১৭৮৬ থেকে ১৭৭৮৯। কর্নওয়ালিশের রাজত্বের
প্রথম তিন বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে আরও বেশি কর আদায় নিয়ে নিরন্তর বিতর্ক চলতে
থাকে। কর্নওয়ালিশ রাজস্ব আদায়ের শিথিলতার দায় নব্য-জমিদারদের
অদক্ষতার ওপর চাপিয়ে দেন। কর্নওয়ালিশ মনে করতেন জমিদারের
জমিদারি বিক্রির অধিকার নেই। জমি ইজারা
দিয়েও ধার নেওয়ারও অধিকার নেই। ১৭৭৯৩তে লর্ড
কর্নওয়ালিশ বাঙলাদেশে বহুল প্রভাবশালী চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রচলন করলেন – যার ভিত্তি অনেকটা ফিলিপ ফ্রান্সিসএর অনুসৃত নীতিসমূহ। ১৭৭৯০এর দশশালা পরিকল্পনায় ভূমিরাজস্বের ওপর ভিত্তি করেই চিরস্থায়ীর
রাজস্ব স্থির করা হল। এই প্রথম ভারতের জমিতে ব্যক্তিগত
মালিকানা সৃষ্টি হল। জমিদারদের কঠোরভাবে জানিয়ে দেওয়া হল,
কোনও কারনেই খাজনা মকুব হবে না। খাজনা আদায়ে লাগু হল সূর্যাস্ত আইন। নির্দিষ্ট
দিনে সূর্যাস্তের আগে জমিদার নির্দিষ্ট খাজনা না মেটাতে পারলে জমিদারি বিক্রি করে
দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হল। চিরস্থায়ী
বন্দোবস্তের প্রথম পঁচিশ বছরেই বাঙলার অধিকাংশ জমিদারি নিলামে ওঠে। কোম্পানির কর্মচারীদের যোগসাজসে বহু পেশার মানুষ জমিদারি কিনতে শুরু করলেন। নিলামে অবিক্রিত থেকে যাওয়ায় বহু আবাদি অঞ্চলে জমিদারির বন্দোবস্ত করতে হয়। জমিদার এই বন্দেবস্তের ফলে জমির প্রকৃত মালিক হলেন আর রায়তরা প্রায়
ক্রীতদাসে পরিণত হলেন।
কর্নওয়ালিশ
নব্য জমিদারিত্ব কেন্দ্র করে বাঙলায় জমিদার আর কৃষকের
মধ্যে বহু দালালের আবির্ভাব ঘটল। জমিদারিতে
অনুপস্থিত জমিদার খন্ডে খন্ডে পত্তনি দিতে শুরু করেন – তাদের নাম হল পত্তনিদার, দূরপত্তনিদার, দূরদূরপত্তনিদার, সেপত্তনিদারএরমত
হাজারো মধ্যসত্বভোগী। বরিশালের জমিদারিতে পঞ্চাশজনেরমত
মধ্যসত্বভোগী উঠে এল। ১৮১৯তে আইন প্রনয়ণ করে এই
বন্দোবস্তকে কোম্পানি স্বীকার করে নিল। ১৭৯৯এ রায়তদের
সম্পত্তি ক্রোক আর বাস্তু থেকে উত্খাত করে বাকি খাজনা আদায়ের অধিকার জমিদারদের
দেওয়া হল। অনুপস্থিত জমিদারদের বদলে
মধ্যসত্বভোগীরা নানান কৌশলে জমির খাজনা বাড়াবার ব্যবস্থা করলে, সরকারের রাজস্ব
নির্ধারিত হলেও গ্রামে মহাজনী সুদের কারবার বেড়ে যায়। সরকারের আর্থিক দায় মেটাতে বাজার থেকে ঋণ নিতে হল, সেই ঋণের আর তার সুদের
বোঝা স্বাভাবিকভাবেই চেপে যায় রায়তদের ওপর। ঋণের দায়ে
জর্জরিত রায়তদের ঋণগ্রস্ততার বিনিময়ে, লাভ অর্জন করেন ব্রিটিশ প্রসাদপুষ্ট জমিদার
আর মধ্যস্ত্বভোগীরা, যারা পরে সোনার বাঙলায় বাঙলার ঐতিহ্যশালী ব্যবস্থা ভেঙে ইংরেজ
সমাজের নানা রীতিনীতি আনয়ণ করে জমিদারির উদ্বৃত্তের বলে এরাই পরে বাঙলার রেনেসাঁর
জনক হন। পলাশির পর যে লুঠের রাজত্ব শুরু
হয়েছিল, সেই রাজত্বকে নিশ্চয়তা দিলেন নতুন শতাব্দের বাঙালি মধ্যবিত্ত, ইংরেজদের
লুঠের খিদমতদার হয়ে উঠে।
No comments:
Post a Comment