(বেশ বড় লেখা হবে; শূদ্রদের জ্ঞানচর্চা নিয়ে ছোট প্রবন্ধ; ভদ্ররা এড়িয়ে যাবেন। মিছিমিছি মনের ক্ষতে রক্তক্ষরণ বাড়িয়ে লাভ কি।)
জাতীয় দলিত সংবাদ মানেই অস্পৃশ্যতা, সংরক্ষণ, এবং তাঁদের ওপর অত্যাচারের কাহিনী। এর মাঝে কখোনো কখনও কেউ বলে থাকেন ব্রিটিশ পূর্ব সময়ে দলিতদের অবস্থা অতটা হয়ত খারাপ ছিল না। বাল্মীকি থেকে শবরী থেকে জ্ঞানেশ্বর, নামদেব, তুকারাম, রবিদাস বা কবীর সকলেই দলিত ছিলেন। ধরমপাল আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, ব্রিটিশ সূত্রেই আমরা পাচ্ছি গ্রামগুলির পাঠশালায় দলিত শিক্ষক আর দলিত ছাত্রদের সংখ্যাধিক্য ছিল। কখোনো কোন আলোচনাতেই আমরা শুনতে পাই না ভারতীয় জ্ঞান বিজ্ঞানে দলিতদের কোন অবদান আদৌ ছিল কি না।
কিন্তু ভারতীয় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় দলিতদের অবদান প্রচুর। আধুনিক বিজ্ঞান টিকে আছে ক্যালকুলাস বা কলনবিদ্যার ভিত্তির ওপর, আমি 'কালচারল ফাউন্ডেশন অব ম্যাথমেটিক্স'এ প্রমান করেছি, পঞ্চম শতকে আর্যভটের জ্ঞানে কলনবিদ্যার ভিত্তিস্থাপিত হয়েছিল। ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাসের বহু সঠিক ত্রিকোনোমিতিক মান তিনি নির্ণয় করেন।
সে সময় ভারত চাষ এবং বৈদেশি বাণিজ্য থেকে বিপুল সম্পদ আহরণ করত। বিদেশে যাওয়ার জন্য সমুদ্রশাস্ত্র এবং সঠিক চাষের জন্য নির্ভুল পঞ্জিকা তৈরি আবশ্যক ছিল। দুটি জ্ঞানের জন্যই জ্যোতর্বিজ্ঞান এবং ভূগোলে পারদর্শিতা আর তার জন্য জরুরি ছিল ত্রিকোণমিতিতে সঠিক মান পর্যন্ত অঙ্ক কষা। এই ভাবে কলনবিদ্যার ভিত্তি স্থাপিত হওয়ার এক হাজার বছর পর পঞ্চদশ শতে জেসুইট পাদ্রিরা কোচিন থেকে এই জ্ঞান অনুবাদ করে নকল করে নিয়ে গেলেন, কেননা তখনও ইওরোপে সমুদ্রবিজ্ঞান(এবং ত্রিকোণমিতির সঠিক মান) ততটা বিকশিত হয় নি, যা নির্ভর করে তারা বিদেশে গিয়ে বণিজ্য করতে পারে। ইয়োরোপে ক্যালকুলাস আবিষ্কারের শিরোপা নিউটনকে দেওয়া হয় যা সর্বৈব মিথ্যা। বাস্তব হল শুধু নিউটনই নন, তার সঙ্গে অন্যান্য গনিতজ্ঞও কলনবিদ্যার মর্ম ঠিকমত আবিষ্কার এবং বুঝতে পারেন নি।
আর্যভটের নাম থেকেই আমরা বুঝতে পারি তিনি দলিত ছিলেন। ভটের অর্থ দাস, চাকর বোঝাত। ভট আর ভট্ট এই দুই শব্দে ফারাকটানাটা আজ খুব জরুরি – যা ভুল হবার হয়ে গেছে। তবুও আমরা কেউ কেউ অনিচ্ছাকৃতভাবেই আর্যভট্ট লিখে থাকি, যার ফলে তাঁর জাতি বদলে যায়। অতীত থেকেই এই নাম প্রত্যেকটা পাণ্ডুলিপিতে পাচ্ছি। ফলে আর্যভটই সঠিক নাম। সপ্তমশতের ব্রহ্মগুপ্ত আর্যভটের সিদ্ধান্তগুলির বিরোধিতা করে ছিলেন এবং তিনি তার পাণ্ডুলিপিতে তাঁকে শুধু তার জাতি, ভট নামে সম্বোধন করে গিয়েছেন যা যথেষ্ট নিন্দনীয়।
আর্যভটের হাজার বছর বাদে আর্যভটিয়া এতই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল যে কেরলের গণিতজ্ঞ নীলকণ্ঠ এর ওপর ভাষ্য লেখেন। নীলকণ্ঠ সোমসুব্বন (চলিতি ভাষায় সোমাইয়া) ছিলেন সব থেকে উঁচু জাতের নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণ, আশ্চর্য, তাঁরও হাজার বছর আগের পাটনার এক দলিতের তত্ত্বের অনুসারী হতে বিন্দুমাত্র বাধে নি।
আর্যভট ক্যালকুসাসের শুধু আবিষ্কর্তা ছিলেন তাই নয়, বিশ্ব যে গোল, সে ধারনাটি তিনি বোঝাবার চেষ্টা করেছেন কদম ফুলের সঙ্গে তুলনা করে এবং সঠিক ত্রিকোণমিতির মান দিয়ে তিনি পৃথিবীর সঠিক মানের ব্যাসও মাপেন। এ মাপনটি তাঁর বহু পরে ইওরোপে সপ্তদশ শতে হয়েছিল। তিনি সে সময়ে বলে যান পৃথিবী বিলোম দিশায়(মানে কি? নিজের অক্ষের চারদিকে?) ঘোরে যা বরাহমিহির এবং আর্যভটের কিছু অনুগামী মানতে রাজি ছিলেন না।
কলনবিদ্যা আলোচনা করতে গিয়ে আমি আর্যভটের বিষয়ে বিশদে বহু জায়গায় লিখেছি। একটি কাগজ আমার প্রবন্ধের সঙ্গে তাঁর একটা ছবি ছেপে দিল। আজ হামেশাই যেমন হয়, ইন্টারনেট থেকে একটা ছবি নকল করে প্রবন্ধের সঙ্গে লাগিয়ে দেওয়া। অথচ ইন্টারনেটের আর্যভটের যে কোন ছবি থেকে কোনভাবেই বোঝা যাবে না তিনি শূদ্র/দলিত ছিলেন। সেই খবরের কাগজ উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া ছবি ছেপে দিল, সেই মূর্তিটি পুণের আইইউসিএএতে বসানো হয়েছে। এটি একটি অনৈতিহাসিক মূর্তি। সেটায় দেখানো হয়েছে যে তিনি পৈতে পরে আছেন। যেটা থেকে স্পষ্ট যে মূর্তিকার বা যারা মূর্তিকারকে সেটি তৈরি করতে বরাত দিয়েছিল তারা তাকে ব্রাহ্মণ ধরে নিয়েছেন।
যখন এই মূর্তিটি স্থাপন করা হল, তখন আমি সংস্থার জনসংযোগ আধিকারিককে ই-মেল করে জিজ্ঞাসা করলাম আর্যভট, যে আর্যায় পৃথিবীকে কদম্ব ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, সেটি তারা জানেন কি না। সেই মেলের সঙ্গে আমি আর্যাটা লিখে পাঠিয়ে আর্যভট শব্দটা ব্যবহার করে বলেছিলাম, এই মেলটা তিনি বস জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকরকে কি জানিয়েছেন? জবাব পেলাম এই তথ্যটা নারলিকর জানেন। তারপরে আবার একটা মেলে আমি জিজ্ঞাসা করলাম জয়ন্ত যদি এটা জানেন তাহলে সরকারি বিদ্যালয়গুলির অঙ্ক বইতে কেন তিনি আর্যভটকে, আর্যভট্টরূপে লিখেছেন? এর কোন উত্তর এল না, কিন্তু কিছু দিন পরে বইগুলিতে নামটা ঠিক করে দেওয়া হল। কিন্তু পৈতে পরানো মূর্তি পাথরের তৈরি। এই ছবিটি উইকিপিডিয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গিয়েছে। জ্ঞানচর্চা মানেই উচ্চবর্ণ, এই অন্ধবিশ্বাসে ভর করা মানুষেরা আজও জানেন আর্যভট্ট ব্রাহ্মণ ছিলেন। এই মিথ্য জানা রোগ সারানোর কোন সঠিক নিদান আমার হাতে নেই।
আর্যভট আশ্চর্য প্রতিভা ছিলেন তো বটেই কিন্তু তিনি একা দলিত অঙ্কবিদ ছিলেন না। পাঁচশ বছর পরে দ্বিতীয় আর্যভট এলেন। মনে হয় তখন বৌদ্ধ আর তার পরের সময়ের মুসলমান শাসন এর জন্য দায়ি। তখন হয়ত দলিতদের অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না।
No comments:
Post a Comment