১৭৫৭র পর থেকে বাঙলা থেকে সোনা-রূপা ইওরোপে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হল। ১৭৮০তে ওয়ারেন হেস্টিংস জানিয়েছেন, প্রতি বছর প্রায় ৪০ লাখ টাকার সোনা-রূপা ব্রিটেনে আমদানি করা হয়। বাঙলা থেকে প্রতি বছর মোট রপ্তানি করা সোনা-রূপোর ৪০ শতাংশ। কোম্পানি এছাড়াও অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যমেও ইওরোপে দামি ধাতু চালান করতেন। ‘There were only two ways by which a servant of the Company could wish propriety, remit his fortune to England; by bills on the Company or by diamonds’(The Pictorial History of England During the Reign of George the Third: 1785-1791 By George Lillie Craik, Charles MacFarlane)। সেটি কত পরিমানে ভারত থেকে নির্গত হত, তার কোনও সূত্র সরকারি নথিপত্রে উল্লেখ পাওয়া যায় না। কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর থেকে এই নির্গমণের পরিমান বাড়তে থাকে দ্রুতহারে। ১৭৭২এ বাঙলা লুঠের পদ্ধতিগুলি ক্লাইভ সবার সামনে হাট করে দিলেন।
কোম্পানির আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বাঙলার ভর্তুকি
বাঙলার রাজস্ব লুঠের পর কোম্পনি বাঙলা থেকে চিনে রূপো পাঠিয়ে চিন থেকে চা কিনতে শুরু করে। অর্থাত এশিয়ার বড় দুটো দেশে ইওরোপ থেকে দামিধাতু আসা বন্ধ হয়ে গেল। পলাশির পর বাঙলার সঞ্চিত রূপো চিনে যেত। গভর্নর ভেরলেস্টের হিসেব, দেওয়ানি লাভের পরবর্তী পাঁচ বছরে ইংলন্ড আর চিনে পাঁচ কোটি পাউন্ডের রূপো পাঠানো হয়েছে। তবে হ্যমিল্টন বলছেন বাঙলা থেকে রপ্তানিকরা সোনা যেত চিনে, ব্রিটেনে নয়। চিনে এই সোনা ব্যবহার হত চা আর সিল্ক কেনার জন্য। পরে আমরা দেখব চিনে বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে কোম্পানি চিনে সোনার বদলে আফিম রপ্তানি শুরু করে। এরপর ভারতের খাজনার পরিমান এত বেড়ে গেল যে, সেই টাকায় চিনে কাপড় আর আফিম যেতে লাগল। এবার ক্যান্টনে সুতির কাপড়ের রপ্তানির পরিমান কমিয়ে আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল আফিম রপ্তানির পরিমান।
সরকারিভাবে ব্রিটিশ বাঙলার আফিম আর ব্রিটিশ বহির্ভূত অঞ্চল মালওয়ার আফিম চিনে রপ্তানি হত। ব্রিটিশ বাণিজ্যের গতিজাড্যে বাঙলা-বিহার-মালওয়ার রক্ত জল করা আফিম চাষের উদ্বৃত্ত চিনাদের মৌতাতে রেখে ইওরোপ আর ব্রিটেনের জন্য মহার্ঘ চা কেনা হতে লাগল। ১৭৬৬র ১১ জানুয়ারি কলকাতার সিলেক্ট কমিটি ইঙ্গ-চিন বাণিজ্যের জন্য তিন লক্ষ পাউন্ড বরাদ্দ করে। হাউস অব কমন্সের প্রতিবেদনে, চিন বাণিজ্যের জন্য প্রতিবছর এক লাখ পাউন্ড বরাদ্দ ছিল। সুমাত্রা আর মালয়ে ব্যবসার জন্য কোম্পানি বাঙলা থেকে প্রতিবছর ৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে। দেওয়ানি লাভের পর প্রতিবছর মাদ্রাজ-বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে পঁচিশ থেকে তিরিশ লাখ টাকা পাঠানো হত। এক অংশ প্রশাসনের ঘাটতি মেটাতে অন্য অংশ পণ্য ক্রয় করতে। কমিটি অব সিক্রেসির মতে ১৭৬১-৬২ থেকে ১৭৭০-৭১ পর্যন্ত বাঙলা সুবা থেকে মাদ্রাজ-বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে ২৩,৫৮,২৯৮ ভর্তুকি পাউন্ড পাঠানো হয়। আলোচ্য শতকের শেষেরদিকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আর বিশ্বের নানান দেশে যুদ্ধবিগ্রহে কোম্পানির বার্ষিক ব্যয় প্রচুর বেড়ে যায়। ১৭৭৩-৮৩র আমেরিকার স্বাধীণতা যুদ্ধের সূত্রে ফরাসি উপনিবেশ পণ্ডিচেরি, চুঁচুড়া আর মাহে দখল করে। আর ফরাসি বিপ্লবের সূত্রে শ্রীলঙ্কা, মালাক্কা, বান্দা আর এমবোইনা দখল করে। ফলে এই যুদ্ধ বিগ্রহে কোম্পনির আর্থিক দায়দায়িত্ব বেড়ে যায় অনেকগুণ। বাঙলা থেকে ঋণ নিয়ে কোম্পানি এই যুদ্ধের ব্যয়ভার সামলাত। ১৭৬১-৬২ থেকে ১৭৭০-৭১ পর্যন্ত কোম্পানির বাঙলা সুবায় ঋণ ছিল ১৩,৩৭,৭৩১ পাউন্ড। যদিও ব্রিটিশপন্থী অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলছেন, ১৭৮০রপর কোম্পানির লুঠ নাকি বন্ধ হয়ে যায়। অথচ নতুন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এই লুঠ ১৯৪৭ পর্যন্ত চলেছিল, শুধু ২৪ পরগণা জেলাতেই আয়-ব্যয়ের তুলনায় আয়ের পাল্লাছিল ছিল চারগুণ বেশি ভারি।
আগে যে আলোচনা করলাম তাকে সংক্ষেপিত করলে বোঝাযাবে যে চারটি পদ্ধতিতে বাঙলা থেকে লুন্ঠিত সম্পদ বাইরে বেরিয়ে যেতে থাকে ১) এদেশিয় সম্পদের মাধ্যমে কোম্পানির বেচাকেনার জন্য পণ্য কেনা, ২) চিনের বাণিজ্য ঘাটতি বাঙলার রাজস্ব থেকে মেটাতে হত, ৩) বাঙলা ছাড়াও অন্যান্য বোম্বাই-মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ব্যয়ও বাঙলা থেকে মোটাতে হত, সেখানের রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য পুঁজির যেগান যেত বাঙলা থেকেই ৪) যুদ্ধ বিগ্রহের জন্যও অর্থ জেগাত বাঙলা। আদতে যে লাভের উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে পা রেখেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, কোম্পানি স্থাপনের প্রায় দেড়শ বছর পর সেই উদ্দেশ্য সুদে আসলে উসুল করে নেয় কোম্পানির শাসক বাহাদুরেরা। ইংলন্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাথমিকভাবেই বাঙলার বাণিজ্য আর উদ্বৃত্ত রাজস্ব দিয়েই ব্রিটেন তার দেশের কলের চাকা ঘুরিয়েছে। শুধু ব্রিটেনই নয়, বৈদেশিক বাণিজ্যে, বিশেষ করে এশিয়ার ভারতচিনসহ নানান দেশের সঙ্গে বাণিজ্যকর্মে অধমর্ণ ইওরোপকে উত্তমর্ণ মহাদেশরূপে গড়ে তুলতে প্রাথমিক যোগদান দিয়েছে।
ইংরেজদের আগে অন্যান্য ভারতীয় সমাজেরমত বাঙলাও বহু কাল ধরে বহু লুঠেরা দেখেছে, সয়েছে, আবার নতুন করে সমাজ সাজিয়েছে। সব শেষের লুঠেরা ছিল মারাঠি বর্গীরা। তাদের মুখের হুঙ্কার রূপি দেহি বাঙলার সমাজে সমাজে ছড়িয়ে যায়। রূপি না পেলে বর্গীরা নাকে জলভরারমত নানান প্রাণকাড়া অত্যাচার করত। লুঠেপুটে যা পেত ঘোড়ায় চাপিয়ে নিয়ে যেত মারাঠা মুলুকে। কিন্তু সুসভ্য ইংরেজরা সব লুঠেরার বাড়া। তারা লুঠের পরও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। তাদের অত্যাচারী শাসন আর বিত্তবাসনা আকাশের সীমানাকেও হার মানায়। পলাশির দেড় দশক পর ক্লাইভ পার্লামেন্টে ইমপিচমেন্টের উত্তরে সদম্ভে বলতে পারেন – ‘A great price was dependent on my pleasure, an opulant city lay at my mercy; its richest bankers bid aginst each other for my smiles; I walked through vaults which were thrown open to me alone, piled on either hand with gold with jewels! Mr. Chairman, at this moment I stand astonoshed at my own moderation.’ শাসকদের মডারেশনই বটে। ক্লাইভের বামহাতের খেলা অথবা হেস্টিংসের অনৈতিক ব্যবসায় অর্জিত সম্পদের এতই অস্বস্তি আজকের ইংলন্ডে বর্তমান যে, যে মানুষদুটির হাত ধরে নগণ্য এক মহাদেশ আজ বিশ্বে অগ্রণী সভ্যতার তকমা অর্জন করল, তাদের একটিও মূর্তি অথবা রাস্তার নাম নেই লন্ডন শহরে। শহরটি যেন বেমালুম ভুলেগেছে ক্লাইভ অথবা হেস্টিংসেরমত নিজেদের জীবন বাজি রেখে একদা ইওরোপের ভাগ্য ফেরাবার ব্রিটিশ কলাকুশলীদের।
No comments:
Post a Comment