নিজের দেশ থেকে সোনারূপো আমদানি করে মহাজনদের থেকে ধারে
ইংরেজরা কাপড়, রেশম, সোরা, আর অন্যান্য পণ্য ইওরোপে রপ্তানির জন্য কিনত। ১৭৫৩
পর্যন্ত গোপীনাথ শেঠ, রামকৃষ্ণ শেঠ, শোভারাম বসাক, আমিরচাঁদ বা উমিচাঁদেরমত দাদনি
বণিকেরা, দাদন দিয়ে বাঙলার উত্পাদকদের থেকে ইরেজদের ব্যবসার নানান জিনিষ সরবরাহ
করতেন। দাদনি বণিকদের আওতা থেকে বেরোতে এবার ইংরেজরা নিজেদের
আড়ংএ বাঙালি গোমস্তা লাগিয়ে উত্পাদকদের কাছ থেকে সরাসরি পণ্যদ্রব্য কিনতে শুরু
করে।
১৭৫১তে বাঙলায় কোম্পানির ইনভেস্টমেন্ট ছিল ৩৩ লক্ষ ৬৬ হাজার টাকা। ১৭৫৫তে তা
কমে দাঁড়ায় ১২ লক্ষ একাশি হাজার টাকা। ফারুখশিয়রের দস্তকের আড়ালে চলল
গোমস্তা আর ইংরেজদের বকলমে লাভ বেড়ে যাওয়ার খেলা।
পলাশি চক্রান্তের পর ব্রিটিশেরা ক্ষমতায় এসে
ভারতীয় সমাজে কঠোরতমভাবে মেনেচলা শাসন আর ব্যবসার বিভাজন রেখা তুলে দিল। মোঘল আমলের
নীতি শেকড়শুদ্ধু উপড়ে ফেলে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার নিজেই হয়ে উঠল ব্যবসায়ী। সরকারে
থাকা আমলা আর কর্মচারীরা সরকারিযন্ত্র ব্যবহার করে সারাদেশের সমাজের সামনে নামিয়ে
আনল অসম্ভব বর্বরতা, নিষ্পীড়ণ আর লুঠের রাজত্ব। কোম্পানির
একচেটিয়া ব্যবসার পাশাপাশি, উচ্চপদস্থ কোম্পানির ইঙ্গ আমলারা আর বঙ্গজ দালালেরা
নিজেদের কোলে ঝোল টেনে লুঠের অর্থে নিজেরা ব্যবসা করে ধনী হয়েছেন। ভারতীয়
সভ্যতায়, সমাজ, ব্যবসা আর রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার যে কঠোর বিভাজন রেখা ছিল তাও
লুপ্ত হয়ে গেল।
রাষ্ট্র মদতে অবৈধ ব্যবসা, জ্ঞাণ চুরি আর ভারতের
সনাতন সংস্কৃতি-সমাজ-অর্থনীতি-শিল্প পরিকাঠামো ভাঙার চক্র গড়ে উঠল জনগনের থেকে
লুঠতরাজে আদায়ী রাজস্বের মাধ্যমে। দাদন প্রথাকে পরিহাসের স্তরে নামিয়ে
এনে, ন্যুনতম পরিমান অর্থ অগ্রিম দিয়ে, ইওরোপিয় নীতিতে প্রায়দাসত্বপ্রথা চালিয়ে,
কমদামে জোর করে উতপাদকদের কাছ থেকে দ্রব্য কেড়ে, সেই দ্রব্যের ব্যবসার ফলাও লাভের
কারবার শুরু হল। বাঙলার ক্ষমতা দখলের পর থেকেই ব্রিটিশ শক্তি কোম্পানির
রূপ ধরে ভারতের বাইরে বিশেষ করে প্রথমে ভারতের অন্যতম আর্থিক সম্পদশালী অঞ্চল,
বাঙলা সুবা থেকে ধনরত্নসহ নানান সম্পদ ব্রিটেনে লুঠ করে ব্রিটেনের শ্রীবর্ধন করে
বিশ্বধংসকরা মানুষমারা শিল্প বিপ্লব ঘটিয়েছে। মনেরাখা
দরকার, ১৮০০সনের আগে পর্যন্ত বাঙলা তথা ভারতবর্ষ ইওরোপ থেকে সাধারণ শিল্প দ্রব্য
আমদানি করত না, বরং সুপ্রাচীণ কাল থেকেই ভারতবর্ষ বিশ্বের নানান দেশকে শিল্পদ্রব্য
যোগান দিয়ে এসেছে। দামাস্কাস তরোয়াল তৈরির জন্য ভারতের নানান অঞ্চলের
ডোকরা কামারদের তৈরি ক্রুসিবল স্টিলএর পিণ্ডই হোক অথবা সমুদ্র যাত্রার জন্য নৌকোই
হোক অথবা মসলিন বা ক্যালিকোরমত বস্ত্রই হোক, অথবা দৈনন্দিনের খাদ্যদ্রব্যের নুন
মসলাই হোক। ভারতের নানান অঞ্চল বরাবরই ইওরোপকে প্রযুক্তিগত সাহায্য
দিয়ে এসেছে, প্রযুক্তি রপ্তানি করেছে (ইওরোপ নানান সময়ে জ্ঞাণ-বিজ্ঞাণ ভারত থেকে
না বলে চুরিও করেছে)।
১৮০০সাল পর্যন্ত বহির্দেশিয় বাণিজ্যে
উদ্বৃত্ত দেশ ছিল ভারতবর্ষ। এই দেশগুলির উত্পাদন কিনতে তাই প্রাচীণকাল পর্যন্ত পশ্চিমি
বাণিজ্যশক্তিকে সোনা-রূপা বয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে। যে সোনা বাণিজ্যের জন্য বিদেশিরা
বাঙলায় বহন করে নিয়ে আসত, সেই সোনা আর বাঙলার বাইরে ফেরত যেত
না। বাঙলার উত্পন্ন দ্রব্য
রপ্তানি করে বাঙলা প্রচুর সম্পদ উপার্জন করত। অষ্টাদশ শতাব্দের শেষের দিকে
আলেকজান্দার ডাও হুগলি বন্দরকে বক্স বন্দর – সব থেকে বড় শুল্ক চৌকি রূপে বর্ণনা
করেছেন। পলাশীর
সময়ে ক্রমশঃ কলকাতা নিঃসন্দেহে বাঙলার বড় বন্দর হয়ে উঠেছে। প্রাক-পলাশী পর্যন্ত কোম্পানি ইওরোপ
থেকে বাঙলায় সোনা-রূপো আসত। তাদের আমদানিকৃত মোট পণ্যের ৭৪ শতাংশ ছিল এই দামি ধাতু। পলাশির আগে কোম্পানি বাঙলায় বাণিজ্য
করতে দামিধাতু আনত। সেই রূপো
টাঁকশালে বাটা দিয়ে মুদ্রায় পরিণত করে তাই দিয়ে রেশম, কাপড়সহ ইওরোপের নানান
মহার্ঘবস্তু কেনা হত। আর্থাত
কোম্পানির ভাষায় ইনভেস্টমেন্ট(ভারতের পণ্যদ্রব্য কিনতে যে
অর্থ প্রয়োজন হত)এর
অর্থ ব্যবসাযোগ্য হয়ে উঠত।
পলাশির পর থেকে আর এই সোনা আনার
দরকার হল না। পলাশির
পর লুঠ আর ঘুষ এবং বাঙলার খাজনা দিয়ে দেশেরই জিনিষ কিনে(অন্য নামে লুঠকরে) দেশে পাঠানোর নতুন
বাণিজ্য নীতি গড়ে তুলবে ইংরেজরা। উচ্চমূল্যের এই ধাতুগুলি পূর্বের দেশগুলিতে বাণিজ্যের জন্য বয়ে আনার
সহস্রাব্দপ্রাচীণ এই প্রবণতাটি গায়ের জোরে বদল আনল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাঙলা
দখলকর্ম। কোম্পানি
শুধু দামি ধাতু
আনা বন্ধ করল তাই নয়, প্রথমে গায়ের জোরে ব্যবসার দখলদারি
নিল।
পরে বাঙলার শিল্প পরিকাঠামো ধংস করে
নিজেদের দেশের পণ্যের বাজার তৈরি করল। তরল সময়ের রাজনৈতিক পরিবেশে অপরিমিত ঘুষের বন্যা বইল
ইংরেজদের সিন্দুকে। এই তিনে মিলে কোম্পানির
আমলারা এত অর্থ
উদ্বৃত্ত তৈরি করে ফেলে যে, এর পর থেকে তাদের আর বাণিজ্য করতে ইওরোপ থেকে
সোনা-রূপা বহন করে আনতে হয় নি, সে অর্থ দিয়ে তারা তিন বছরের ব্যাবসার
পুঁজি জোগাড় করেফেলে। বাঙলায় ব্যবসার জন্য কোম্পানি ইওরোপ থেকে সোনা-রূপাসহ
দামী ধাতু আনা
বন্ধ করে দিল। ১৭৬৫র
দেওয়ানির ফরমান হাতে আসার পর সেই আমদানি রপ্তানিতে
পরিনত হল।
বাঙলায় না হয় ব্রিটিশরা রূপো আনা বন্ধ করে দেয় কিন্তু
পলাশীর প্রায় ৪০ বছর পরও অব্রিটিশ নানান ইওরোপিয়রা ব্যবসা করেছে। কিন্তু এখন
প্রশ্ন তারা কী সে সময় রূপোর বিনিময়ে জিনিস কেনা বন্ধ করে দেয়! বাঙলায় সব থেকে
বেশি সোনা নিয়ে এসে ব্যবসা করত ওলান্দাজরা। পলাশীর চক্রান্তের কয়েক বছর পরও
তারা প্রচুর রূপো এনেছিল। ওলান্দজ ছাড়া দিনেমার, অস্ট্রিয় বা প্রসিয় ব্যবসায়ীরাও
বেশ ভাল পরিমানে রূপো আনত। সেই ইওরোপিয় রূপো আমদানিও বন্ধ হয়ে
গেল ব্রিটিশ ভাইদের হাত ধরে। ঘুষ আর অসাধু ব্যবসায় রোজগারের অর্থ,
রাতারাতি নবাব বনে যাওয়া ব্রিটিশ ব্যবসায়ী আর কোম্পানির আমলাদের হাতে জমত। কোম্পানির
নজর এড়িয়ে এই অর্থ ব্রিটেনে পাঠাবার একটিই উপায় ছিল- বিপুল সম্পদ অব্রিটিশ
ব্যবসায়ীদের ধার দেওয়া। সেই অর্থে অব্রিটিশিয় ব্যবসায়ীরা মাল কিনে দেশে পাঠাত। ফলে তাদেরও
আর দেশ থেকে দামি ধাতুসব ভারতে আনার প্রয়োজন হল না। ব্রিটিশদের
কাছ থেকে টাকা ধার করা বিদেশি ব্যবসায়ীরা নবোবদের ব্রিটেনে ভাঙানো যায় এমন হুন্ডি
দিত।
হেস্টিংসের বন্ধু বারওয়েল জানাচ্ছেন ১৭৬৫ থেকে ১৭৬৭ এই দুবছর, এই প্রথায় ওলান্দাজ
ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ব্রিটেনে কোম্পানির কর্মচারীরা বার লক্ষ পাউন্ড পাঠায়। ব্রিটিশ
আমলাদের অতিরিক্ত রোজগারের বিনিয়োগ থেকে ওলান্দাজরা এত অর্থ জমিয়ে ফেলে যে, ১৭৬৮তে
ব্রিটিশ কোম্পানির কলকাতা কাউন্সিল জানাচ্ছে, ওলান্দাজরা আগামী তিন বছর দেশ থেকে
দামি ধাতু না এনেই ভারতে ব্যবসা করতে পারে। ফলে শুধু ব্রিটেনই নয় ইওরোপের নানান
দেশের ব্যবসায়ীরা ব্রিটিশদের লুন্ঠন কর্মে উপকৃত হয়েছে। সব থেকে
বড় কথা ভারত শাসনের উদ্বৃত্ত অর্থ ভারতে বিনিয়োগ না করে অংশিদারদের বেঁটে দেওয়া
হয়েছে বিভিন্ন দেশে। তবে ভারতীয় স্বাধীণতা সংগ্রাম দমনে ব্রিটিশদের বিপুল
অর্থ ব্যয় হতে হতে শুরু করে। বিশেষকরে ওয়েলেসলির সময় থেকে। ভারত থেকে
পাঠানো অর্থে অংশিদারদের লভ্যাংশ দেওয়া যেতনা। তথন ধার
করতে হত। এই ধারের বোঝা মেটাতে একটাই গৌরী সেন ছিল। ভারতীয়
খাজনাদারেরা।
১৭৯২তে ভারতের
সরকারি যে ঋণ ছিল ৭০ লক্ষ টাকা ১৭৯৯তে সেই ধার গিয়ে দাঁড়াল ১০০ লক্ষে, ১৮০৭এ
ওয়েলেসলির ভারত জোড়া যুদ্ধের ধার হল ২কোটি ৭০ লক্ষ এবং ১৮২৯সালে গিয়ে দাঁড়াবে ৩ কোটিতে। ১৮৩৮এর
মন্টগোমারি মার্টিন বলছেন, For half a
century we have gone on draining from two to three and sometimes four
million pounds sterling a year from India, which has been remitted to Great Britain to meet the deficiencies of commercial speculations, to
pay the interest of debts, to support the home
establishment, and to invest on England’s soil the accumulated
wealth of those whose lives have been spent in Hindustan.
I do not think it possible for human ingenuity to avert
entirely the evil effects of a continued drain of three or
four million pounds a year from a distant country like India
and which is never returned to it in any shape(The
History, Antiquities, Topography, and Statistics of Eastern India: Puraniya,
Ronggopoor and Assam বইটি থেকে)। এবার পি জে
মার্শালএর তত্বিকতায়পূর্ণ বক্তব্য, ভারত থেকে সর্বাধিক
পাঁচ লক্ষ পাউন্ডের গল্পগাছাটি মিলিয়ে নিন।
জন শোর লিখলেন, The halcyon days of India are over;
she has been drained of a large proportion of the wealth she
once possessed; and her energies have been cramped by a sordid
system
of misrule to which the interests of millions have been sacrificed for the
benefit
of the few. রমেশ দত্ত বললেন, ‘Within twelve years after the change
in administration, the Economic Drain from India had
increased fourfold. India suffered this steady and
increasing drain and prepared herself for those frequent and
widespread famines which marked the last quarter of the nineteenth
century. They were the natural economic results of a
continuous drain such as no country, no earth could
bear’. Our Financial Relations
with India (1959), পুস্তকে Sir George Wingate বললেন, India should
defray all the expenses of civil and military
administration incurred in India, while Britain should meet the expenses
incurred
in England(Notes on Indian Affairs –
John Shore).
১৭৬৫তে ক্লাইভ লন্ডনের ডিরেক্টর সভাকে লিখলেন, দেওয়ানি
লাভের পর বছরে আয় হওয়া উচিত আড়াই কোটি টাকা। পরে আরও
বাড়বে(ছিয়াত্তরের মন্বন্তর) ২০-৩০ লাখ টাকা। বাঙলায়
কোম্পনির ব্যয় বছরে ৬০ লাখ টাকা মাত্র। নবাবের ভাতা কমিয়ে ৪২ লাখ করা হয়েছে। মোঘল
দরবারে দিতে হয় ২৬ লক্ষ। সমস্ত কিছু বাদ
দিয়ে কোম্পানির হাতে থাকবে ১,২২,০০,০০০ টাকা। ১৭৭৩এর
হিসেবে আয় ১,৩০,৬৬,৭৬১ পাউন্ড খরচ ৯০,২৭,৬০৯ পাউন্ড মোট ৮০,৩৭,১৫২ পাউন্ড ইংলন্ডে
পাঠানো হয়েছে। ভারত থেকে আমাদানি করা সমস্ত পণ্যের দাম কোম্পানির
রাজস্ব মুনাফা থেকে মেটানো হত। ১৭৮৩র পার্লামেন্টের সিলেক্ট কমিটির
এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিনিময়ে কিছু না দিয়েই ভারত থেকে আমদানি পণ্য নিয়ে যাওয়া
হয়েছে। ১৮৩২এর পার্লামেন্টের সমীক্ষার পাঁচ বছর পর, Montgomery
Martin লিখবেন; ... “We have done
everything
possible to impoverish still further the miserable beings (Indians) subject to
the cruel selfishness of English commerce ...
Under
the pretence of Free Trade, England has compelled the
Hindus to receive the products of the steam-looms of Lancashire, Yorkshire,
Glasgow
and Co., at mere nominal duties; while the hand-wrought
manufactures of Bengal and Bihar, beautiful in fabric
and durable in wear, have had heavy and almost protective
duties
imposed on their importation to England”.
১৭৫৭র পর থেকে বাঙলা থেকে সোনা-রূপা ইওরোপে পাঠানোর
প্রক্রিয়া শুরু হল। ১৭৮০তে ওয়ারেন
হেস্টিংস জানিয়েছেন, প্রতি বছর প্রায় ৪০ লাখ টাকার সোনা-রূপা ব্রিটেনে আমদানি করা
হয়। বাঙলা থেকে প্রতি বছর মোট রপ্তানি করা সোনা-রূপোর ৪০
শতাংশ। কোম্পানি এছাড়াও
অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যমেও ইওরোপে দামি ধাতু চালান করতেন। ‘There were only two ways
by which a servant of the Company could wish propriety, remit his fortune to
England; by bills on the Company or by diamonds’(The
Pictorial History of England During the Reign of George the Third: 1785-1791 By George Lillie Craik, Charles MacFarlane)। সেটি
কত পরিমানে ভারত থেকে নির্গত হত, তার কোনও
সূত্র সরকারি নথিপত্রে উল্লেখ পাওয়া যায় না। কোম্পানি দেওয়ানি লাভের পর থেকে এই নির্গমণের পরিমান বাড়তে থাকে দ্রুতহারে। ১৭৭২এ বাঙলা লুঠের
পদ্ধতিগুলি ক্লাইভ সবার সামনে হাট করে দিলেন।
No comments:
Post a Comment