বাংলার নবাবদের এককালে আরেকটা আয়ের উৎস হল টাঁকশাল। দুটি পদ্ধতিতে বাংলা সরকারের টাঁকশালের থেকে প্রতিবছর মোটা টাকা আয় হত। তার কারণ হল প্রচলিত মুদ্রা ব্যবস্থা। মুদ্রা পুরোনো হলে তা ক্ষয়ে গিয়ে বাজারে তার দাম কমে যেত। সে জন্য প্রতি তিন বছর অন্তর পুরোনো মুদ্রা নতুন করে টাঁক্সালে এনে ছাপ দেওয়াবার(রিকয়েনিং) ব্যবস্থা চালু ছিল। বাংলার মহাজন আর ব্যবসায়ীরা শতকরা দুটাকা হারে তাদের পুরোনো ‘সোনাত’ মুদ্রা ‘সিক্কা’ টাকায় রূপান্তরিত করতেন।
অন্যটা হল বাংলায় বিদেশি বণিকেরা কাপড় এবং অন্যান্য পণ্য কিনতে বিপুল পরিমান সোনা আর রূপো বাংলার টাঁকশালে মুদ্রা করার জন্য হাজির করত। সুজার সময় বার্ষিক আয় হত ৩০৪১০৩ টাকা। বাংলা সরকারের মুর্শিদাবাদ আর ঢাকার টাঁকশাল থেকে বছরে অন্তত ৫ লক্ষ টাকা আয় হত।
ওপরে বর্ণিত চারটে - ভূমি রাজস্ব, আবওয়াব, সায়ের আর টাঁকশালের আয় ছাড়া আরেকটি উৎস হল জমিদার আর বণিকদের থেকে বিশেষ কর বা খাজনা আদায়। গোলাম হুসেন আর হলওয়েল জানাচ্ছেন আলিবর্দি মারাঠা যুদ্ধের আর আফগান বিদ্রোহের(১৭৪৫/১১৫৩২, ১৭৪৮/১১৫৫) সময় ইওরোপিয় বণিকদের থেকে সামরিক সাহায্যের জন্য কিছু অর্থ সাহায্য নিয়েছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল প্রতিরক্ষার দায় বাংলা সরকারের কিন্তু ফলভোগ করবেন ইওরপিয় বণিকেরা। তাই তাদের রাষ্ট্রকে সাহায্য করতে হবে। জেমস গ্রান্ট বলছেন ভাগীরথীর পূর্ব তীরের জমিদারদের থেকে আলিবর্দী প্রায় দেড় কোটি টাকা জবরদস্তি কর আদায় করেছিলেন। ১৭৪৮/১১৫৫এর আফগান বিদ্রোহের সময় জগতশেঠেদের থেকে বিপুল পরিমানে টাকা নিয়েছিলেন। সিরাজ কলকাতা দখল করে ফেরারা পথে ফরাসি আর ওলান্দাজদের থেকে তিন আর চার লক্ষ টাকা আদায় করে ছিলেন। নবাবেরা সুযোগ পেলেই বিদেশি বণিকদের থেকে টাকা আদায় করতেন। ইওরোপিয় কোম্পানিগুলি নানান অজুহাতে শুল্ক ফাঁকি দিত। নবাবেরা সুযোগ পেলেই মাঝে মধ্যে চাপ দিয়ে টাকা আদায় করে নিতেন।
গ্রান্ট বলছেন মুর্শিদকুলি আর সুজা নিয়মিত দিল্লীতে রাজস্ব পাঠাতেন। সুজা নিয়মিত বছরে এক কোটি পঁচিশ লক্ষ টাকা দিল্লীতে পাঠিয়েছেন। এরা দুজন মিলে চল্লিশ কোটি টাকা রাজস্ব ও সেই সঙ্গে বহুমূল্য উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন দিল্লীতে। উপঢৌকনের মধ্যে থাকত মসলিন, হাতির দাঁতের কাজ, ভাল কাঠের কাজ, হাতি ইত্যাদি। আলিবর্দি প্রথম দিকে মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাকে টাকা আর মুরিস শাকে উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। মারাঠা আক্রমণ শুরু হলে তিনি আর কোন কিছুই পাঠান নি, সিরাজও নয় – কার্যত তাঁরা স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করেছেন।
বাংলার জমির একটা অংশ জায়গির হিসেবে চিহ্নিত ছিল, যার আয় থেকে বাংলার প্রশাসনিক ব্যয় নির্বাহ হত। মুর্শিদকুলির সময় মোট জায়গির ছিল ৩৩২৭৪৭০ টাকা। এর মধ্যে নিজামত জায়গিরের ছিল পরিমান ছিল ১৪৫৫৪৭০ টাকা। সুজা আর আলিবর্দির সময় বাংলার জায়গীর এক পরিমান ছিল। সুজার সময় ১) নিজামতের জায়গীর ছিল ১০৭০০৬৫ টাকা, ২) দেওয়ানি জায়গির ছিল ১৪৬২৫০ টাকা, ৩) বড় আমলাদের জন্য জায়গির ২২৫০০০টাকা, ৪) ঢাকা, শ্রীহট্ট, পূর্ণিয়া, রংপুর রাজমহলের পাঁচ জন সীমান্ত মহলের ফৌজদারের জায়গির ৪৯২৪০০ টাকা। ৫) শ্রীহট্ট, ঢাকা, হিজলি, রাজমহলের একুশ জন মনসবদারের জায়গীর ১১০৪৫২ টাকা। ৬) চারটি সীমান্ত ত্রিপুরা, মুচবা, সুসঙ্গ আর তেলিয়াগড়ির জমিদারদের জন্য ৪৯৭৫০ টাকা। ৭) জীবিকার জন্য মদদইমাস ২৫২৬৫ টাকা, 8) শ্রীহট্টের জমিদারদের ভাতা ২৫৯২৭ টাকা, ৯) দুজন মৌলভির জন্য এনাম আলটুগমা, বংশানুক্রমিক জায়গির ২১২৭ টাকা, ১০) একজন মোল্লার রুজিনাদারান ভাতা ৩৩৭ টাকা, ১১) পর্তুগিজ নাবিক সহ ৭৬৮টি রণতরীর বাংলার নৌবহরের খরচ ৭৭৮৯৫৪ টাকা। ১২) ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি আর শ্রীহট্টকে সীমান্ত পাহারা দেওয়ার জন্য সৈন্য ও গোলান্দাজ বাহিনীর জায়গির ৩৫৯১৮০ টাকা। ১৩) ত্রিপুরা ও শ্রীহট্টের রাষ্ট্রের জন্য হাতি ধরার খরচ(খেদা আফিয়াল) ৪০১০১ টাকা মোট ১৬৬০ পরগনার মধ্যে ৪০৪টি জায়গির রাজস্ব প্রশাসনিক ব্যয় নির্বাহ করার জন্য আলাদা করে রাখা হয়েছিল।
No comments:
Post a Comment