Thursday, October 19, 2017

গরীব কাহারে কয়২ - উন্নয়নের বিশ্ব রাজনীতি তত্ত্ব

নিউ ডিলের মাধ্যমে ট্রুম্যানের স্বপ্ন ফেরির চেষ্টা যে শুধু আমেরিকার উদ্যমে শুরু হয়েছিল, সেটা বলা সত্যের অপলাপ হবে, বরং বলা ভাল দ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এই তত্ত্বটির বিকাশ ঘটেছিল। কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্বজুড়ে ক্ষমতাসীনদের মনের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল স্বপ্নতত্ত্বটি। স্বপ্নটা ফেরি করা খুব সহজ কাজ হবে না সেটা বোঝা গিয়েছিল, আন্দাজ করা হয়ত যায়, সামনে কি কি ধরণের বাধা আসতে পারে, ক্ষমতা সেটা বুঝে নিয়ে এই প্রকল্পটিকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা শুরু করল। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ডাকে একদল বিশেষজ্ঞের হাতে তৈরি, এবিষয়টির বাস্তবায়নের নীতি রূপায়ন এবং ‘অনুন্নত দেশগুলিকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়ার’ পথরেখা তৈরির একটি দলিল কি বলছে সেটা আমরা আমাদের মুখবন্ধের পরেই উল্লেখ করেছি – সেটা আরেকবার উল্লেখ করি-

...আমাদের মনে হয় বেদনাদায়ক কিছু সিদ্ধান্ত(পেইনফুল এডজাস্টমেন্ট) না নেওয়া হলে উন্নয়নের সুফল মেলা ভার হবে। পুরোনো দর্শন ত্যাগ/রদ করতে হবে, পুরনো সামাজিক সঙ্গঠনগুলিকে ভেঙ্গেফেলতে হবে, জাতি, ধর্মবিশ্বাস, বর্ণকে উড়িয়ে দিতে হবে। বিপুল সংখ্যক মানুষ, যারা সুখী জীবন পাওয়ার জন্য প্রগতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না, তাদের বেদনা বাড়ছে। অর্থনৈতিক প্রগতির দাম দেওয়ার জন্য (এই মুহূর্তে) হাতে গোনা সমাজ তৈরি আছে – জাতি সংঘ, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দপ্তর, অনুন্নত দেশগুলির উন্নত হওয়ার নিদান, ১৯৫১।

রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রণোদিত এই সমীক্ষায় স্পষ্ট করে অনুন্নত সমাজের সামগ্রিক পুনর্নবীকরণের কথা বলা হল। এটি আজকের দৃষ্টিতে হয়ত চতুর এথনোসেন্ট্রিক, অহংকারী এমন কি কিছুটা নিস্পাপ বলেও মনে হতেই পারে, কিন্তু সমীক্ষায় বিশেষজ্ঞরা কোন ঘোমটা না রেখেই তাদের অভিপ্রায় উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। এই সমীক্ষায় বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের জীবনকে শুধু জাগতিক সমৃদ্ধি আর অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য হেঁটমুণ্ডঊর্দ্ধপদ করানোর ইচ্ছে প্রকাশ করা হল সরাসরি। ১৯৫০/১৩৫৭এর শুরুর দিকে বিশ্বক্ষমতাধরদের রাষ্ট্রনীতিতে এই তত্ত্বটা শেকড়বাকড় ছড়িয়ে থানা গেড়ে বসে।

এই বইতে আমি বলব সেই আমেরিকিয় স্বপ্নটির আদত গল্প এবং কি করে দিনের পর দিন সারা বিশ্বজুড়ে সেটি দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হল। ১৯৫০/১৩৫৭য় স্বপ্নের ফেরিয়ালা আমলা বা রাজনীতিকরা মানুষকে সমৃদ্ধি দেওয়ার নাম করে বিশ্বজুড়ে বিপুল অনুন্নয়ন, এবং অস্বাস্থ্য, অবর্ণনীয় লুঠ আর অত্যাচারের বন্যা বইয়ে দিলেন। ঋণ সমস্যা, সাহেলিয় মন্বন্তর(আফ্রিকার সেনেগাল নদী ধরে সহেলি এলাকার বহু দেশ জুড়ে মন্বন্তর, আদতে যেটি গণহত্যাই), দারিদ্র বৃদ্ধি, অপুষ্টি, এবং অত্যাচারের বাড়বৃদ্ধি চল্লিশ বছরের উন্নয়নের খতিয়ান। এই বইটাকে আপনারা একটি স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস হিসেবেও পড়তে পারেন, যে স্বপ্নে বহুমানুষ অন্তর দিয়ে উজ্জীবিত হয়েছিল, বিশ্বাস করেছিল। সব থেকে বড় কথা এই আলোচনাটাও করা জরুরি, কিভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে উন্নয়ণের খতিয়ান আর বিতর্কে ‘তৃতীয় বিশ্ব’কে করে তোলা হল বিশেষ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু, সেটাও বোঝা।

প্রাচ্যবাদ, আফ্রিকাবাদ এবং উন্নয়নবাদ
বিংশ শতকের সাতের দশকের শেষাষেষি পর্যন্ত আফ্রিকা, এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার উন্নয়নের চরিত্র নিয়ে আলোচনা চলত। আমরা দেখব, ১৯৫০এর সাধারণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন তত্ত্ব থেকে সাতের দশকের মানুষের মৌল চাহিদা মূলক উন্নয়ন তত্ত্বে উপনীত হওয়া শুধু যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথাই বলা হল না, বরং বলা হল উন্নয়নের ফলের ভাগিদার সাধারণ মানুষকে করতে হবে। সেই দিকে লক্ষ্য রেখে উন্নয়নের তাত্ত্বিক আর রাজনীতিকেরা ভাবতে বসলেন অনুন্নত দেশগুলিকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে এবং অনুন্নয়নের সমাধান কল্পে কি ধরণের উন্নয়নের নিদান দেওয়া প্রয়োজন। চলতি পুঁজিবাদের বিরোধীরাও কিন্তু বড় পুঁজি পোষিত উন্নয়নের ভাষা যেমন অন্যধারার উন্নয়ন, অংশগ্রহনকারী উন্নয়ন, সমাজবাদী উন্নয়ন ইত্যাদির মত শব্দবন্ধের আশ্রয় নিলেন। অন্যভাবে বলতে গেলে, উন্নয়নের ভাবনা, উন্নয়নের পথ, উন্নয়নের চরিত্র আলাদা হতেই পারে, কিন্তু এটা স্বীকার করে নেওয়া হল উন্নয়ণ আর তার চাহিদার কোন বিকল্প নেই। মোটামুটি ভেবে নেওয়া গেল, সমাজ বিকাশে উন্নয়নই একমাত্র পাথেয়।



বাস্তবে উন্নয়ন ব্যতিরেকে সামাজিক বাস্তবতার অন্য কোন লব্জ রইল না। উন্নয়ন একমাত্র উন্নয়নই মন্ত্র হয়ে দাঁড়াল – সরকারগুলি একেরপর এক গগনচুম্বি উন্নয়ন প্রকল্প তৈরি করতে লাগল, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শহর এবং প্রান্তে উন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরি করতে লাগল, বিশেষজ্ঞরা অনুন্নয়ন বিষয়ে তত্ত্ব বিকাশ এবং পাইকারিহারে অনুন্নয়ন থেকে বেরিয়ে আসার তত্ত্ব উৎপাদন করতে শুরু করলেন। উন্নয়নের ধাক্কায় অধিকাংশ মানুষ উন্নত না হয়ে দুর্দশার কবলে পড়ছে এই বিষয়টাই বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টির বাইরে থেকে গেল, তারা এ নিয়ে ভাবলেনই না। বাস্তবতা দিনের পর দিন উন্নয়নের চর্চার উপনিবেশ হয়ে উঠল। যারা এই রাষ্ট্র প্রণোদিত উন্নয়নের ধাক্কায় অখুশি হয়ে রইলেন, তারাও এই উন্নয়নের চিন্তার আওতার মধ্যে থেকে খুঁটে খুঁটে তত্ত্ব তৈরি করে ভাবতে বসলেন একদিন নিশ্চই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবেই২।

(এনকাউন্টারিং ডেভেলাপমেন্টঃ দ্য মেকিং এন্ড আন্মেকিং অব দ্য থার্ড ওয়ার্লডঃ আর্তুরো এসকোবারএর বই থেকে)

No comments: