গ্রাম সমাজের সঙ্গে ভাঙল সমাজের নিজস্ব শিক্ষা পরিকাঠামো
পাঠশালাগুলো গ্রামের নানান শ্রেণীর মানুষের বংশপরম্পরায় চাষী, কর্মকার, শিল্পী আর ব্যবসায়ীদের শিক্ষা কেন্দ্র। সমীক্ষার পাঁচ বছর আগে ৭ নভেম্বর, ১৮৩০এ চার্লস মেটকাফ মিনিট অন দ্য সেটলমেন্ট ইন ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স-এ বলছেন, Hindoo, Patan, Mogul, Mahratta, Sikh, English, are all masters in turn; but the village community remains same…. The sons will take place of their fathers’ the same sight for the village, the same position for the houses, the same land will be reoccupied by the decedents of those who were driven out when the village was depopulated… The union of the village comities, each one forming a separate little state in itself, has ….contributed more than any other cause to the preservation of the people of India through all the revolutions and changes which they have suffered, and is in a high degree conducive to the happiness, and to the enjoyment of a great portion of freedom & independence.
প্রত্যেক গ্রামসমষ্টি যেন এক একটি স্বনির্ভর ভৌগোলিক এলাকা। বংশপরম্পরায় জন্মস্থানে বসবাসের সুখানুভূতিতে কৃষির সঙ্গে কর্মশালার মেলবন্ধন গড়ে উঠেছিল। অন্যান্য সমাজের সঙ্গে আত্মীয়তার গর্ব, নিজের হাতে কাজের গর্ব, নিজের গ্রামের প্রতি গর্ব, নিজগোষ্ঠীতে থেকে কাজের আত্মিকতার গর্ব, গ্রামকৌমের ভালবাসার গর্ব এবং আত্মনির্ভর গ্রামগোষ্ঠীর গর্ব ছিল বাঙলার অর্থনীতির ভিত্তি। শিল্পীদের নিত্যনতুন গবেষণায় বিকাশ হত সেচ সেচ, তাঁত, ধাতু, চাষসহ হাজারো নিত্যনতুন প্রযুক্তি। কৃষি আর শিল্পের বিকাশে গ্রাম পঞ্চয়েতের বড় ভূমিকা ছিল। পঞ্চায়েত নিজের রোজগারে ব্যবস্থা, সাধারণ পতিত জমি উদ্ধারেরমত নানান পরিকাঠামো বিকাশে অংশ নিত। তাই পলাশির কয়েক দশক পরেও নানান ব্রিটিশ-মধ্যবিত্তবাঙালির অভিচার সয়ে উদ্বৃত্ত অর্থনীতি দেশ ছিল বাঙলা সুবা।
এডাম বলছেন বাঙলায় প্রায় প্রত্যেক প্রান্তে দেশিয় পাঠশালার অস্তিত্ব ছিল, প্রত্যেক গ্রামেই হয়ত ছিল না। প্রত্যেক অঞ্চলের বিদ্যালয়ের শিক্ষা কাঠামো, পাঠদান বা অন্যান্য পরিকাঠামো আলাদা আলাদা। গড়ে উঠত সেই অঞ্চলের প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে। তখোনো বাংলার শিক্ষাব্যবস্থায় কেন্দ্রিকতা গড়ে ওঠেনি। মগধে পড়ানো হত তুলসিদাসী রামায়ণের নানান ঘটনাবলী নির্ভর দান লীলা, সুদামা চরিত, রাম জনম। বাংলায়ও অনেকটা তাই পড়ানো হত। তবে ভাষা বাংলা। ত্রিহুতের শিক্ষার মাধ্যম ছিল মৈথিলি বা ত্রিহুতিয়া। এই উচ্চ পাঠশালাগুলোতে সংস্কৃত বা পারসিক মাধ্যমে পড়ানো হত না। বাংলার গ্রামে গ্রামে দেশি ভাষায় পড়ানোর একটি অকেন্দ্রিক অথচ সুসংগঠিত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ শাসন আমলের অনেক আগে থেকেই। কারা, কী পড়তেন! এডাম বলছেন, “Commercial accounts... are chiefly acquired by the class of money-lenders and retail traders, agricultural accounts... by the children of those families whose subsistence is exclusively drawn from the land, and both accounts by those... who expect to gain their livelihood as writers, accountants, etc.
সরকারই জনগণের একমাত্র এজেন্ট, এমন ইওরোপিয় নিদান গ্রামকৌমের অজানা ছিল। বাঙলার জনগণ তখনও সামাজিক সব কাজ আমলা-রাজনীতিক-বড়ব্যবসায়ীদের আউটসোর্স করে দেয় নি। পাঠশালা সহ নানান পরিকাঠামো চালাবার, দেখাশোনার সম্পূর্ণ দায় ছিল গ্রামকৌমের। একলাখ পাঠশালায় গুরুমশাইদের কখোনো অর্থে, কখোনো পণ্যে বিদায় দেওয়া হত। "indigenous elementary schools... are those ... in which instruction in the element of knowledge is communicated, and which have been originated and are supported by the natives themselves, in contradistinction from those that are supported by religious or philanthropic societies"।
মার্ক্স বলেছেন বাংলায় হিন্দু-মুসলসমানের মুখ দেখাদেখি ছিলনা(চব্বিশ পরগণা থেকে জলপাইগুড়ি বাঙলায় পাগান দেবতা সত্যপীর(নারায়ন + পীর) আজও পুজিত)। উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণের ছায়াও মাড়াত না। এডামের সমীক্ষায় পাচ্ছি, এই পাঠশালাগুলোর পড়ুয়েদের মধ্যে নানান ধর্ম, বর্ণ আর জাতির শিশু পাঠ নিত। এক সঙ্গে বসে। আট বছর পর্যন্ত। দক্ষিণ বিহারের পাঠশালার জাতের হিসেব দিচ্ছেন এডাম। মুসলমান ছাড়াও ছিল কায়স্থ, মগধ, গন্ধবণিক, তিলি, কোইরি, সোনার জাতির। হিন্দু পড়ুয়েদের মধ্যে ছিল দেসাধ, পাসি, সুশাহর, ধোবি, তাঁতি, কালাবর, বেলদার, গোয়ালা, নাপিত, কাহার, কুর্মি, কোইরি, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ইত্যাদি। বীরভূমে তিনি হিন্দু, মুসলমানএর সঙ্গে খ্রিষ্ট ধর্মের গুরুমশাইএর নাম পাচ্ছেন। ৪০০ জন গুরুমশাই ছিলেন হিন্দু, ২৪টি জাতি – চন্ডাল(অথচ চন্ডালিকা লিখলেন রবীন্দ্রনাথ), ধোবি, তাঁতি, কৈবর্ত, গোয়ালাও। পড়ুয়েদের মধ্যে মুসলমান, খ্রিস্টান, সাঁওতাল, ধাঙড়, ডোম, চন্ডাল, তেলি, ব্যাধ, যুগি, তাঁতি, হাড়ি, কুর্মি, মালি, ব্রাহ্মণ, কায়স্থরাও। গুরুমশাই মার্ক্সএর তত্বকে প্রমাণের দায় উত্তরাধিকারী ওপর পড়ে।
গুরুমশাইদের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে সম্প্রতি পরমেশ আচার্য মশাই বলছেন এঁরা অধিকাংশই কায়স্থ(বাঙলার দেশজ শিক্ষাধারা, প্রথম খন্ড)। কায়স্থ ছাড়াও বহু জাতির গুরুমশাই পাঠশালায় পড়াচ্ছেন সেটি গবেষকের দৃষ্টি এড়িয়েছে। সেগুলে উল্লেখ করলে তত্ব প্রমাণ হয় না। রামমোহন রায়ের কলম ধরার আগে থেকেই, পাদ্রিদের বহু লেখায় ব্রাহ্মণেরা ভারতীয় জাত ব্যবস্থায় বড় ভিলেন বনেছেন। সেই সূত্রে তিনি বললেন শিক্ষক ব্রাহ্মণ নন, সে তথ্যে খুব একটা উল্লসিত হওয়ার কারন নেই। মনুবাদী তকমা পাওয়া যাবে জেনেও বলা যাক ব্রাহ্মণ প্রসঙ্গে অনেক কিছু বলার আছে, কিন্তু এ প্রবন্ধে সে সুযোগ নেই।
"Parents of good caste do not hesitate to send their children to schools conducted by teachers of an inferior caste and even of different religion(সুযোগ পেয়েই উচ্চবর্ণ, নিম্নবর্ণের ধারণা ঢুকিয়ে দিয়েছেন ব্যতিক্রমী এডাম)। For instance, the Musalman teacher... has Hinuds of good caste among his scholars and this is equally true of the Chandal and other low caste teachers enumerated... "the Musalman teachers have Hindu as well as Musalman scholars and the different castes of the former assemble in the same school-house, receive the same instructions from the same teacher, and join in the same plays and pastimes।
বাংলার মধ্যবিত্ত আর বুদ্ধিজীবিদের ইওরোপধন্য হয়ে ওঠার চেষ্টায় উঠেগেল সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা। মেকলের নিদানের তিন বছর আগেই জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন-এর সদস্য হোল্ট ম্যাকেঞ্জি ১৮৩২এ কর্তৃত্বের কণ্ঠে বলছেন To provide for the education of the great body of the people seems to be impossible। অথচ এই অসম্ভবকে সম্ভব করছিল বাঙলার গ্রাম সমাজ। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের হাত ধরে তৈরি হল নতুন এক শ্রেণীর জমিদার গোষ্ঠী। এই প্রথম ভারতীয় সভ্যতায় কেউ জমির মালিক হলেন। গ্রামে জমির বাজার তৈরি হল। জমির মালিক কিন্তু গ্রামে থাকতেন না। গ্রাম বিকাশে উত্সাহ ছিল না। এজমালি, নিষ্কর জমি দখল নিয়ে খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা হল। গ্রামকৌমের সলিল সমাধি ঘটল। ভেঙেগেল সমাজ শাসনের সনাতন পরিকাঠামো।
No comments:
Post a Comment