পলাশীর শোষণ
নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহ এনালস উল্লেখ করে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলছেন, ...১৭০৮খৃঃ-১৭৫৬খৃঃ পর্যন্ত বাংলায় ইংরাজ কোম্পানীর আমদানী পণ্যের শতকরী ৭৪ ভাগই ছিল স্বর্ণ এবং ইহার পরিমান ছিল ৬৪,০৬,০২৩ পাউন্ড। ইংরাজ কোম্পানীর কথা ছাড়িয়া দিলেও, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ বাংলার অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য উভয়ই বেশ উন্নতিশীল ছিল। হিন্দু, আর্মানী এবং মুসলমান বণিকেরা ভারতের অন্যান্য প্রদেশ এবং আরব, তুরস্ক ও পারস্যের সঙ্গে প্রভুত পরিমাণে ব্যবসা চালাইত। কোম্পানীর কর্মচারীরা ভারত হইতে প্রভূত ধন সঞ্চয় করিত এবং বিলাতে ফিরিয়া অসদুপায়ে লব্ধ সেই ঐশ্বর্যে নবাবী করিত। তাহারা যতদূর সম্ভব জাঁকজমক ও বিলাসিতার মধ্যে বাস করিত। সমসাময়িক ইংরাজী সাহিত্যে এই সব নবাবদের বিলাস-ব্যসনের প্রতি তীব্র শ্লেষ ও বিদ্রুপ আছে- রিচ ইন দ্য জেমস অব ইন্ডিয়াজ গাউডি জোন, এন্ড প্লান্ডার, পাইলড ফ্রম কিংডমস নট দেয়ার ওন। ...ক্লাউড স্ট্যাম্প ডিসগ্রেস অন ম্যানস পলিউটেড নেম, এন্ড বার্টার, উইথ দেয়ার গোল্ড, ইটারনাল শেম।
১৭৫৭ হইতে ১৭৮০ পর্যন্ত ভারত হইতে (সরাসরি) যে ধন ইংলন্ডে শোষিত হইয়াছিল তাহার পরিমান ৩ কোটী ৮০ লক্ষ পাউন্ডের কম নহে। ...১৭৬৬ খৃষ্টাব্দে লর্ড ক্লাইভ পার্লামেন্টারি কমিটির সম্মুখে তাঁহার সাক্ষে বলেনঃ- মুর্শিদাবাদ সহর লন্ডন সহরের মতই বিশাল, জনবহুল ও ঐশ্বর্যশালী। প্রভেদ এই যে, প্রথমোক্ত সহরে এমন সব প্রভূত ঐশ্বর্যশালী ব্যক্তি আছেন, যাঁহাদের সঙ্গে লন্ডনের কোন ধনী ব্যক্তির তুলনা হইতে পারে না। কিন্তু ২৫ বত্সরেই ঐ মুর্শিবাদ সহরেরর অবস্থা গজভুক্ত কপিত্থবত্ হইয়াছিল। পলাশীর শোষণের ফলে সর্বত্র ধ্বংসের চিহ্ন পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছিল। তিনি ডিন ইনজের আউটস্পোকন এসেজএর কথা উল্লেখ করছেন, বাংলাদেশের ধনলুণ্ঠনের ফলেই প্রথম প্রেরণা আসিল। ক্লাইভের পলাশী বিজয়ের পর ৩০ বত্সর ধরিয়া বাংলা হইতে ঐশ্বর্যের স্রোত বহিয়া আসিয়াছিল। অসদুপায়ে লব্ধ এই অর্থ ইংলন্ডের শিল্প বাণিজ্য গঠনে শক্তি যোগাইয়াছিল। ১৮৭০খৃষ্টাব্দের পরে ফ্রান্সের নিকট হইতে লুণ্ঠিত পাঁচ মিলিয়ার্ড অর্থ জর্মানীর শিল্প বাণিজ্য গঠনে এই ভাবেই সহায়তা করিয়াছিল।
১৮৮৬ সালের ব্রহ্ম বিজয়ের ফলও ঠিক এইরূপ হইয়াছিল। ২০ বত্সর পর্যন্ত এই দেশ তাহার শাসন ব্যয় যোগাইতে পারিত না এবং অন্যান্য প্রদেশ সে জন্য অর্থ সংগ্রহ করিতে হইত। কিন্তু উত্তর ব্রহ্মবিজয়ের পূর্বেও দক্ষিণ বা নিম্ন ব্রহ্মও তাহার শাসন ব্যয় যোগাইতে পারিত না। গোখেল বলেন যে, প্রায় ৪০ বত্সর ধরিয়া ব্রহ্মদেশ ভারতের শ্বেতহস্তীস্বরূপ ছিল এবং ইহার ফলে বর্তমানে(২৭মার্চ, ১৯১১) ভারতের নিকট ব্রহ্মদেশের ঋণ প্রায় ৬২ কোটী টাকা। কিন্তু এই বিপুল অর্থের প্রধান অংশই বাংলাকে বহন করিতে হইয়াছিল। ইহার কীরন শুধু লবনের উপর শুল্কবৃদ্ধি নয়, ভারত গবর্ণমেন্টের রাজকোষে বাংলাই সবথেকে বেশী টাকা দেয়। ...বাঙলার ভূতপূর্ব লেঃ গভর্ণর স্যার আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জি ১৮৯৬ সালে ইম্পিরিয়াল বাজেট আলোচনার সময় বলেন, - এই প্রদেশরূপী মেষকে মাটিতে ফেলিয়া তাহার লোমগুলি নির্মূল করিয়া কাটিয়া লওয়া হইতেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত পুনরায় রোমোদ্গম না হয়, ততক্ষণ সে শীতে থর থর করিয়া কাঁপিতে থাকে(অবশ্য রোমোদ্গম হইলেই পুনরায় উহা কাটিয়া লওয়া হয়।)
No comments:
Post a Comment