গোলাম হোসেন তার সিয়ারেমুতক্ষরিণে জানিয়েছেন বাংলার সেনাবাহিনীতে বিপুল সংখ্যক সেনা সব সময়ের জন্য নিযুক্ত ছিল, কিন্তু মুর্শিদকুলি এসে পদাতিকে চার হাজার আর অশ্বারোহী বাহিনীতে দু হাজার সেনায় নামিয়ে আনেন। আমাদের ধারণা কারণ যুদ্ধের জন্য তৈরি করা তুর্কি ঘোড়া আমদানির জন্য বাংলার বিপুল অর্থব্যয় হত। অথচ এই ছোট বাহিনী নিয়ে তিনি বাংলায় শান্তি বজায় রেখেছিলেন। অথচ সুজার সময় বাংলার সেনা বাহিনী বাড়িয়ে করেন পঁচিশ হাজার। অর্ধেক পদাতিক অর্ধেক অশ্বারোহী। আলিবর্দির সময় এই বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ। সিরাজের সময় ছিল পঞ্চাশ হাজার। আলিবর্দি আর সিরাজ দিল্লীতে বছরে এক কোটি টাকার বেশি রাজস্ব পাঠানো বন্ধ করেছিলেন, ফলে তাদের পক্ষে বড় সেনাবাহিনী পোষা দুঃসাধ্য হয় নি। সেনাদের নিয়মিত বেতন, উপঢৌকন আর পুরস্কার দেওয়া হত।
এছাড়া রাষ্ট্রের পক্ষে বেশ কিছু ওয়াকফ জমি নির্দিষ্ট ছিল। প্রতিষ্ঠান এ ধরণের দান পেত, ব্যক্তি নয়। মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব, দরগা প্রভৃতি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নিষ্কর(যেমন লাখেরাজ, বা খেরাজ কর বিহীন) ভূমি দান করা হত। এই জমি থেকে আয় জনহিতকর কাজে ব্যয় হত। যেমন অমুসলমানেদের ব্রহ্মোত্তর, দেবোত্তর, বিষ্ণোত্তর, শিবোত্তর ইত্যাদি নিষ্কর জমি ছিল, যেখানে মেলা উতসব ইত্যাদি জমায়েত হত। এই ছাড়ের সিদ্ধান্ত ধর্ম নির্বিশেষ নেওয়া হত।
এছাড়া ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের জন্য, হেকিম কবিরাজ পণ্ডিতদের জন্য নানান ধরণের নিষ্কর জায়গির দিতেন। এগুলির নাম ছিল আইমা আর মদদিমাদস। এগুলি ব্যক্তিকে সারাজীবনের জন্য দেওয়া হত। সবসময় যে এটা পুরুষানুক্রমে ভোগ করতে পারবেন এমন ব্যবস্থা হয়ত ছিল না, যে জন্য আওরঙ্গজেব ফরমান জারি করে মদদিমাসকে বংশানুক্রমে পরিবর্তিত করেন। এই জায়গিরগুলির অধিকারীরা এগুলি নিঃশর্তে ভোগ করত।
ইরফান হবিবের এগ্রারিয়ান সিস্টেমস অব মুঘল ইন্ডিয়াতে পাচ্ছি যে কৃতি রাজপুরুষষ, আমলাদের জন্য জায়গির দেওয়া হত। এগুলির তিন ভাগ ১) ইনামিআলতমঘা বা পুরুষানুক্রমে ভোগ করার জায়গির, ২) জাবাতি বা সারাজীবন ভোগ করার জায়গির এবং ৩) মাসরুৎ বা শর্তাধীন জায়গির। কর্মচারী চাকরি থেকে অবসর নিলে বা ইস্তফা দিলে এই জায়গির রাষ্ট্রের হাতে চলে যেত(আমিনি কমিশনের রিপোর্ট)। তাছাড়া পান্থসালা, ফকির, মুসাফির প্রভৃতির জন্য জায়গির বরাদ্দ হত(আর বি র্যায়মস বোথাম, স্টাডিজ ইন দ্য ল্যান্ড রেভিনিউ হিস্ট্রি অব বেঙ্গল)।
বাংলার নবাবেরা আর্ত গরীব, দুখীদের জন্য নানাভাবে ব্যয় করতেন। গোলাম হোসেন বলছেন আলিবর্দীর ভাইপো ও জামাই নাওয়াজেস মহম্মদ দুস্থ বিধবা আর বৃদ্ধাদের ভাতা দেওয়ার জন্য মাসে ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করতেন। আর এঁরা অনেকেই রাজ দরবার থেকে ভাতা পেতেন। আর্ত গরীব, দুখীদের দেওয়ানি খাতায় নাম লেখালে রাজকোষ থেকে ভাতা পেতেন। বাংলার প্রত্যেক নবাব ধর্মপ্রাণেদের শ্রদ্ধা করতেন। তাদের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জীবিকার ব্যবস্থা করা হত। মুর্শিদকুলি গরীবদের নিয়মিত খাওয়াবার ব্যবস্থা করতেন। আর্ত গরীব, দুখী ভবঘুরেরা রাজধানীতে নিয়মিত খাদ্য পেত।
মুর্শিদকুলি রবিউল আওয়াল মাসে পয়গম্বর হজরত মোহম্মদের পবিত্র জন্ম ও মৃত্যু দিবসে বিপুল উতসব আয়োজন করতেন। রাজধানীতে কোরাণ পাঠ ও অন্যান্য ধর্মীয় কাজকর্ম করার জন্য মুর্শিদকুলি দুহাজার ব্যক্তি নিযুক্ত করেছিলেন। সুজা প্রতিবছর যে রাজকীয় ভোজসভার আয়োজন করতেন, তাতে বিদ্বান আর পণ্ডিতেরা বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হতেন। কর্মচারীদের অযাচিত উপহার পাঠাতেন। তিনি দরিদ্র্যদের অকাতরে অর্থ বিলোতেন।
No comments:
Post a Comment