর বারোজের পরাজয়ের ফলে ভাগলপুর সদর, কলগঙ্গ ও রাজমহল বিপন্ন হয়ে পড়ে এবং ইংরেজ প্রশাসন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বিদ্রোহে দমনে তারা শক্তি বৃদ্ধির পরিকল্পনা করে। সাঁওতালদের বীরত্বপূর্ণ বিদ্রোহে
ভাগলপুরের কমিশনার এতই শঙ্কিত
হয়ে পড়েছিলেন,
তিনি একটি চিঠিতে
বড়লাট লর্ড ডালহৌসিকে অবিলম্বে ‘মার্শাল
ল’ জারি করে সমগ্র সাঁওতাল অঞ্চলটিকে
সামরিক শাসনের অধীনে আনার অনুরোধ করেছিলেন। কমিশনার সাহেব স্বাধীণতা সংগ্রামের
নায়কদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্যও বিপুল পরিমাণ অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু সব পন্থা অবলম্বন করার পরও স্বাধীণতা সংগ্রামের তেজ বাড়তে থাকে। সাঁওতাল স্বাধীণতা সংগ্রামীরা আসলে তখন
শুধু মহাজন নয়,
মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন
ইংরেজ রাজেরও,
প্রত্যাখ্যান করেছিল
ইংরেজ শাসন। এ ব্যাপারটিই
তীব্র মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইংরেজ রাজের কাছে। হান্টারের এনালস অব রুরাল বেঙ্গলেও এই
বৃত্তান্ত পাওয়া যায় ‘…বিদ্রেহী
সাঁওতালগণ এখানে তিন হাজার, ওখানে
সাত হাজার এইভাবে আক্রমণ চালাতে থাকে। বীরভূম জেলার সমগ্র উত্তর-পশ্চিমাংশ
স্বাধীণতা সংগ্রামীদের দখলভুক্ত হয়। সীমান্ত ঘাঁটিগুলো হতে ব্রিটিশ শাসকগণকে পলায়ন করতে হয়। …স্বাধীণতা সংগ্রামীরা জমিদার-মহাজনদের শত শত গরু-মহিষ লুণ্ঠন
করে নিয়ে যায়। আমাদের সৈন্যবাহিনী বারংবার স্বাধীণতা সংগ্রামীদের হাতে পরাজিত হয়। সরকারের আত্মসমর্পণের নির্দেশকে স্বাধীণতা সংগ্রামীরা ঘৃণাভরে অগ্রাহ্য
করে।’ স্বাধীণতা
সংগ্রাম এভাবে ছড়িয়ে পড়ে বিহারের গোদ্দা, পাকুড়, মহেশপুর ও মুর্শিদাবাদসহ পুরো সাঁওতাল অঞ্চলে। স্বাধীণতা সংগ্রামী সাঁওতালরা স্বাধীণতা
সংগ্রামের শুরুর দিকেই
বারহাইত নিজেদের অধিকারে নিয়েছিল। বারহাইতে থেকেই তারা তাদের স্বাধীণতা
সংগ্রাম
পরিচালনা করে। সাঁওতাল স্বাধীণতা সংগ্রামীরা বারহাইতে
কিছুদিনের জন্য স্বাধীন সাঁওতাল
রাজ্যও প্রতিষ্ঠা করেছিল।
হতভম্ভ এবং আতঙ্কিত ইংরেজ সরকার এরপর
স্বাধীণতা সংগ্রাম দমনের জন্য তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে। সাঁওতাল পরগনার পূর্ব দিকের অঞ্চল এবং
পার্শ্ববর্তী রজ্যগুলোকে স্বাধীণতা
সংগ্রামের দাবানল থেকে রক্ষা করার জন্য বড়লাট পূর্বাঞ্চলের সমগ্র সামরিক শক্তি সমবেশ করার আদেশ দেন। অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী, কামান বাহিনী, হস্তী বাহিনী প্রভৃতি পূর্ব ভারতের
যেখানে যে বাহিনী ছিল, সব
বাহিনীকেই সাঁওতাল
পরগনায় এনে সমবেত করা হয়েছিল। আর স্বাধীণতা সংগ্রাম দমনে ইংরেজ
সরকারকে
সর্বাত্মক সহায়তা
নিয়ে এগিয়ে এসেছিল মুর্শিদাবাদের নবাব, জমিদার, জোতদার
ও নীলকর মহাজনরা। ব্রিটিশদের এ দেশীয় দালাল জোতদার, জমিদার ও মহাজনদের সহায়তায় স্বাধীণতা সংগ্রামীদের ওপর এক
সর্বাত্দক আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নেয় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী।
হান্টারের বিবরণে স্বাধীণতা সংগ্রাম
দমনের মহাযজ্ঞের একটি ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ‘সৈন্যবাহিনী দলে দলে পশ্চিশ দিকে যাত্রা
করিল। দেশভক্ত
(মানে ব্রিটিশভক্ত) জমিদার
ও মহাজনগণ এ সকল বাহিনীর জন্য অস্ত্র ও রসদ সংগ্রহ করে দিল, রাত্রিবাস ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিল। নীলকর সাহেবগণ প্রচুর অর্থসাহায্য করল এবং মুর্শিদাবাদের মহামান্য নবাব
বহু সৈন্য ও একদল শিক্ষিত হাতি পাঠিয়ে এদের ব্যয়ভার বহন করলেন। আর স্বাধীণতা সংগ্রাম যেভাবেই হোক দমন
করবার জন্য বিশেষ
ক্ষমতাসহ একজন স্পেশাল কমিশনার নিযুক্ত হইলেন।’
এই যৌথ বাহিনী ও বিপুল এবং নবতম
মারণ অস্ত্রশস্ত্রের বিরুদ্ধে স্বাধীণতা সংগ্রামীরা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেনি। তবু লড়াই চলিয়ে গেছেন তাঁরা শেষ পর্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে। সামনে থেকে লড়াই করে সিদো, কানু, চাঁদ, ভৈরবসহ
স্বাধীণতা সংগ্রামের নেতারাসহ অনেক স্বাধীণতা সংগ্রামী প্রাণ দিয়েছেন
সাহসের সঙ্গে। তবে স্বাধীণতা সংগ্রাম
দমনে ইংরেজ বাহিনীর পৈশাচিকতা এমন পর্যায়েই গিয়েছিল যে একজন
ইংরেজ সেনাপতিও তাঁর আবেগ ধরে রাখতে পারেননি, ‘আমরা
যা করেছি তা যু্দ্ধ নয়, স্রেফ গণহত্যা। আমাদের ওপর নির্দেশ ছিল, যখনই কোনও গ্রামে
ধূম্রকুণ্ডলী বনের ওপর দেখা যাবে, তখনই যেয়ে সেই গ্রাম বেষ্টন করতে হবে। কোনও বাছবিচার
ছাড়া বর্ষণ করতে হবে গোলা। নারী-শিশু-বৃদ্ধ আমাদের
কোনও বিবেচনায় ছিল না। বেশির ভাগ সময় পুরো গ্রামই আমরা জ্বালিয়ে দিতাম!’ কোম্পানির বিচিত্র
দমন-পীড়নে আস্তে আস্তে ১৮৫৬ সালের দিকে স্তিমিত হয়ে এসেছিল সাঁওতাল স্বাধীণতা সংগ্রাম। সাঁওতাল স্বাধীণতা সংগ্রাম উজ্জীবিত করেছিল পরবর্তী
প্রজন্মের স্বাধীণতা সংগ্রামীদের।
D
s�R�.=f��w�u11.0pt;font-family:Vrinda;mso-ascii-font-family:"Times New Roman";
mso-hansi-font-family:"Times New Roman";mso-bidi-language:BN-BD'> সাঁওতাল
স্বাধীণতা সংগ্রাম ভিত্তি করে ১৯৪০সালে প্রকাশিত এটি প্রায়প্রথমতম আকরগ্রন্থ
যেখানে ব্রিটিশদের বা মার্ক্সবাদীদের পথ ধরে সাঁওতালদের শুধুই এক অসভ্য খুনি
গোষ্ঠী বলে চিহ্নিত করা হয়নি। মার্ক্স আ নোট অন ইন্ডিয়ান হিস্ট্রিতে বলছেন
সাঁওতাল স্বাধীণতা সংগ্রাম ছিল অর্ধসভ্য কিছু সাঁওতালদের স্বাধীণতা সংগ্রাম। রজনী পাম দত্ত ইন্ডিয়া টুডেতে
তাঁর চেতনগুরুর পথ ধরে সাঁওতাল স্বাধীণতা সংগ্রামকে বলছেন প্রিমিটিভ এন্ড স্পনটেনিয়াস ফর্মস অব আইসোলেটেড এক্টস অব রিভেঞ্জ এন্ড
ভায়োলেন্স। ১৯৮৩তে রঞ্জিত গুহ লিখলেন এলিমেন্টারি আসপেক্টস অব পেজান্ট ইনসারজেন্সি। অথচ তিনিও সেখানে সাঁওতালদের প্রায় অর্ধসভ্যরূপেই ঘোষণা করলেন।
কে কে দত্ত বলছেন, পাহাড়ের পাদদেশে বিস্তীর্ণ সমতল ভূমিতে দীর্ঘকাল ধরে বাঙালিরা বাস করত। ক্রমে ময়রা, বেনিয়া ও অন্যান্য শ্রেণীর আরও অনেক
বাঙালি
পরিবার বর্ধমান ও
বীরভূম জেলা থেকে আসে। মহাজনী ব্যবসা এবং বাণিজ্যের অবাধ সুযোগে আকৃষ্ট হয়ে সাহাবাদ, ছাপরা, বেতিয়া, আরা
ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভোজপুরি, ভাটিয়া প্রভূতি পশ্চিমি ব্যবসায়ীরা দলে
দলে দামিন-ই-কো অঞ্চলে জেঁকে
বসে। পাহাড়
অঞ্চলের ‘সদর কেন্দ্র’ বারহাইত ছিল একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এ স্থানের বহু সংখ্যক অধিবাসীর মধ্যে
পঞ্চাশটি বাঙালি ব্যবসায়ী পরিবারও বাস করত। সাঁওতাল পরগনার বিপুল পরিমাণ ধান, সরিষা ও বিভিন্ন ধরনের তেলবিজ ইংল্যান্ডে রপ্তানি করা হতো। এসব শস্যের পরিবর্তে সাঁওতালদের দেওয়া
হতো সামান্য অর্থ, লবণ, তামাক অথবা কাপড়। এ ছাড়া মহাজনদের শোষণ ছিল আরও ব্যাপক। তারা উচ্চহারে সাঁওতালদের কাছ থেকে সুদ
আদায় করত। এসব ঘটনাই সাঁওতালদের নিয়ে গিয়েছিল অনিবার্য স্বাধীণতা সংগ্রামের দিকে।
সাঁওতাল
স্বাধীণতা সংগ্রাম বিস্তারের
কাল ১৮৫৫ সাল হলেও ১৮৫৪ সাল থেকেই সাঁওতাল পরগনায় স্বাধীণতা সংগ্রামের আভাস পাওয়া গিয়েছিল। ব্রিটিশ কোম্পানির বিভিন্ন দলিলে এর আভাস পাওয়া যায়। ১৮৫৪ সালের দিকে মহাজনদের বাড়িতে বিছিন্ন
কিছু ‘ডাকাতির’ ঘটনা ঘটে। ব্রিটিশ নথিতে বলা হয়, উত্তেজিত অনেক সাঁওতাল মহাজনদের বাড়িতে ‘ডাকাতি’ করছে এবং এ ব্যাপারে ব্রিটিশ প্রশাসকদের তৎপরতাও চোখে পড়ে। তবে ব্রিটিশ নথিতে উল্লেখ্য ‘ডাকাতি’ অথবা ডাকাত ঔপনিবেশিকভাবে ব্যবহৃত শব্দগুলিকে নতুনভাবে নতুন
দৃষ্টিতে দেখার সময় এসেছে। ব্রিটিশবিরোধী বিভিন্ন বিদ্রোহাত্মক
কাজকে ব্রিটিশ প্রশাসকরা আখ্যা
দিত ‘ডাকাতি’ বা এ ধরনের কোনও ঋণাত্মক
অভিধায়। আর যারা এসব বিপ্লবাত্মক কাজে অংশ নিত তাদের তারা চিহ্নিত করত ‘ডাকাত’ হিসেবে। ঔপনিবেশিক নথিতে যেখানে ‘ডাকাত’ বলা
হবে, সেখানে বুঝতে হবে বিপ্লবী স্বাধীণতাকামী কৃষক,
আর যেখানে বলা হবে ‘ডাকাতি’ সেখানে বুঝতে হবে বিপ্লবাত্মক
বা বিদ্রোহাত্মক কর্মকাণ্ড। এই তথ্যের উল্টো পাঠ তত্ত্ব প্রয়োগ করলে
বোঝা যায় যে ১৮৫৪ সালের দিকেই
সাঁওতাল পরগনায় ছোটখাটো স্বাধীণতা সংগ্রামের ঘটনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে সাঁওতালি স্বাধীণতা
সংগ্রামী দলের কিছু সংবাদ আমরা পাই দিগম্বর চক্রবর্তীর ‘হিস্ট্রি অব দ্য সানতাল হুল অব এইটিন ফিফটি ফাইভ’ বইতে। তিনি জানাচ্ছেন, ১৮৫৪ সালের দিকে মহাজনের উৎপীড়নে অতিষ্ঠ
হয়ে একদল সাঁওতাল ‘প্রতিহিংসা’ গ্রহণের উদ্দেশ্যে বীরসিং মাঝি নামের এক
সাঁওতাল সর্দারের অধীনে একটি ‘ডাকাতের’ (মানে স্বাধীণতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের দল)
দল গঠন করে। ‘দিকু’ অর্থাৎ
বাঙালি
মহাজন ও পশ্চিম
ভারতীয় মহাজনদের গৃহে ‘ডাকাতি’ করে ‘প্রতিহিংসা’ গ্রহণ করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। তাদের গতিবিধিতে সন্দিগ্ধ হয়ে সব মহাজন
একত্রে
তাদের বিরুদ্ধে
ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দীঘি থানার দারোগা মহেশলাল দত্তের কাছে আবেদন জানায়। এরপর তারা পাকুড়ের জমিদারের কাছে অভিযোগ জানায়।
জমিদার নায়েব-মহাজনদের সঙ্গে পরিকল্পনা করে
বীরসিং মাঝি নামের স্বাধীণতা সংগ্রামী সাঁওতাল নেতাকে কাছারিবাড়িতে আটক করে। এ ঘটনার পর থেকে সাঁওতাল মহলের
সাঁওতালরা ক্ষিপ্ত
হয়ে কিছু মহাজনের বাড়ি আক্রমণ করে। তখন সাঁওতাল মহলের নায়েব ভীত হয়ে কাছারিবাড়ি রক্ষার জন্য অনেক পাঠান
লাঠিয়াল ও পাহাড়িয়া ধনুর্বর নিযুক্ত করে। এর প্রতুত্তর সাঁওতাল স্বাধীণতা সংগ্রামী সৈনিকরাও খুব
ভালোভাবেই দেয়। বীরসিংহের
নেতৃত্বে সাঁওতাল বাহিনী অত্যাচারী মহাজনদের আক্রমণ করতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ দীঘি থানার
দারোগা মহেশ দত্ত পুলিশ নিয়ে সাঁওতাল স্বাধীণতা সংগ্রামীদের গ্রেপ্তার করতে যান। সাঁওতাল মহলে গোক্কো নামে এক অবস্থাপন্ন সাঁওতাল বাস করত। অনেক আগে থেকেই বাঙালি মহাজনদের লোভ ছিল গোক্কোর সম্পদের ওপর। এ সুযোগে মহাজন ও জোতদাররা দারোগার
সঙ্গে পরামর্শ করে গোক্কো
সাঁওতালকে মিথ্যা চুরির অভিযোগে গ্রেপ্তার করায়। ১৮৫৪ সালের শেষের দিকে সাঁওতাল নেতারা গোক্কো, বীর সিংহসহ আরও অনেক সাওতাল নেতা
সাঁওতাল
সর্দারের ওপর
নিপীড়নের প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের প্রথম ভাগে বীরভূম, বাঁকুড়া, ছোটনাগপুর ও হাজারিবাগ থেকে প্রায় সাত হাজার সাঁওতাল ‘দামিন’ এলাকায়
সমবেত হন। সাঁওতালদের ক্ষোভ ছিল যে মহাজনরা সাঁওতালদের ওপর অমানুষিক
অত্যাচার-নিপীড়ন চালালেও শাস্তি হয় না; কিন্তু সাঁওতালরা যদি এর প্রতিবাদ করতে যায় বা প্রতিশোধ নিতে যায়
তাহলে তাদের ওপর নেমে
আসে জেল-জুলুম। এসব অন্যায়ে তাদের নিয়ে যায় মহাবিস্ফোরণের দিকে।
এরকম পরিস্থিতিতে সাতকাঠিয়া গ্রামে ঢুকে
মহেশলাল দারোগা বহু সাঁওতালকে গ্রেপ্তার করে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তাদের ওপর অমানুষিক
নির্যাতন করেন। কয়েকজন
নেতৃস্থানীয় সাঁওতালকে চাবুক দিয়ে পেটানোও হয়। পুলিশের এ আচরণ সাঁওতাল পল্লীতে ক্ষোভের আগুন দ্বিগুণ
করে তোলে। শুরু হয়ে যায় সাঁওতাল স্বাধীণতা সংগ্রাম। চারদিকে তখন বাজতে থাকে স্বাধীণতা
সংগ্রামের মাদল। স্বাধীণতা
সংগ্রামের মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসেন স্বাধীণতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক দুই নেতা দুই সহোদর সিদো ও কানু। সিদো বড় আর কানু ছোট। সাঁওতাল পরগনার সদর থেকে আধা মাইল দূরে ভগনদিহি গ্রামের এক
দরিদ্র সাঁওতাল পরিবারে তাঁদের জন্ম। সিদো ও কানুর সাঁওতাল স্বাধীণতা সংগ্রাম ঘোষণা করা নিয়ে একটি
চমকপ্রদ গল্প চালু আছে। গল্পটি এ রকম :
‘একদিন রাত্রিকালে যখন সিদো ও কানু তাহাদের গৃহে বসিয়া বহু বিষয় চিন্তা করিতেছিলেন,…তখন সিদোর মাথার উপর এক টুকরা কাগজ পড়িল, সেই মুহূর্তেই ঠাকুর সিদো ও কানুর সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। ঠাকুর শ্বেতকায় মানুষের মত হইলেও সাঁওতালী পোশাকে সজ্জিত ছিলেন। তাঁহার প্রতি হাতে দশটি করিয়া আঙুল, হাতে ছিল একখানি সাদা রঙের বই এবং তাহাতে তিনি কি যেন লিখিয়া ছিলেন। বইটি এবং তাহার সাথে বিশ টুকরা কাগজ তিনি দুই ভাইকে অর্পণ করেন। তারপর তিনি উপরের দিকে উঠিয়া শূন্যে মিলাইয়া যান। আর এক টুকরা কাগজ সিদোর মাথার উপর পড়িল এবং সাথে সাথে দু’জন মানুষ তাহার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। তাহারা দুই ভাইয়ের নিকট ঠাকুরের নির্দেশ ব্যাখ্যা করিয়াই অন্তর্হিত হইলেন। এইভাবে একদিন নয়, সপ্তাহের প্রতিদিনই ঠাকুর আবির্ভূত হইয়াছিলেন। বইয়ের পৃষ্ঠায় ও কাগজের টুকরাগুলিতে কতগুলি কথা লেখা ছিল। পরে শিক্ষিত সাঁওতালগণ তাহার অর্থ উদ্ধার করে। কিন্তু সিদো ও কানুর নিকট কথাগুলির তাৎপর্য কিছুমাত্র অস্পষ্ট ছিল না।’
‘একদিন রাত্রিকালে যখন সিদো ও কানু তাহাদের গৃহে বসিয়া বহু বিষয় চিন্তা করিতেছিলেন,…তখন সিদোর মাথার উপর এক টুকরা কাগজ পড়িল, সেই মুহূর্তেই ঠাকুর সিদো ও কানুর সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। ঠাকুর শ্বেতকায় মানুষের মত হইলেও সাঁওতালী পোশাকে সজ্জিত ছিলেন। তাঁহার প্রতি হাতে দশটি করিয়া আঙুল, হাতে ছিল একখানি সাদা রঙের বই এবং তাহাতে তিনি কি যেন লিখিয়া ছিলেন। বইটি এবং তাহার সাথে বিশ টুকরা কাগজ তিনি দুই ভাইকে অর্পণ করেন। তারপর তিনি উপরের দিকে উঠিয়া শূন্যে মিলাইয়া যান। আর এক টুকরা কাগজ সিদোর মাথার উপর পড়িল এবং সাথে সাথে দু’জন মানুষ তাহার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। তাহারা দুই ভাইয়ের নিকট ঠাকুরের নির্দেশ ব্যাখ্যা করিয়াই অন্তর্হিত হইলেন। এইভাবে একদিন নয়, সপ্তাহের প্রতিদিনই ঠাকুর আবির্ভূত হইয়াছিলেন। বইয়ের পৃষ্ঠায় ও কাগজের টুকরাগুলিতে কতগুলি কথা লেখা ছিল। পরে শিক্ষিত সাঁওতালগণ তাহার অর্থ উদ্ধার করে। কিন্তু সিদো ও কানুর নিকট কথাগুলির তাৎপর্য কিছুমাত্র অস্পষ্ট ছিল না।’
সাঁওতাল স্বাধীণতা সংগ্রাম নিয়ে এ
গল্পটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সংকীর্ণ ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে
ওপরের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে
ইতিহাসের কেবল ভুল পাঠ আর ভুল মূল্যায়নই করা হবে। ভারতীয় সমাজের হাজার বছরের লড়াই করার যে শক্তি মানুষ প্রকৃতি
থেকে পেয়ে আসছে তাই বিবেচনা করার ওপর জোর দিয়েছেন আধুনিককালের ইতিহাসবিদরা। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এ ঘটনার পর সিদো ও কানু তাঁদের বাড়ির
কাছের বনে ঠাকুরের
মূর্তি তৈরি করে পূজার ব্যবস্থা করেন। এরই মধ্যে তাঁরা চারদিকে শালগাছের শাখা পাঠিয়ে ঠাকুরের আর্বিভাব
এবং স্বাধীণতা সংগ্রামের কথা প্রচার করেন। শালগাছের শাখা প্রেরণ হলো সাঁওতালি প্রচারব্যবস্থার একটি
প্রচলিত পদ্ধতি। শালগাছের
শাখা সাঁওতালিদের কাছে এক বিশেষ ইঙ্গিত দেয়। এ ইঙ্গিত হলো সর্বাত্দক লড়াই-বিদ্রোহে নামার ইঙ্গিত। অর্থাৎ সাঁওতাল বিদ্রোহে শালগাছের শাখা একটি ‘সিগনিফায়ার’ হিসেবে কাজ করে; যেমনটা আমরা লক্ষ করব, দুই বছর পরে ১৮৫৭ সালের মহাস্বাধীণতা সংগ্রামের
বেলায়। মহাস্বাধীণতা সংগ্রাম শুরুর আগে গ্রামগুলোতে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা চাপাতি বিতরণ করেছিলেন। এই চাপাতি ছিল তখন স্বাধীণতা সংগ্রামের ‘সিগনিফায়ার’ বা স্বাধীণতা সংগ্রাম যে শুরু হবে তার
আলামত।
সাঁওতাল সমাজ
ক্রমশঃ নিজেদের স্বাধীণতা সংগ্রামের জন্য তৈরি করতে থাকে। গ্রামের পর গ্রামের সাঁওতালেরা নতুন করে গড়ে পিটে নিতে থাকে নিজেদের স্বাধীণতা
সংগ্রামের অধ্যায়। বাড়ির সামনে হাল আর ঝাঁটা ঝোলানো
হয়, প্রত্যেকের বাড়ির উঠোন পরিস্কার করে লেপে পুঁছে বাড়ির দেওয়ালে উঠোনে আলপনা
দিয়ে মেয়েরা পায়ে নাচের ঘুঙুর পরেন, পাঁছগ্রামের সাঁওতালদের সঙ্গে আরও পাঁচগ্রামের
সাঁওতালরা মিলে প্রত্যককে নতুন গান, নতুন সুর শেনায়, হালের কাঠটি অবিবাহিত যুবকের
হাতে দিয়ে, হাতে বেঁধে দেওয়া হয় একটি মাঙ্গলিক সুতো। প্রত্যেক সাঁওতাল জালতে বুঝতে পেরেছিলেন তাঁদের সমাজ আর আগের মত ভারতে বাস
করতে পারবেননা, হুল তাদের সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গী হয়ে উঠল। প্রত্যক মাঝি হাড়াম বললেন তাঁরা আর আগেরমত থাকতে পারবেন না, তাঁদের জীবনে
নেমে আসবে দারিদ্র্য, নিষ্পীড়ণ আর পরস্পরের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।
সিদো ও কানু দুই সহোদর ‘ঠাকুরের নির্দেশ’ (মানে স্বাধীণতা সংগ্রামের বার্তা)
সাঁওতাল
জনগণকে শোনানোর জন্য
দিন ধার্য করেন। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন সিদো-কানুর গ্রাম ভগনদিহিতে ৪০০ গ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে
প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল একটি সভা করেন। এ সভায় বক্তৃতা করেন স্বাধীণতা সংগ্রামের দুই প্রধান নেতা সিদো
ও কানু। বক্তৃতায়
সিদো ও কানু ইংরেজ-জমিদার-পুলিশ এবং মহাজনদের বিভিন্ন শোষণ-নিপীড়নের কাহিনী তুলে ধরেন এবং এই
শোষণ-নিপীড়নের বিরদ্ধে সাঁওতাল জনগণকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। বক্তৃতায় সিদো ও কানু একটি স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠারও ঘোষণা দেন। সভায় উপস্থিত প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল তখন সমস্বরে শপথ নেন শোষক-উৎপীড়কদের
বিতাড়িত করে তাদের জমি দখল ও স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার।
সমাবেশের পর সিদোর নির্দেশে কির্তা, ভাদু
ও সন্নোমাঝি নামে সাঁওতাল নেতা ইংরেজ সরকার, ভাগলপুরের
কমিশনার, কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট, বীরভূমের কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট, দীঘি থানা ও টিকড়ি
থানার দারোগা এবং আরও অনেক জমিদারকে হুঁশিয়ার করে
চিঠি পাঠায়। এই চিঠিগুলো ছিল
চরমপত্রের মতো। ‘চরমপত্র’ পাঠানোর পর সাঁওতাল
নেতৃবৃন্দ চারদিকে ঘোষণা করে দেন যে তাঁরা বাঙালি
ও পশ্চিমী মহাজনদের উচ্ছেদ করতে এবং সাঁওতাল অঞ্চল দখল করে সেখানে স্বাধীন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মজার ব্যাপার যে এ ঘোষণার
সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা আরও একটি ঘোষণা দেন, তা হলো, কুমোর, তেলি, কর্মকার, মুমিন
মুসলমান বা তাঁতি, চর্মকার এবং ডোম, তারা হোক বাঙালি বা অন্য গোত্রের, তারা সাঁওতালদের প্রতি
বিশেষ সহানভূতিশীল ও বন্ধুভাবাপন্ন বলে তাদের বিরুদ্ধে
কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। এতে বোঝা যায়, স্থানীয় এসব মানুষের সঙ্গে সাঁওতালদের ঘনিষ্ঠতা ছিল কত। আসলে সাঁওতালদের লড়াই ছিল সাঁওতাল
ভিন্ন এসব মিতান-মানুষের লড়াই।
No comments:
Post a Comment