রাষ্ট্র মদতে অবৈধ ব্যবসা, জ্ঞান চুরি আর ভারতের সনাতন সংস্কৃতি-সমাজ-অর্থনীতি-শিল্প পরিকাঠামো ভাঙার চক্র গড়ে উঠল জনগনের থেকে লুঠতরাজে আদায়ী রাজস্বের মাধ্যমে। দাদন প্রথাকে পরিহাসের স্তরে নামিয়ে এনে, ন্যুনতম পরিমান অর্থ অগ্রিম দিয়ে, ইওরোপিয় নীতিতে প্রায়দাসত্বপ্রথা চালিয়ে, কমদামে জোর করে উতপাদকদের কাছ থেকে দ্রব্য কেড়ে, সেই দ্রব্যের ব্যবসার ফলাও লাভের কারবার শুরু হল। বাঙলার ক্ষমতা দখলের পর থেকেই ব্রিটিশ শক্তি কোম্পানির রূপ ধরে ভারতের বাইরে বিশেষ করে প্রথমে ভারতের অন্যতম আর্থিক সম্পদশালী অঞ্চল, বাঙলা সুবা থেকে ধনরত্নসহ নানান সম্পদ ব্রিটেনে লুঠ করে ব্রিটেনের শ্রীবর্ধন করে বিশ্বধংসকরা মানুষমারা শিল্প বিপ্লব ঘটিয়েছে।
মনেরাখা দরকার, ১৮০০সনের আগে পর্যন্ত বাঙলা তথা ভারতবর্ষ ইওরোপ থেকে সাধারণ শিল্প দ্রব্য আমদানি করত না(ঘোড়া, সোনারূপো আর অভিজাতদের জন্য সামান্য কিছু ভোগ্য ছাড়া), বরং সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষ বিশ্বের নানান দেশকে শিল্পদ্রব্য যোগান দিয়ে এসেছে। দামাস্কাস তরোয়াল তৈরির জন্য ভারতের নানান অঞ্চলের ডোকরা কামারদের তৈরি ক্রুসিবল স্টিলএর পিণ্ডই হোক অথবা সমুদ্র যাত্রার জন্য নৌকোই হোক অথবা মসলিন বা ক্যালিকোরমত বস্ত্রই হোক, অথবা দৈনন্দিনের খাদ্যদ্রব্যের নুন মসলাই হোক। ভারতের নানান অঞ্চল বরাবরই ইওরোপকে প্রযুক্তিগত সাহায্য দিয়ে এসেছে, প্রযুক্তি রপ্তানি করেছে (ইওরোপ নানান সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান ভারত থেকে না বলে চুরিও করেছে)।
১৮০০সাল পর্যন্ত বহির্দেশিয় বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত দেশ ছিল ভারতবর্ষ। এই দেশগুলির উত্পাদন কিনতে তাই প্রাচীনকাল পর্যন্ত পশ্চিমি বাণিজ্যশক্তিকে সোনা-রূপা বয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে। যে সোনা বাণিজ্যের জন্য বিদেশিরা বাঙলায় বহন করে নিয়ে আসত, সেই সোনা আর বাঙলার বাইরে ফেরত যেত না। বাঙলার উত্পন্ন দ্রব্য রপ্তানি করে বাঙলা প্রচুর সম্পদ উপার্জন করত। অষ্টাদশ শতাব্দের শেষের দিকে আলেকজান্দার ডাও হুগলি বন্দরকে বক্স বন্দর – বক্সিদের দেখাশোনায় থাকা বন্দর - সব থেকে বড় শুল্ক চৌকি রূপে বর্ণনা করেছেন। পলাশীর সময়ে ক্রমশঃ কলকাতা নিঃসন্দেহে বাঙলার বড় বন্দর হয়ে উঠেছে।
প্রাক-পলাশী পর্যন্ত কোম্পানি ইওরোপ থেকে বাঙলায় সোনা-রূপো আসত। তাদের আমদানিকৃত মোট পণ্যের ৭৪ শতাংশ ছিল এই দামি ধাতু। পলাশির আগে কোম্পানি বাঙলায় বাণিজ্য করতে দামিধাতু আনত। সেই রূপো নবাবের মুর্শিদাবাদের টাঁকশালে বাটা দিয়ে মুদ্রায় পরিণত করে তাই দিয়ে রেশম, কাপড়সহ ইওরোপের নানান মহার্ঘবস্তু কেনা হত। কোম্পানির ভাষায় ইনভেস্টমেন্ট(ভারতের পণ্যদ্রব্য কিনতে যে অর্থ প্রয়োজন হত)এর অর্থ ব্যবসাযোগ্য হয়ে উঠত।
পলাশির পর থেকে আর এই সোনা আনার দরকার হল না। পলাশির পর লুঠ আর ঘুষ এবং বাঙলার খাজনা দিয়ে দেশেরই জিনিষ কিনে(অন্য নামে লুঠকরে) দেশে পাঠানোর নতুন বাণিজ্য নীতি গড়ে তুলবে ইংরেজরা। উচ্চমূল্যের এই ধাতুগুলি পূর্বের দেশগুলিতে বাণিজ্যের জন্য বয়ে আনার সহস্রাব্দ প্রাচীণ এই প্রবণতাটি গায়ের জোরে বদল আনল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাঙলা দখলকর্ম।
কোম্পানি শুধু দামি ধাতু আনা বন্ধ করল তাই নয়, প্রথমে গায়ের জোরে বাংলার সাধারণ ব্যবসার দখলদারি নিল। পরে বাঙলার শিল্প পরিকাঠামো ধংস করে নিজেদের দেশের পণ্যের বাজার তৈরি করল। তরল সময়ের রাজনৈতিক পরিবেশে অপরিমিত ঘুষের বন্যা বইল ইংরেজদের সিন্দুকে। এই তিনে মিলে কোম্পানির আমলারা এত অর্থ উদ্বৃত্ত তৈরি করে ফেলে যে, এর পর থেকে তাদের আর বাণিজ্য করতে ইওরোপ থেকে সোনা-রূপা বহন করে আনতে হয় নি, সে অর্থ দিয়ে তারা তিন বছরের ব্যাবসার পুঁজি জোগাড় করেফেলে। বাঙলায় ব্যবসার জন্য কোম্পানি ইওরোপ থেকে সোনা-রূপাসহ দামী ধাতু আনা বন্ধ করে দিল। ১৭৬৫র দেওয়ানির ফরমান হাতে আসার পর সেই আমদানি রপ্তানিতে পরিনত হল।
বাঙলায় না হয় ব্রিটিশরা রূপো আনা বন্ধ করে দেয় কিন্তু পলাশীর প্রায় ৪০ বছর পরও অব্রিটিশ নানান ইওরোপিয়রা ব্যবসা করেছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন তারা কী সে সময় রূপোর বিনিময়ে জিনিস কেনা বন্ধ করে দেয়! বাঙলায় সব থেকে বেশি সোনা নিয়ে এসে ব্যবসা করত ওলান্দাজরা। পলাশীর চক্রান্তের কয়েক বছর পরও তারা প্রচুর রূপো এনেছিল। ওলান্দজ ছাড়া দিনেমার, অস্ট্রিয় বা প্রসিয়, ফরাসি ব্যবসায়ীরাও বেশ ভাল পরিমানে রূপো আনত। সেই ইওরোপিয় রূপো আমদানিও বন্ধ হয়ে গেল ব্রিটিশ ভাইদের হাত ধরে।
ঘুষ আর অসাধু ব্যবসায় রোজগারের অর্থ, রাতারাতি নবাব বনে যাওয়া ব্রিটিশ ব্যবসায়ী আর কোম্পানির আমলাদের হাতে জমত। কোম্পানির নজর এড়িয়ে এই অর্থ ব্রিটেনে পাঠাবার একটিই উপায় ছিল- বিপুল সম্পদ অব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের ধার দেওয়া। সেই অর্থে অব্রিটিশিয় ব্যবসায়ীরা মাল কিনে দেশে পাঠাত। ফলে তাদেরও আর দেশ থেকে দামি ধাতুসব ভারতে আনার প্রয়োজন হল না। ব্রিটিশদের কাছ থেকে টাকা ধার করা বিদেশি ব্যবসায়ীরা নবোবদের ব্রিটেনে ভাঙানো যায় এমন হুন্ডি দিত। হেস্টিংসের বন্ধু বারওয়েল জানাচ্ছেন ১৭৬৫ থেকে ১৭৬৭ এই দুবছর, এই প্রথায় ওলান্দাজ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ব্রিটেনে কোম্পানির কর্মচারীরা বার লক্ষ পাউন্ড পাঠায়। ব্রিটিশ আমলাদের অতিরিক্ত রোজগারের বিনিয়োগ থেকে ওলান্দাজরা এত অর্থ জমিয়ে ফেলে যে, ১৭৬৮তে ব্রিটিশ কোম্পানির কলকাতা কাউন্সিল জানাচ্ছে, ওলান্দাজরা আগামী তিন বছর দেশ থেকে দামি ধাতু না এনেই ভারতে ব্যবসা করতে পারে। ফলে শুধু ব্রিটেনই নয় ইওরোপের নানান দেশের ব্যবসায়ীরা ব্রিটিশদের লুন্ঠন কর্মে উপকৃত হয়েছে।
এই কাজটি কিভাবে হয়েছে, তা তৎকালীন এক আমলা উইলিয়ম প্যাক্সটনের প্যাক্সটন ককরেল ট্রেল কোম্পানির ভারতে কাজকর্ম বিশদে আলোচনা করলে বোঝা যাবে। থেকে কিভাবে কোম্পানির কড়া নজরদারি আর আইন এড়িয়ে ব্যক্তিগত ব্যবসার লাভ লন্ডনে পাঠানো হত, তার একটা হাতে গরম উদাহরণ পাওয়া যায় প্যাক্সটন, ককরেক, ট্রেল নামক প্রথম এজেন্সি হাউসের অন্যতম মালিক স্কট দেশিয় উইলিয়ম প্যাক্সটন আর উইলিয়ম ককরেল উদ্ভাবিত নতুন ধরণের পদ্ধতি থেকে। নামে পরিষ্কার কোম্পানির প্রাথমিক নিয়ন্ত্রণ ছিল বাংলার ট্যাঁকশাল কর্তা উইলিয়ম প্যাক্সটনের হাতে। তাঁর সহায়ক হয়েছিলেন কোম্পানির উচ্চস্তরের যোগাযোগ নিয়ে ককরেল। লন্ডনে ভারত থেকে আমলাদের বেআইনি ব্যবসার বেআইনি সম্পদ পাঠাবার কাজের আইনি সূত্র আবিষ্কার করেন কোম্পানির দুই আমলা প্যাক্সটন এবং ককরেল উভয়েই।
No comments:
Post a Comment