(পলাশীপূর্ব পর্ব সমাপ্ত হল। এবারে পলাশীর পরের লুঠ)
বিদেশিদের অর্থলোভ আর দস্যুবৃত্তির সংগে বাংলা সুবার রায়তরা খুব বেশি অপরিচিত ছিল না। বছর পনের আগেই অর্থের জন্য বাংলায় হানা দিয়েছিল। রূপি না পেলে বর্গিরা নাকে জল ভরে দিত ঠিকই, কিন্তু বিত্তবাসনায় তারাও ইংরেজদের সমকক্ষ ছিল না। তারা যা পেত লুঠে নিয়ে চলে যেত। কিন্তু ইংরেজরা এদেশে এসেছে ইওরোপের বাণিজ্য অধমর্ণতা ঘোচাতে। তারা যা পায় তা নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিল না। তাদের অর্থবাসনা এতই অপরিসীম যে যে ক্লাইভ আজকের হিসেবে জানা ঘুষে ১২২৮ কোটি টাকা নিয়েছে, অজানা লুঠে কত কে জানে, যে পনের বছর পর পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলছে, ‘আই ওয়াকড থ্রু ভল্টস হুইচ ওয়ার থ্রোন আপন টু মি আলোন, পাইল্ড অন ইদার হ্যান্ড উইথ গোল্ড এন্ড জুয়েলস! মিস্টার চেয়ারম্যন, এট দিস মোমেন্ট আই স্ট্যান্ড এস্টনিশড এট মাই ওন মডারেশন!’ মডারেশনই বটে!
বর্গিরা মুর্শিদাবাদে হানা দিয়ে যা পেয়েছিল ঘোড়ায় চাপিয়ে নাগপুর নিয়ে গিয়েছিল। ক্লাইভ তার বদলে লুঠের পাকাপাকি ব্যবস্থা বানিয়ে ফেল্ল। আগে ইওরোপ থেকে ধরত্ন বোঝাই জাহাজ আসত বাংলার বন্দরে, এবারে মুর্শিদাবাদ থেকে বছরে বছরে শয়ে শয়ে ধনরত্ন বোঝাই নৌকো মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা সেখান থেকে ইওরপে যাওয়া শুরু করল। মীরজাফর প্রতিশ্রুত তিন কোটি টাকা দিয়ে এই লুঠের দস্যু বৃত্তি শুরু হল। তারপর বছর বছর উসুল। এই ব্যবস্থায় লাভের গুড় সব থেকে বেশি খেল ক্লাইভ নিজে, সে বাবার কাছে লিখল, ‘জাফর আলি খান(মীর জাফর) যে উপকার পেয়েছেন তার বদলে সরকারি ও বেসরকারি খাতে তিন কোটি টাকা দিতে সম্মত হয়েছেন – অর্ধেক আমার হাতে এসেগেছে। তার বদান্যে আম দেশে এমন ঠাঁটে থাকতে পারব যা আমার স্বপ্নের অতীত। বাকি টাকাও এসে যাবে আশাকরি।... বোনেদের জন্য বিশ হাজার টাকা দিচ্ছি। তাদের বিয়ে দিয়ে দিও।... ভাইদের ব্যবস্থা করে দেবে। আপনারও উকিলি করার দরকার নেই।’
লুঠ লুঠ আর লুঠ। সিলেক্ট কমিটির সক্কলে অভূতপূর্ব ধনী হয়ে গেলেন। এডমিরাল ওয়াটসনের মৃত্যু হলে তিনি ফাঁকিতে পড়লেন, তার আত্মীয়েরা মামলা ঠুকলে বাঁহাতে ক্লাইভ কিছু উচ্ছিষ্ট দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করালেন।
এই বিপুল অর্থের যোগান বাংলার সমাজ বেশিদিন সইতে পারল না। ওপরতলায় সবার আগে আঘাত লাগল। মনসবদার, জমিদার ও সওদাগরেরা ভূপতিত হলেন। গোটা সমাজের কাঠামো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। পলাশীর দিনের লুঠের পরে তিন কোটি মেটাতে নবাবের খাজাঞ্চিখানার কোমর ভেঙ্গে গেল। সেনারা মাইনে না পেয়ে বিদ্রোহী হল। নবাবের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ ঘোষণা করল। তাদের দমন করতে গিয়ে ইংরেজদের ফৌজ ব্যবহার করলেন নবাব। গোরা আর তেলেঙ্গাদের সমস্ত খরচ বহন করতে হবে এই শর্তে এগিয়ে এলেন ক্লাইভ। বিদ্রোহীরা শায়েস্তা হল, কিন্তু যুদ্ধের খরচ মেটাবার টাকা কই? মীর জাফর বর্ধমান, নদীয়া এবং আরও কয়েকটি জেলার খাজনা ইংরেজদের তুলে দিলেন। নবাবী শাসনযন্ত্র সব অচল হয়ে গেল।
ক্লাইভের লোকেদের সংগে নবাবের আমীর বন্ধুদের রজ প্রায় হাতাহাতি হয় – একদিন বহুত জোর হল। পরের দিন তিনি এলে, বন্ধুকে নবাবকে বললেন, ‘ক্লাইভের লোকেদের সংগে আপনি ঝগড়া করছেন? জনাবের কি জানা আছে এই কর্নেল ক্লাইভ কে – জন্নাতের হুকুমে জাহানে তাঁর কি জায়গা?’ মির্জা শামসুদ্দিন সোজা উত্তর দিলেন, ‘কর্নেলের সংগে ঝগড়া করব আমি? যে রোজ সকালে উঠে তার গাধাটাকেও তিনি বার সিজদা না করে যে কোন কাজ করে না? কোন সাহসে আমি গাধাটার সওয়ারের সংগে লাগতে যাব?’ মীরজাফর, মহবৎ জং নামে পরিচিত হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ক্লাইভের গাধা নামে তার প্রসিদ্ধি হল। বারবার অপমানিত হতে হতে তিনি আত্মগ্লানিতে ভাং খেয়ে নেসায় সারাদিন ডুবে থাকতেন। নবাবি করতেন মীরণ।
ঐতিহাসিক গোলাম হুসেন তবতবায়ি পলাশিকে বলেছেন ইনকিলাব। এই ইনকিলাবের বিষে বাংলায় শিরদাঁড়াহীন নবাবের জন্যে বাংলা আস্তে আস্তে ইংরেজদের হাতে চলে যেতে শুরু করল। ইংরেজদের বেসরকারি বাণিজ্য একেবারে নিরঙ্কুশ হয়ে ওঠায় বাংলার গাঁয়ে গঞ্জে তাদের গোমস্তারা রাতারাতি কুঠি বানিয়ে দৌরাত্ম্য শুরু করল। রায়ত ব্যাপারী আর জমিদারেরা ত্রাহি ত্রাহি রব ছাড়তে শুরু করল। সেলাভিয়ার, টেক্সিরার মত কয়েকজন ইংরেজ রাণী ভবানীর রাজত্বে সব ব্যবসা দখল করে বসলেন – শুধু রাণীর এলাকা নয় সমস্ত বাংলায় জরুরি অবস্থা। রায়ত আর ব্যবসায়ীরা পালাতে লাগল। খাজনা আদায় ব্যর্থ হল। মীর জাফরকে সরিয়ে মীর কাসেম ক্ষমতায় এলেন।
ইংরেজ বণিকেরা জেলার ফৌজদারকে আটক করে মারধোর করেছে এমন নজির খুব ব্যতিক্রম নয়। কোম্পানির মাঝারি আমলা রিচার্ড বিচারের আত্মগ্লানি, ‘এই দেশটি চরম স্বেচ্ছাচারী সরকারের অধীনেও উন্নতি করেছে, এখন সে ধ্বংসের কিনারায়।’ পলাশীর মাত্র পাঁচ বছর পর ১৭৬২/১১৬৯র ২ মে নবাব মীরকাশিম গভর্নর ভ্যকান্সিস্টার্টকে যে চিঠি দিচ্ছেন, তাতে প্রশাসনিক নিষ্কাম এবং সর্বব্যাপী লুঠের অবয়ব পরিষ্কার হয়ে যায়, ‘এই হল আপনাদের ভদ্রলোকেদের ব্যবহার। আমার দেশে সর্বত্র তারা উপদ্রব করে, জনগণকে লুঠ করে আর আমার কর্মচারীদের অপমান ও জখম করে। ...প্রত্যেক পরগণা, গ্রাম ও ফ্যাক্টরিতে তারা লবণ, সুপারি, ঘি, চাল, খড়, বাঁশ, মাছ, চট, আদা, চিনি, তামাক, আফিম এবং অন্যান্য অনেক জিনিস কেনা বেচা করে। আমি আরও অনেক বস্তুর নাম করতে পারি, অপ্রয়োজনে বিরত হলাম। তারা বলপ্রয়োগ করে কৃষক ও বণিকদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রকারের পণ্য এক চতুর্থাংশ দামে ছিনিয়ে নেয়, আবার বলপ্রয়োগ ও অত্যাচারের মাধ্যমে একটাকার জিনিসের জন্য কৃষকদের পাঁচ টাকা দিতে বাধ্য করে। আবার পাঁচটি টাকার জন্য তারা এমনকে অপমান ও আটক করে, যে একশ টাকা ভূমিরাজস্ব দেয়। তারা আমার কর্মচারীদেরকে কর্তৃত্ব করতে দেয় না। প্রতি জেলাতে আমার কর্মচারীরা সমস্তরকমের কাজকর্ম থেকে বিরত আছে এবং স্মস্ত শুল্ক থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে আমার মোট বার্ষিক রাজস্ব ক্ষতির পরিমান দাঁড়াচ্ছে প্রায় পঁচিশ লক্ষ টাকা।’
এ হল পলাশী চক্রান্তের পাঁচ বছর পরের অবস্থা। এর পরে আমরা বাংলা লুঠপর্বে ঢুকব।
পলাশীপূর্ব বাংলা পর্ব সমাপ্ত হল।
No comments:
Post a Comment