তৃতীয় অভিযোগ হল হিন্দুদের ওপর নির্যাতন। সালিমুল্লাহ তারিখিবাংলায় জানিয়েছেন, হিন্দু-জমিদার ঠিক সময়ে খাজনা না দিতে পারায় মুর্শিদকুলি তাদেরকে ইসলাম-গ্রহণে বাধ্য করেছিলেন – এই বিষয়টাকে ধরে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা নিজের মত মনগড়া গল্প সাজিয়ে পলাশীপূর্ব বাংলাকে বদনাম করার কাজ করে গিয়েছেন। অথচ সালিমুল্লাহ তার গ্রন্থে একটাও ধর্মপরিবর্তনের উদাহরণ দেন নি। সমকালীন কোন গ্রন্থে এ ধরণের কোনও উদাহরণ দেখা যায় না।
একটা ধর্মপরিবর্তনের উদাহরণ পাওয়া যায়, কিন্তু সেটা আবার মুর্শিদকুলির পক্ষে যায়। চুনাখালির জমিদারকে কাজী সরফ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। বৃন্দাবন তার বাড়ির সামনে একটি উন্মাদ ফকিরের তৈরি খেলনা মসজিদ ভেঙ্গেছিলেন। এই অপরাধে তার প্রাণদণ্ড। প্রধান কাজী সরফএর সংগে এই প্রাণদণ্ড নিয়ে যতদূর সম্ভব মুর্শিদকুলির বিরোধ দেখা দেয়। মুর্শিদকুলি এই প্রাণদণ্ডের বিরুদ্ধে আওরঙ্গজেবকে আবেদন করেন। এর পরে কাজী বাংলার প্রধান কাজীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
তার বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ তিনি নিজের সমাধিস্থল আর মসজিদের স্থানের জন্য মন্দির ভেঙ্গেছিলেন। এ অভিযোগও হয়ত সত্য নয়। তাঁর কর্মচারী অতিউতসাহে কোন বাড়াবাড়ি করে থাকেতে পারেন। কিন্তু মুর্শিদাবাদের কাছাকাছি মন্দিরগুলো অক্ষত ছিল। বিশেষ করে কিরীটেশ্বরী মন্দির আজও টিকে আছে। ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গলে আলিবর্দির বিরুদ্ধে ভূবনেশ্বরে মন্দির লুঠের অভিযোগ এনেছেন। এটাও কতদূর সত্য বলা মুশকিল। ভারতচন্দ্র নিজে কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি। খাজনা না মেটানোর দায়ে কৃষ্ণচন্দ্রকে কয়েদ করেন আলিবর্দি। ফলে ভারতচন্দ্র হয়ত রুষ্ট হয়েছিলেন।
গঙ্গারাম তার মহারাষ্ট্রপুরাণে মুসলমান শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ক্ষোভের কথা মোটামুটি বাড়িয়ে চড়িয়ে লিখেছেন। মারাঠারা নাকি হিন্দুদের উদ্ধারের জন্য বাংলায় এসেছিল। কিন্তু তাঁর বয়ানেই পাচ্ছি কি করে মারাঠা দস্যু লুঠেরারা বাংলার হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে মানুষএর সম্পত্তি লুঠ খুন জখম অগ্নিকাণ্ড করেছে। গঙ্গারাম জানিয়েছেন বাংলার হিন্দুদের ত্রাণকর্তাদের বিরুদ্ধে বাংলার হিন্দুরা, বিপন্ন মুসলিম শাসনের পিছনে দাঁড়িয়ে মারাঠাদের বাংলা ছাড়া করার লড়াই করেছিল।
বাড়াবাড়িযে কিছু হয় নি এটা দাবি করা অনুচিত এবং অনৈতিহাসিক। কিন্তু ব্রিটিশরা যে খুন লুঠ অত্যাচার করে বাংলার সম্পদ জ্ঞান লুঠ করে নিয়ে গিয়েছিল সাগরপারে নিজেদের দেশ সাজিয়ে তুলতে রাষ্ট্রীয় মদতে, অন্তত সে সময় বাংলার নবাবদের পরিচালনায় ধর্মান্তরকরণ বা অত্যাচার রাষ্ট্রের নীতি ছিল না, এ কথা সরাসরি বলা যায়।
মুর্শিদকুলি থেকে সিরাজ পর্যন্ত নবাবেরা বিপুল পরিমান অমুসলিমকে রাষ্ট্রের প্রশাসানে বসানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা সে সময়ের রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকেই সুস্পষ্ট করে। সালিমুল্লাহ অভিযোগ করেছেন হিন্দুরা ছাড়া মুর্শিদকুলি অন্য কাউকে রাজস্ব বিভাগে চাকরি দিতেন না। তার যুক্তি, ভিতু সরল আর নিরীহ বলে নবাবেরা অমুসলিমদের রাজস্ব বিভাগে একচেটিয়া চাকরি দিতেন। রাজস্ব বিভাগে আসা টাকা তছরূপ করলে সহজেই অমুসলিমদের শাস্তি দেওয়া যাবে, চিহ্নিত করা যাবে। এরা তার কর্তৃত্বের ওপর আঘাত হানতে ইচ্ছুক ছিল না। আদতে তার সময়ে উত্তর পশ্চিম ভারত থেকে প্রশাসনে লোক নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়, সেখানে নতুন রাজবংশ স্থাপনের কারণে। পারস্য পশ্চিম এশিয়া আফগানিস্তানইত্যাদি অঞ্চল থেকে বাংলায় ভাগ্যান্বেষী আসা বন্ধ হয়ে যায় নানা কারণে। ফলে বাংলার প্রশাসনে হিন্দুদের নিয়োগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এবং স্থানীয়দের তিনি উপেক্ষা করেন নি। সুজাও একই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। গোলাম হোসেন আলিবর্দিকে আখ্যায়িত করছেন যে তিনি বাংলার হিন্দু-মুসলমান যৌথ পরিবারের প্রধান। অথচ হিন্দুদের প্রতি তাঁর পক্ষপাত বেশি। সামরিক বা প্রশাসন উভয় ক্ষেত্রে তিনি হিন্দুদের নিয়োগ করতেন। আবার লাহোরিমল্ল ও দলিপ সিংহকে তিনি পাঠিয়েছিলেন হিন্দু জমিদারদের দমন করতে। নন্দলাল, রাজা জানকীরাম, দুর্লভরাম, রামনারায়ণ প্রভৃতি তার সেনাবাহিনীর সেনাপতি ছিলেন। উচ্চপদস্থ হিন্দুরা নবাবদের অধীনে বহু যুদ্ধ করেছেন। মাণিকচাঁদ, দুর্লভরাম, মোহনলাল, শ্যামসুন্দর লালার মত হিন্দু সেনাপতির নাম পাওয়া যায়।
অভিযোগ, সরফরাজকে পরাজিত করে আলিবর্দি যখন সিংহাসনে আরোহন করেন, তখন তিনি পূর্বসূরীর আমলাদের ক্ষমতায় রাখা জায়েজ মনে করেন নি। তার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আশংকা থাকে। ফলে তিনি কাঁতা সরাতে হিন্দুদের নিয়োগ করেন। কিন্তু আলিবর্দি ছিলেন সরফরাজের থেকে অনেক বেশি যোগ্য প্রসাসক। তিনি সরফরাজের সেনার ওপর নির্ভর করেন নি। তাঁর নিজস্ব সেনাবাহিনী তাঁর সাসনকে নিশ্চয়তা দিয়েছিল। কূটনৈতিক এবং প্রসাসনিকভাবে তিনি সরফরাজীয় পক্ষকে মোকাবিলা করেন। সুবার সংখ্যাগুরুকে দূরে রেখে তাঁর রাজত্বের এবং বংশের স্থায়িত্ব দেখেন নি। এবং এবাবদে তারা সকলে মোগল আমল থেকে চলে আসা রীতিকেই পালন করে গিয়েছেন।
No comments:
Post a Comment