মুঘল ব্যবস্থায় আমরা দেখেছি ভূমি রাজস্বের পরিমান বাড়ানোর জন্য মুঘল সম্রাটেরা নতুন চাষের জমি বা আবাদি বাড়াবার চেষ্টা করতেন, ফলে মুর্শিদকুলিখাঁর সময়ে রাজস্ব বৃদ্ধি খুব একটা অস্বাভাবিক ছিল না। তিনিও জমিদারদের ওপর চাপ দিয়ে চাষের জমি নানাভাবে বাড়াবার চেষ্টা করে গিয়েছেন, যে লাভটা পেয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে কৃষক নবাবদের রাজস্ব দিয়েছে। মুর্শিদকুলির আগে বাংলায় ছিল ৩৪টি সরকার আর ১৩৫০টা প্রশাসনিক মহল। তিনি বাংলাকে ১৩টা চাকলা আর ১৬৬০তা পরগনায় ভাঙলেন। এই ১৩টি চাকলার নাম উল্লেখ করলাম, বালেশ্বর, হিজলি, মুর্শিদাবাদ, হুগলি/সপ্তগ্রাম, ভূষণা(রাজশাহী, মাহামুদাবাদ, ফহতেহাবাদ প্রভৃতি), যশোর, আকবরনগর(রাজমহল ও পূর্ণিয়া), ঘোড়াঘাট/রংপুর, কুড়িবাড়ি(কামরূপ/অসম)। জাহাঙ্গীর নগর(সোনারগাঁ, বাকলা), শ্রীহট্ট আর ইসলামাবাদ(চট্টগ্রাম)।
মুর্শিদকুলি বা করতলব খাঁ যখন বাংলায় এসেছেন, তখন ঔরঙ্গজেবের প্রচুর অর্থ প্রয়োজন। তিনি দাক্ষিণাত্য অভিযানে রয়েছেন। করতলব খাঁ বাংলায় এসে দেখলেন বাংলা তখন ব্যবসায় উদ্বৃত্ত অঞ্চল কিন্তু বাংলা থেকে দিল্লীতে যথেষ্ট রাজস্ব যায় না। খালসা বা জায়গির, উভয় ক্ষেত্রে রাজস্ব আদায় দিতেন বাংলার জমিদারেরা। এর বিনিময়ে পেতেন ১০ শতাংশ কমিশন আর কিছু নানকর জমি। বৈশাখের পুণ্যাহের দিনে জমিদারদের রাজস্ব এবং আগামী বছরের দেয় সম্পর্কে বন্দোবস্ত হত(বেঙ্গল নবাবসএ য়ুসুফ আলির আহবাল-ই-মহব্বতে জঙ্গ, যদুনাথ সরকারের অনুবাদে)।
দেওয়ান কার্তিক চন্দ্র রায় ক্ষিতীশ বংশাবলীচরিতএ বলছেন পুণ্যা(পুণ্যাহ)র সময়ে জমিদারেরা দেওয়ানি বিভাগে জড়ো হতেন এবং নবাব আর দেওয়ান এদের রাজস্ব আদায়ের সনদ দিতেন। সনদে থাকত পরগনার নাম। তারপরে রাজস্বের পরিমান উল্লিখিত হত। জমিদারদের প্রতি হুঁশিয়ারিও লেখা থাকত, প্রজাগণ যে নির্ধারিত রাজস্ব দিয়া থাকে, তাহার অধিক এক কপর্দকও লইবে না, এবং ছলে বা কৌশলে তাঁহাদের নিকট আর কিছুই লইবে না। তাহাদিগকে সুখে রাখিতে যত্ন করিবে, এবং তাঁহাদের প্রতি কেহ কোন দৌতাত্ম করিতে না পারে তদ্বিষয়ে যত্নশীল থাকবে। কাহারো জায়গিরের(নিষ্কর ভূমি) প্রতি হস্ত প্রসারণ করিবে না। জমিদারীর উন্নতি সাধনে নিরন্তর যত্ন করিবে এবং নির্ধারিত রাজস্ব প্রদান পূর্বক আমার সরকারের মঙ্গলাভিলাষী থাকিবে।
জমিদারের কাজ হল নির্ধারিত ভূমি রাজস্ব আদায় করে রাজকোষে জমা দেওয়া, জমিদারির কৃষিকাজ দেখা, অনাবাদী জমি চাষে আনা, জলসেচ ও বাঁধের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। জমিদারদের দায়িত্ব ছিল চুরি ডাকাতির হাত থেকে রায়তদের রক্ষা করা। আরও একটা কাজ হল ভূমি আর ভূমি রাজস্বের হসতবুদ ও সরহদ্দ প্রস্তুত করে সরকারের প্রয়োজনমত রাজস্ব সরবরাহ করা।
যদুনাথ জানিয়েছেন মুর্শিদকুলি বাংলায় প্রথম মালজমিনী বা ইজারাদারির ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। তিনি মনে করতেন ইজারাদারদের চাপে বাংলার প্রাচীন জমিদারেরা ধ্বংস হয়ে যায় এবং এরাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে স্থায়ী জমিদারে পরিণত হন(হিস্ট্রি অব বেঙ্গল)। কিন্তু আব্দুল করিম তাঁর এই তত্ত্ব খণ্ডন করছেন। তার মতে মুর্শিদকুলির সময়ে মিশ্র ব্যবস্থা চালু ছিল। জমিদার আর ইজারাদার উভয়েই প্রজাদের থেকে রাজস্ব আদায় করত। যে সমস্ত জমিদার নিয়মিত রাজস্ব দিতে পারত না তাদের তিনি উচ্ছেদ করেছিলেন। নাজির আহমেদ এবং রেজা খাঁ এদের ওপর অত্যাচার করত। তার সময়ে প্রথমে উল্লিখিত দ্বিতীয় শ্রেণীর জমিদার তৈরি হয়েছিল, আবার ভূষণার সীতারাম রায় বা রাজশাহীর দর্পনারায়পণ রায় বিদ্রোহ করতে গিয়ে জমিদারি হারিয়েছিলেন। দেওয়ান কার্তিকচন্দ্র রায় লিখছেন, নবাবেরা ভূমধ্যকারিগণকে বশীভূত করিয়া অথবা তাঁহাদের জমিদারিতে ক্রোক সাজোয়াল দিয়া, বাকী রাজস্ব আদায় করিয়া লইতেন, এবং কখন কখন মহাল খাস করিয়া অন্যের সঙ্গে বন্দোবস্ত করিতেন।
জমিদার বাকী খাজনার জন্য সম্পূর্ণ জমিদারি হারাতেন না।
No comments:
Post a Comment