ইয়োরোপীয়রা ছাড়া বাংলা বানিজ্যে চিনা, তুর্কি, ইরানী, আমিসিনিয়, জর্জীয়, আর্মেনিয়, গ্রিসিয় ইত্যাদি দেশের বণিকদের দেখা মিলত। বলা দরকার কোন দেশের ব্যবসায়ী বাংলায় আসত না! লোহিত সাগর আর পারস্য উপসাগরের উপকূল জেড্ডা(আরব), মোখা(য়েমেন), বসরা(ইরাক), গোম্ব্রুন(পারস্যের বন্দর আব্বাস) আর পূর্ব, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, সুমাত্রা, মালয় এবং আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে কেনিয়া ও মোজাম্বিকে এই ব্যবসায়ীরা বাংলার পণ্য নিয়ে যেত। ঐতিহাসিক ভাবে চিনে আর ম্যানিলাতে বহু শপ্ত বছর ধরে বাংলা আর বিদেশি ব্যবসায়ীরা বাংলার পণ্য রপ্তানি করত। বাংলা থেকে তারা সংগ্রহ করত বাংলার নিজস্ব শিল্পজাত পণ্য সূতি আর রেশম কাপড়, কাঁচা রেশম, মসলিন, আফিম, চাল, চিনি, আদা, হলুদ, লম্বা লঙ্কা ইত্যাদি। এরা বাংলায় ঐ সব অঞ্চল থেকে বয়ে আনত তুলো, লঙ্কা, ফল, ওষুধ, শাঁখা, কড়ি, টিন, তামা, বাদাম, ঘোড়া, গোলাপজল, সিরাজী মদ্য ইত্যাদি। ১৭১৭/১১২৪ সালে পাঁচশ টন মাল পারস্যে গিয়েছিল। ১৭৩০/১১৩৭এ রাজনৈতিকভাবে পারস্য আর ইরাকি অঞ্চলে অশান্তি থাকায় লোহিত সাগর আর পারস্যে কম মাল গিয়েছিল। ব্রহ্মদেশে বাংলার বাণিজ্য ছিল। ব্রহ্মদেশ থেকে আনা হত জাহাজ তৈরির দামি কাঠ, টিন, চন্দন, সাপান কাঠ ইত্যাদি।
পলাশীর আগেই বাংলায় ইওরোপিয় তিনিটি কোম্পানি ইংরেজ, ফরাসি আর ওলান্দাজদের বিস্তৃত কুঠি আর দুর্গ তৈরি করে ফেলেছিল। ইংরেজদের কলকাতা আর ফোর্ট উইলিয়াম, ফরাসিদের চন্দননগর ও ফোর্ট অরলিও আর ওলান্দাজদের চুঁচুড়া আর ফোর্ত গুতাভাস ছিল ইওরোপিয় বণিকদের বাংলাজোড়া বাণিজ্য আর সুরক্ষার প্রধান ঘাঁটি। কলকাতার আশেপাশের এলাকা ছাড়া ঢাকা, কাশিমবাজার, মালদা, রাজমহল, বর্ধমান, মেদিনীপুর, হুগলি, দিনাজপুরে কোম্পানির ব্যবসা আর বাণিজ্য কুঠি ছিল। এদেশের রাষ্ট্র শক্তির সঙ্গে ইওরোপিয়দের অম্লমধুর সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। ইওরোপিয় করপোরেটরা এদেশে তাদের অনুগত বেশ কিছু বণিকগোষ্ঠী গড়ে তোলে। ফলে তাদের মূলধনের অভাব হত না। এদেশের বণিক মহাজাওন তাদের অক্লেশে টাকা ধার দিত। জগতশেঠেরা অপরিমিত সম্পদের মালিক ছিল এবং এদের সুদের হারও খুব বেশি ছিল না, বার্ষিক ৯ শতাংশের আশেপাশে।
এই তিনটি ইওরোপিয় কর্পোরেট কোম্পানি ছাড়া এ সময়ে আরও তিনটি ইওরোপিয় কোম্পানি বাংলার আন্তর্জাতিক ব্যবসায় ভাগ বসাবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। এরা হল দিনেমার, বেলজিয়ামের অস্টেন্ড আর জার্মানির এমডেন কোম্পানি। ১৭১৪/১১২১ সালে দিনেমারেরা বাংলাদেশে কিছুটা ব্যবসা করেছিল। ললিত মোহন মিত্রর ডেনস ইন বেঙ্গল বই থেকে জানছি, বাংলা সরকারের সঙ্গে গণ্ডগোল দেখা দিলে তারা চন্দননগরের গোন্দলপাড়ার কুঠি উঠিয়ে নিয়ে, বাংলা ছেড়ে ত্রিভাঙ্কুর চলে যায়। ১৭৫৫/১১৬২র আলিবর্দির শেষ সময় পর্যন্ত তাদের বাংলার বাণিজ্য ক্ষেত্রে দেখা মেলে না। তারপরে তারা বাংলায় এসে শ্রীরামপুরে উপনিবেশ স্থাপন করে। অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যের বেলজিয়ামের অস্টেন্ড কোম্পানি ১৭২৬/১১৩৩ সালে ব্যারাকপুরের বাঁকি বাজারে তাদের কুঠি খুলেছিল।
কালিকিঙ্কর দত্তের আলিবর্দি এন্ড হিজ টাইমসএ পাচ্ছি, প্রথম থেকেই ব্রিটিশ এবং ডেনিসেরা অস্টেন্ড কোম্পানির প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়ে পড়ে। অস্ট্রিয়ার সম্রাটের কাছে কুঠি বন্ধ করে দেওয়ার আবেদনও করেছিল। ১৭৩৩/১১৪০ সালে সুজাউদ্দিনের ওপর প্রভাব খাটিয়ে, ঘুষ দিয়ে তাদের বাংলা থেকে উচ্ছেদ করে। এরা বাংলার বেশ কিছু ইওরোপিয় পণ্য শস্তায় বিক্রি করত। আলিবর্দির সময় প্রুশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডরিক এমডেন কোম্পানির হয়ে বাংলায় ব্যবসা করতে চেয়েছিলেন। আলিবর্দি বা ইংরেজ কেউই জার্মানদের পছন্দ করে বি। ফলে জার্মানদের এই প্রচেষ্টা অল্পকাল পরেই ত্যাগ করতে হয়।
শেষ পর্যন্ত টিকল ইংরেজ ডাচ আর ফরাসিরা। ফরাসি আর ডাচেদের অবস্থা পড়তির দিকে। চতুর্দশ লুইয়ের রাজত্বের শেষের দিকে স্পেনিয়দের উত্তরাধিকারের ফলে ফরাসিরা বাংলা বাণিজ্য সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। ডুপ্লে বাংলা থাকার দশকটিতে(১৭৩১/১১৩৮-১৭৪১/৪৮) কিছুটা ব্যবসায় প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন, তাঁর পণ্ডিচেরি চলে যাওয়ার পরে বাংলায় ফরাসি বিনিয়োগ আবার ঝিমিয়ে পড়ে। ডাচেদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্রিটিশদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ছিল। তারা বাংলাকে ভিত্তি করে এশিয় উদ্বৃত্ত বাণিজ্য তৈরি করেছিল, কিন্তু পরিচালকদের মধ্যে প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক নানান বিতর্ক – বিশেষ করে কোম্পানির(ভিওসি – ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা নিয়ে বিতর্ক তাদের পিছিয়ে দেয়। বাটাভিয়ায় মশলা বাণিজ্য অনেক বেশি লাভজনক হওয়ায় তারা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ঝুঁকছিল। ফলে বাংলার বাণিজ্য মূলত ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়।
(ক্রমশঃ)
No comments:
Post a Comment