বাঙ্গালার ইতিহাস- প্রথম খণ্ড
...দ্বিতীয় শূরপালদেব কোন সময়ে সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন, কত দিন রাজ্য করিয়াছিলেন এবং কিরূপে তাঁহার রাজ্যের অবসান হইয়াছিল, তাহা জানিবার কোন উপায় নাই। সন্ধ্যাকরনন্দী এই বিষয়ে নীরব। ‘রামচরিত’এ শূরপালের সিংহাসন-লাভের, তাঁহার রাজ্যকালীন ঘটনার এবং তাঁহার মৃত্যুর বিবরণের অভাব দেখিয়া অনুমান হয় যে, রামপাল কোনও উপায়ে শূরপালকে সংহার করিয়া পৈত্রিক রাজ্যাধিকার প্রাপ্ত হইয়াছিল। শূরপালের পরে রামপাল গৌড়-রাজ্যের অধিকার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। রামপালের অভিষেককালে পাল-রাজগণের অধিকার বোধ হয় ভাগীরথীর ও পদ্মার মধ্যস্থিত ব’দ্বীপে সীমাবদ্ধ হইয়াছিল; কারণ রামপালকে দিব্বোকের রাজ্য উত্তরবঙ্গ অধিকারের জন্য ভাগীরথীর উপরে নৌমেলক বা নৌসেতু বন্ধন করিতে হইয়াছিল(মেমরিজ অব এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল, ভল ৩, পৃ১৪)। রামপাল, শূরপালের মৃত্যুর পরে যখন গৌড়-সিংহাসন-লাভ করিলেন, তখন দিব্ব্যোকের ভ্রাতুষ্পুত্র ভীম গৌড়-সিংহাসনে অধিষ্ঠিত। দিব্বোকের পরে বোধ হয়, তাঁহার ভ্রাতা রূদোক গৌড়-রাজ্যের অধিকার প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। রূদোকের পুত্র ভীম উত্তরাধিকারসূত্রে উত্তরবঙ্গের সিংহাসনে আরোহন করিয়াছিলেন(সা ভূমি অভিখ্যয়া নাম্না বরেন্দ্রী ত্রস্তা অস্য দিব্বোকস্য যো অনুজো রূদোকঃ তদীয়তনয়স্য ভীমনাম্নঃ রন্ধ্র প্রহরিণঃ ক্রিয়াক্ষমস্য অলংকর্ম্মীণস্য যথোক্তক্রমেণ রক্ষণীয়া ভূৎ। স তত্র ভূপতিঃ বর্তমানঃ।। - কৈবর্তনায়ক দিব্বোক সম্ভবঃ প্রথমে পাল-রাজগণের ভৃত্য ছিলেন। ‘অতএব কান্তা-কমনীয়া দিব্যোহ্বয়েন দিব্যনাম্না দিব্বকেন মাংসভূজা লক্ষ্যা অংশং তুঞ্জানেন ভৃত্যেনোর্চ্চৈদেশকেন উচ্চৈমহতী দশা অবস্থা যস্য অত্যুচ্ছ্রিতেনেত্যর্থ্যঃ দস্যুনা শত্রুণা তদ্ভাবোপন্নত্বাৎ অবশ্যকর্তব্যতয়া আরব্ধং কর্ম্ম ব্রতং ছদ্মনি ব্রতী – রামচরিত, ১.৩৮ টীকা)। সেই সময়ে রামপাল অত্যন্ত হতাশ হইয়া পড়িয়াছিলেন।(অতিশয়েন বিনাশী বিনাশিতমঃ স্বারির্যাভ্যাং যযোবা তৌ সমূচ্চয়ে ভুজৌ বিপক্ষাক্ষিপ্তভুজ্যমানভূমিত্বাৎ বিফলৌ দবৎ। উপগতা ইষ্টতমা মিত্রাণি মাতৃবান্ধবো যস্য সসুতঃ, ধাম শৌর্য্যং স্বং শূন্যং মিথ্যা কলিতমান – রামচরিত, ১।৪০)। তাঁহার পুত্র রাজ্যপাল ও অমাত্যগণ সর্ব্বদা কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য সম্বন্ধে তাঁহার সহিত পরামর্শ করিতেন(সধ্যা অমাত্যেন সুনুনা সুতেন চ সহ কৃতৌ পরমৌ মহান্তৌ উহাপৌহোয় ইদং কর্তব্যম ইদং ন কর্তব্য ইত্যাদিকৌ যেন স্থিরতত স্থিরসম্বিতঃ কৃতনিশ্চয়ঃ উত্থানং উদ্যমং লব্ধবান।। রামচরিত, ১.৪২ টীকা)। তদনন্তর রামপাল সাম্রাজ্যের প্রধান সামন্তগণের সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য কিয়দ্দিন পর্য্যটন করিয়াছিলেন এবং আটবিক, অর্থাৎ - বনময় প্রদেশসমূহের সামন্তগণের সহিত মিত্রতা স্থাপন করিয়াছিলেন(রামপালেন সাম্নতচক্রং প্রণিনীষুণা পৃথ্ব পর্য্যটিতা তত্র ব্যালা আগ্রহারকা বৈষয়কা আটবীয়সামন্তাঃ উর্বীভৃদ্রাজা। ইষ্টার্থোহভিলষিতার্থঃ। - রামচরিত, ১।৪৩)। পর্যটনান্তে রামপাল বুঝিতে পারিলেন যে, সাম্নতগণ তাঁহার ব্যবহারে সন্তুষ্ট হইয়াছেন(সহ সম্বধার্থং সামন্তব্রজং বক্ষমানায়কং অন্বয়াস্যাভুদয়স্য ভবনং অবিতনয়ং গূঢানীতিং মিত্রকোটিপ্রবিষ্টং স রামপালোহনুমেনে। - রামচরিত, ১।৪৪)। তদনন্তর তিনি পদাতিক, অশ্ব ও গজারোহী সেনা সংগ্রহ করিলেন। এই সময়ে তাঁহার নদীতীরস্থিত বহু ভূমি ও বিপুল অর্থ দান করিতে হইয়াছিল(দেবেনভুবো বিপুলদ্রবিণস্য চ দান্তঃ-সুখাচক্রে।/ অমূনা হরিনাগপদাতিলব্ধবহলত্রভাবোহসৌ।।/ অন্যত্র অমুনা দেবেন রাজ্ঞাহসৌ সামন্তব্রজঃ হরয়োহশ্বা নাগা হস্তনঃ পদাতয়ঃ এভির্লব্ধো বহলঃ প্রভাবো যেন তাটকভুবো ভূমের্বিপুলস্য ধনস্য চ দান্তস্ত্যাগাৎ অনুকূলিতঃ। - রামচরিত, ১।৪৫)।
ত্রিবিধ সেনা সংগৃহীত হইলে রামপালদেবের মাতুলপুত্র রাষ্ট্রকূটবংশীয় শিবরাজদেব সেনা লইয়া রামপালের আদেশে গঙ্গা পার হইয়াছিলেন(তরসাবলেন শিবরাজনাম্না মহাপ্রতীহারেণ রাষ্ট্রকূট্মাণিক্যেন অস্য রামপালেস্য ভর্ত্তুরাষ্ণয়া হিতৈষিণা আশু শীঘ্রং গজেন বলবতা সৈন্যবতা তুরঙ্গপুঙ্গবৈ খ্যাতং শৌর্য্যং যস্য। খরগু তীক্ষ্ণরশ্মিস্তস্যেব রুগ দীপ্তীর্যস্য সূর্য্যবত্তে জস্বিনেত্যার্থঃ।। রণো যুদ্ধং তত্রত্যবিক্রমেণ দীর্ণঃ ভীত ইন্দ্রো উস্মাৎ কেশরিকিশোরসদৃশেন শোভাম্বীতেন পঞ্চাঙ্গ-প্রসাদালঙ্কারেণ মহাতটিনী গঙ্গা লংঘিতা। - রামচরিত, ১।৪৭)। মহাপ্রতীহার শিবরাজদেব কৈবর্ত্তরাজ্যে অবস্থিত বিষয় ও গ্রামগুলি ভীমবেগে আক্রমণ করায় ভীমের প্রজাগণ বিপন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। দেবব্রাহ্মণাদির ভূমি রক্ষা করিবার জন্য শিবরাজ ‘ইহা কোন বিষয়, ইহা কোন গ্রাম’ ইত্যাদি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। শিবরাজ বরেন্দ্রী হইতে ভীম কর্তৃক নিযুক্ত রক্ষকগণকে দূর করিয়া দিয়াছিলেন এবং রাজসমীপে প্রত্যাগমন করিয়া রামপালকে জানাইয়াছিলেন যে, তাঁহার পিতৃভূমি শত্রুমুক্ত হইয়াছে। শিবরাজ কর্তৃক বরেন্দ্রী অধিকার বোধ হয় দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় নাই, কারণ, ইহার অব্যবহিত পরেই রামপালকে বহু সেনা সমবিব্যহারে পুনরায় বরেন্দ্রী আক্রমন করিতে হইয়াছিল। বারেন্দ্র-অভিযানে নিম্নলিখিত সামন্তগণ রামপালের অধীনে যুদ্ধার্থে গমন করিয়াছিলেন; মগধ এবং পীঠীর অধিপতি ভীমযশঃ, কোটাটবীর বীরগুণ, দণ্ডভুক্তিরাজ জয়সিংহ, দেবগ্রামপ্রতিবদ্ধ বালবলভীর বিক্রমরাজ, অপরমন্দারের অধিপতি এবং আটবিক সামন্তচক্রের প্রধান লক্ষ্মীশূর, কূজবটীর শূরপাল, তৈলকম্পের রুদ্রশিখর, উচ্ছলের অধিপতি ময়গলসিংহ, ঢেক্কীয়রাজ প্রতাপসিংহ, কয়ঙ্গমঙ্গলের অধিপতি নরসিংহার্জ্জুন, শঙ্কট গ্রামের চণ্ডার্জুন, নিদ্রাবলের বিজয়রাজ, কৌশম্বীপতি দ্বারপরবদ্ধন, পাদুম্বার সোম। এতদ্বীত রাজ্যপালাদি রামপালগণের পুত্রগণ পিতার সহিত যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিলেন। রামপালের মাতুল রাষ্ট্রকূটবংশীয় মথনদেব বা মহনদেব, মহামাণ্ডলিক কাহ্নুরদেব ও সুবর্ণদেব নামক পুত্রদ্বয় এবং ভ্রাতুষ্পুত্র মহাপ্রতীহার শিবরাজদেবের সহিত রামপালের যুদ্ধাভিযানে যোগদান করিয়াছিলেন।
No comments:
Post a Comment