যতদিন মুর্শিদকুলি খাঁএর টাঁকশালের বিশ্বস্ত দারোগা রঘুনন্দন বেঁচেছিলেন ততদিন নবাবের খাজাঞ্চিখানার চাবি জগতশেঠ পদবিধারী ফতেহচাঁদের পরিবারের কব্জায় থাকলেও, তাঁরা টাঁকশালের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ পান নি। রঘুনন্দন যখন মৃত্যুশয্যায়, সে সময় দিল্লি থেকে ফারুফশিয়রের ফরমান আনিয়ে ইংরেজরা বাঙলা সুবায় টাঁকশাল চালানোর অধিকারের জন্য জোর দরবার শুরু করে। ইংরেজেরা ফারুখশিয়রের থেকে ১৭১৭/১১২৪এ বাংলার টাঁকশাল ব্যবহারের অনুমতিপত্রে বলা ছিল ইংরেজদের মাদ্রাজ টাকার ওপর বাংলার টাঁকশাল কোন বাটা নিতে পারবে না। মুর্শিদকুলি, জগতশেঠ ফতেহচাঁদের সক্রিয় বিরোধিতায় এই ফরমান লাগু করা যায় নি। কারণ এরাই দেশের একচেটিয়া সোনা রূপোর ক্রেতা। অভূতপূর্ব লাভ। সেজন্য বিদেশিদের টাঁকশালের অধিকার দিতে চাইত না।
রঘুনন্দনের মৃত্যুতে টাঁকশালের আশায় থাকা ইংরেজরা দেখলেন, নবাবি কারসাজিতে ইংরেজদের বঞ্চিত করে ফতেহ্চাঁদ সেই ফরমান পেয়ে গিয়েছেন। আগেই বলেছি শতকরা মাত্র দু থেকে আড়াই টাকা হারে বাজার থেকে তারা পুরোনো সিক্কা কিনতেন। বাজার থেকে জনগণের কাছ থেকে পুরোনো মুদ্রা বা অন্য প্রদেশের মুদ্রা এনে টাঁকশালের ছাপ মেরে নতুন সিক্কা বানাতেন। ইংরেজরা তাদের দেশ থেকে আনা সমস্ত রূপো ফতেহ্চাঁদদের পরিবারে বেচতে বাধ্য হত।
১৭৪০এর পর থেকে হিন্দুকুশ থেকে সুরাট বন্দর হয়ে দেশি বণিকের হাতে সোনা-রূপো আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ইংরেজদের আনা টন টন রূপো বাঙলায় টাঁকশালে জগতশেঠের প্রভুত্বের বলয়ে ঢুকে পড়ত। আদতে মুর্শিদাবাদের নবাবেরা পুরোনো বছরের মুদ্রায় খাজনা নিতেন না। অর্থাত বিগত বছরের ইংরেজদের মাদ্রাজের টাঁকশালের তৈরি আর্কট মুদ্রা বাজারের অন্যান্য সাধারণ পণ্য দ্রব্য হয়ে চড়া বা মন্দায় উঠত পড়ত। বাজারের অন্যান্য পণ্যেরমতই এই ভূতপূর্ব বছরের টাকা বা সনওয়ত ডিসকাউন্টে কেনা বেচা হত। এই বাটা ছিল জনতার ওপর অদৃশ্য কর। এইভাবেই আর্কটের দাম কমিয়ে দিয়ে, মুদ্রা বিনিময়ের হার নিয়ে ব্যবসা করার জন্য সরকার জগতশেঠদের ইজারা দিত টাঁকশালের। জগতশেঠেরা এর জন্য জনগণের কাছ থেকে তোলা ট্যাক্সের এক বড় অংশ নবাবকে দিত থোক টাকা হিসেবে। টাঁকশালের কর্তৃত্ব হাতে নিয়ে ফতেহচাঁদ পুরোনো মুদ্রা কিনে নিয়ে তা গলিয়ে ছাপ মেরে পুরো দামে বাজারে ছাড়তেন। আর অন্যান্য সাধারণেরমতই বাটা দিয়ে আর্কট বা অন্য মুদ্রা ফতেহচাঁদদের কাছে বিক্রি করে প্রত্যেক বছর বাণিজ্যের জন্য সিক্কা সংগ্রহ করতে হত ইংরেজদের। ফতেহ্চাঁদ পরিবার মুদ্রার বিনিময় নিয়ন্ত্রণ করত বলে ইংরেজরা বছরের পর বছর তাদের টাকা তৈরি করতে খাজনা দিতে বাধ্য হত।
তবে জগতশেঠেরা শুধুই বাঙলার সরকারের সরাফ ছিলেন না, তারা দেশি বিদেশি সব বণিকদেরও মহাজন ছিলেন। ১৭৪০ পর্যন্ত ইংরেজরা তাদের কাছ থেকে ১২শতাংশ হারে ধার করত। ৪১সাল থেকে তা কমে ৯ শতাংশ হয়। মধ্য এশিয়ার তুরানী বণিক, বসরা, জেদ্দা, মোখায় রপ্তানি করা আরমানী বণিক, ইংরেজ ওলান্দাজ, ফরাসিরা সকলেই তার দেওয়া ধারে আর হুন্ডিতে ব্যবসা করত। হুন্ডি চলত আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যেও। দেশ-বিদেশের বাণিজ্যে তাদের পরিবারের এই দবদবার কারণ ছিল দিল্লির দরবারে তার পকড়। পারিবারিক জগতশেঠ উপাধি স্বয়ং দিল্লির বাদশাহের দান, বাদশাহের পাশে বসা বাদশাহের প্রধাণ প্রতিনিধি, নবাব নাজিমের ঠিক পাশেই জগতশেঠ ফতেহচাঁদের স্থান ছিল। তার জীবতকালেই পুত্র আনন্দচাঁদ মারাগেলে দুই নাতি কুঠির কর্তৃত্ব পান। ১৭৪৩এ কুঠি প্রধান হন জগতশেঠ মহতাব রায় আর তার খুড়তুতো ভাই সহযোগী মহারাজ স্বরূপচাঁদ। আহমদশাহ স্বয়ং মহাতব রায়ের জগতশেঠ উপাধি অনুমোদন করেন। দেশের যত ছোটবড় সরাফ যা বাটা নেন তা ঠিক হয় জগতশেঠএর কুঠিতে। যারা আলাদা হয়ে ব্যবসা করতেন বা তার কুঠির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না তাদের কুঠিতে লাল বাতি জ্বলে।
প্রবাদ রয়েছে মারাঠী দস্যু মির হাবিব জগতশেঠদের কুঠি থেকে ২ কোটি টাকার আর্কট রূপাইয়া লুঠ করে নিয়ে যায়। সে সময়কার ঐতিহাসিকেরা বলছেন লুঠের পর এই দুই ভাইএর লোকসান হল যেন দুআঁটি খড় চুরি হয়েছে। দিল্লিতে চড়াও হয়ে যখন আহমদশাহ আবদালি লুঠপাঠ করছেন, তখনও দেওয়ানই-আমের দরবারে কাবুলি নরপতির কাছে সম্মানিত লোক জগতশেঠের উকিল, কেননা আমীর ওমরাদের কাছ থেকে যে টাকা আদায় করা হচ্ছে তার জামিন হতে পারেন একমাত্র জগতশেঠ।
No comments:
Post a Comment