বাংলা
সকলের মহাজন
বলছেন
প্রফুল্লচন্দ্র রায়মশাই। ...দাক্ষিণাত্যে সামরিক অভিযান
করিবার নিমিত্ত আওরঙজেবের তখন অর্থের বিশেষ প্রয়োজন হইয়াছিল, এবং মুর্শিদ কুলি খাঁ
এই অর্থ যোগাইয়া সম্রাটের প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিলেন।
বাংলার নামমাত্র সুবেদার সুলতান আজিম ওসান দিল্লি যাইবার সময়ে পথিমধ্যে সম্রাট
আওরঙজেবের মৃত্যুসংবাদ শুনিলেন(১৭০৭)।
বাংলা হইতে সংগৃহীত রাজস্ব প্রায় এককোটী টাকা তাঁহার হস্তগত হইল।
খুব সম্ভবতঃ এই টাকা দিল্লীর সম্রাটকে দেয়
বাংলার শেষ বার্ষিক রাজস্ব।
...১৭৪০-৫০খৃঃ পর্যন্ত মহারাষ্ট্রীয়েরা বাংলাদেশ হইতে যে ধন সম্পত্তি
লুন্ঠন এবং চৌথ আদায় করিয়াছিল, তাহার পরিমান কয়েক কোটী টাকা হইবে।
সৈয়র মুতাখেরিনের মতে, প্রথম অভিযানের সময়ে মুর্শিদাবাদ সহরের চারিদিকে প্রাচীর
ছিল না। সেই সময়ে মীর
হাবিব এক দল অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া আলিবর্দী খাঁর আদমনের পূর্বেই মুর্শিদাবাদ সহর
আক্রমণ করেন এবং জগতশেঠের বাড়ী হইতে দুই কোটী টাকার আর্কট মুদ্রা লইয়া যান।
কিন্তু এই বিপুল অর্থ লুণ্ঠনের ফলে জগতশেঠ ভ্রাতৃদ্বয়ের কিছুমাত্র সম্পদ ক্ষয় হয়
না। তাঁহারা পূর্বের মতই সরকারকে এক একবার এক কোটী টাকার
হুন্ডী বা দর্শনী দিতে থাকিতেন।
...পলাশী
যুদ্ধের পর, ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতেই প্রকৃত ক্ষমতা আসিয়া পড়িল এবং রোমের
প্রিটারিয়ান গার্ডদের মত তাঁহারাও মুর্শিদাবাদের মসনদ নীলামে সর্বোচ্চ দরে বিক্রয়
করিলেন। হাউস অব কমন্সের সিল্ক্ট কমিটির তৃতীয় রিপোর্ট
অনুসারে(১৭৭৩) দেখা যায় যা, ১৭৫৭-১৭৬৫ সাল পর্যন্ত বাঙলার ওয়ারউইককেরা
বাংলার মসনদে নতূন নতূন নবাবকে বসাইয়া ৫।৬
কোটী টাকার কম অর্থ উপার্জন করেন না। এই বিপুল অর্থের অধিকাংশই
কোনও না কোনও আকারে ইংলন্ডে প্রেরিত হইয়াছিল। কিন্তু পরে যাহা ঘটিয়াছে, তাহার তুলনায় ইহা অতি
সামান্য অনিষ্ট করিয়াছে(তিনি বোধ হয় খবর পাননি এই সময়ের
মধ্যে ইংরেজ বণিকেরা গায়ের জোরে বাঙলার পাইকারি ব্যবসার জখল নেয়, তার বিবরণ পরে
বলা হয়েছে।) ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে দিল্লিীর নামমাত্রে পর্যবসিত সম্রাটের
নিকট হইতে দেওয়ানী পাইয়া, কোম্পানী – আইনতঃ ও কার্যতঃ – বাংলার শাসনকর্তা হইয়া বসিলেন।
বাংলার মোট রাজস্ব হইতে মোগল মম্রাটের কর(২৬লক্ষ টাকা), নবাবের ভাতা, এবং আদায়
খরচা বাদ দিয়া যাহা অবশিষ্ট থাকিত, তাহা মূলধন
রূপে খাটানো হইত। (নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহ – ইকনমিক এনালস )
ইস্ট
ইন্ডিয়া কোম্পানীর ষ্টক হোল্ডারগণ এমন কি ব্রিটিশ গবর্মেন্টও বাংলার রাজস্বের ভাগ
দাবী করিতে লাগিলেন। এই উদ্বৃত্ত অধিকাংশ দ্বারাই পণ্য
ক্রয় করিয়া রপ্তানি করা হইতে লাগিল, কিন্তু পরিবর্তে বাংলার কিছুই লাভ হইল না।
একটি
দৃষ্টান্ত দিলে কথাটা পরিষ্কার হইবে। ১৭৮৬ খৃষ্টাব্দেও রাজস্ব
আদায় করা কালেক্টরের প্রধান কর্তব্য ছিল এবং উহার সাফল্যের উপরেই তাঁহার সুনাম
নির্ভর করিত, তাঁহার শাসনের আমলে প্রজাদের অবস্থা ধর্তব্যের মধ্যেই ছিল
না(হান্টার)। বীরভূম ও বিষ্ণুপুর এই দুই জেলার নিট রাজস্বের এক লক্ষ
পাউন্ডের বেশী হইত, এবং গবর্ণমেন্টের শাসন ব্যয় ৫ হাজার পাউন্ডের বেশী হইত না।
অবশিষ্ট ৯৫ হাজার পাউন্ডের কিয়দংশ কলিকাতা বা অন্যান্য স্থানের জন্য তোষাখানায়
পাঠানো হইত এবং কিয়দংশ জেলায় জেলায় কোম্পানীর কারবার চালাইবার জন্য ব্যয় করা হইত।
রাজস্বের
উদ্বৃত্তাংশ মূলধন রূপে(ইনভেস্টমেন্ট) খাটানোর কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে।
ব্যাপারটা কি এবং তাহার পরিণামই বা কিরূপ হিয়াছিল তাহা হাউস অব কমন্সের সিলেক্ট
কমিটির ৯ম রিপোর্টে(১৭৮৩) বিশদরূপে বর্ণনা করা হইয়াছেঃ- বাংলার রাজস্বের কিয়দংশ
বিলাতে রপ্তানী করিবার উদ্দেশ্যে পণ্য ক্রয় করিবার জন্য পৃথক ভাবে রাখা হইত এবং
ইহাকেই ইনভেস্টমেন্ট বলিত।
এই ইনভেস্টমেন্টএর পরিমানের ওপর কোম্পানীর প্রধান কর্মচারীদের যোগ্যতা
নির্ভর করিত। ভারতের দারিদ্র্য ইহাই ছিল প্রধান কারন, অথচ ইহাকেই
তাহার ঐশ্বর্যের লক্ষণ বলিয়া মনে করা হইত।
অসংখ্য বাণিজ্য পোত ভারতের মূল্যবান পণ্য সম্ভারে পূর্ণ হইয়া প্রতি বত্সর ইংলন্ডে
আসিত এবং জনসাধারণের চোখের সম্মুখে ঐ ঐশ্বর্যের দৃশ্য প্রদর্শিত হইত।
লোকে মনে করিত, যে দেশ হইতে এমন সব মূল্যবান পণ্যসম্ভার রপ্তানী হইয়া আসিতে পারে,
তাহা না জানি কতই ঐশ্বর্যশালী ও সেখানকার অধিবাসীরা কত সুখী! এই রপ্তানী পণ্যের
দ্বারা এই রূপ মনে হইতে পারিত যে,
প্রতিদানে ইংলন্ড হিতেও পণ্য সম্ভার ভারতে রপ্তানী হয় এবং সেখানকার ব্যবসায়ীদের মূলধন বৃদ্ধি পায়।
কিন্তু ইহা প্রকৃতপক্ষে বাণিজ্যসম্ভার নয়, ভারতের পক্ষ হইতে প্রভু ইংলন্ডকে দেয়
বার্ষিক কর মাত্র, এবং তাহাই লোকের মনে ঐশ্বর্যের মিথ্যা মায়া সৃষ্টি করিত।
হান্টারের
ভারত-চিন-ইংলন্ডের মৃত্যুত্রিভূজ বর্ণনা দিচ্ছেন তিনিঃ- ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী
ব্যসাদার হিসাবে প্রতি বত্সর প্রায় ২.৫ লক্ষ পাউন্ড বাংলা হইতে চীন লইত, মাদ্রাজ
তাহার মূলধনের জন্য বাঙলা হইতে অর্থ
সংগ্রহ করিত, এবং বোম্বাই তাহার শাসন ব্যয় যোগাইতে পারিত না, বাংলা হইতেই ঐ ব্যয়
যোগাইতে হইত। কাউন্সিল সর্বদা এই অভিযোগ করিতেন যে, একদিকে
অন্তর্বাণিজ্য চালাইবার মত মুদ্রা দেশে থাকিত না, অন্যদিকে দেশ হইতে ক্রমাগত অজস্র
রৌপ্য বাহিরে রপ্তানী হইত।
১৭৮০খৃঃ প্রধান সেনাপতি স্যর আয়ার কুট সপরিষদ গভর্নর জেনারেলকে নিম্নলিখিত
পত্র লিখেনঃ- মাদ্রাজের ধনভাণ্ডার শূন্য, অথচ ফোর্ট জর্জের ব্যয়ের জন্য মাসিক ৭
লক্ষ টাকার বেশী আশু প্রয়োজন। ইহার প্রত্যেক কড়ি বাংলা হইতেই
সংগ্রহ করিতে হইবে...।
...মারাঠা যুদ্ধ চালাইবার জন্য কলিকাতার ধনভান্ডার শূন্য করা হইয়াছিল।
...১৭৯০ খৃষ্টাব্দের শেষে টিপু সুলতানের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে কোম্পানীর ধনভান্ডার
শোষিত হইয়াছিল। ...স্মরণাতীত কাল হইতে পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত বাংলাই ছিল
ভারতের মহাজন।
পলাশীর
শোষণ
নরেন্দ্র
কৃষ্ণ সিংহ এনালস উল্লেখ করে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলছেন, ...১৭০৮খৃঃ-১৭৫৬খৃঃ পর্যন্ত বাংলায় ইংরাজ
কোম্পানীর আমদানী পণ্যের শতকরী ৭৪ ভাগই ছিল স্বর্ণ এবং ইহার পরিমান ছিল ৬৪,০৬,০২৩
পাউন্ড। ইংরাজ কোম্পানীর কথা ছাড়িয়া দিলেও, অষ্টাদশ শতাব্দীর
প্রথমার্ধ বাংলার অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য উভয়ই বেশ উন্নতিশীল ছিল।
বিন্দু, আর্মানী এবং মুসলমান বণিকেরা ভারতের অন্যান্য প্রদেশ এবং আরব, তুরস্ক ও
পারস্যের সঙ্গে প্রভুত পরিমাণে ব্যবসা চালাইত। কোম্পানীর কর্মচারীরা ভারত হইতে প্রভূত ধন
সঞ্চয় করিত এবং বিলাতে ফিরিয়া অসদুপায়ে লব্ধ সেই ঐশ্বর্যে নবাবী করিত।
তাহারা যতদূর সম্ভব জাঁকজমক ও বিলাসিতার মধ্যে বাস করিত।
সমসাময়িক ইংরাজী সাহিত্যে এই সব নবাবদের বিলাস-ব্যসনের প্রতি তীব্র শ্লেষ ও
বিদ্রুপ আছে- রিচ ইন দ্য জেমস অব ইন্ডিয়াজ গাউডি জোন, এন্ড প্লান্ডার, পাইলড
ফ্রম কিংডমস নট দেয়ার ওন। ...ক্লাউড
স্ট্যাম্প ডিসগ্রেস অন ম্যানস পলিউটেড নেম, এন্ড বার্টার, উইথ দেয়ার গোল্ড,
ইটারনাল শেম।
১৭৫৭
হইতে ১৭৮০ পর্যন্ত ভারত হইতে (সরাসরি) যে ধন ইংলন্ডে শোষিত হইয়াছিল তাহার পরিমান ৩
কোটী ৮০ লক্ষ পাউন্ডের কম নহে। ...১৭৬৬ খৃষ্টাব্দে লর্ড ক্লাইভ
পার্লামেন্টারি কমিটির সম্মুখে তাঁহার সাক্ষে বলেনঃ- মুর্শিদাবাদ সহর লন্ডন
সহরের মতই বিশাল, জনবহুল ও ঐশ্বর্যশালী।
প্রভেদ এই যে, প্রথমোক্ত সহরে এমন সব প্রভূত ঐশ্বর্যশালী ব্যক্তি আছেন, যাঁহাদের
সঙ্গে লন্ডনের কোন ধনী ব্যক্তির তুলনা হইতে পারে না।
কিন্তু ২৫ বত্সরেই ঐ মুর্শিবাদ সহরেরর অবস্থা গজভুক্ত কপিত্থবত্ হইয়াছিল।
পলাশীর শোষণের ফলে সর্বত্র ধ্বংসের চিহ্ন পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছিল।
তিনি ডিন ইনজের আউটস্পোকন এসেজএর কথা উল্লেখ করছেন, বাংলাদেশের ধনলুণ্ঠনের ফলেই
প্রথম প্রেরণা আসিল। ক্লাইভের
পলাশী বিজয়ের পর ৩০ বত্সর ধরিয়া বাংলা হইতে ঐশ্বর্যের স্রোত বহিয়া আসিয়াছিল।
অসদুপায়ে লব্ধ এই অর্থ ইংলন্ডের শিল্প
বাণিজ্য গঠনে শক্তি যোগাইয়াছিল। ১৮৭০খৃষ্টাব্দের
পরে ফ্রান্সের নিকট হইতে লুণ্ঠিত পাঁচ মিলিয়ার্ড অর্থ জর্মানীর শিল্প বাণিজ্য গঠনে
এই ভাবেই সহায়তা করিয়াছিল।
১৮৮৬
সালের ব্রহ্ম বিজয়ের ফলও ঠিক এইরূপ হইয়াছিল। ২০
বত্সর পর্যন্ত এই দেশ তাহার শাসন ব্যয়
যোগাইতে পারিত না এবং অন্যান্য প্রদেশ সে জন্য অর্থ সংগ্রহ করিতে হইত।
কিন্তু উত্তর ব্রহ্মবিজয়ের পূর্বেও দক্ষিণ বা নিম্ন ব্রহ্মও তাহার শাসন ব্যয়
যোগাইতে পারিত না। গোখেল বলেন যে, প্রায় ৪০ বত্সর
ধরিয়া ব্রহ্মদেশ ভারতের শ্বেতহস্তীস্বরূপ ছিল এবং ইহার ফলে বর্তমানে(২৭মার্চ,
১৯১১) ভারতের নিকট ব্রহ্মদেশের ঋণ প্রায় ৬২ কোটী টাকা।
কিন্তু এই বিপুল অর্থের প্রধান অংশই বাংলাকে বহন করিতে হইয়াছিল।
ইহার কীরন শুধু লবনের উপর শুল্কবৃদ্ধি নয়, ভারত গবর্ণমেন্টের রাজকোষে বাংলাই
সবথেকে বেশী টাকা দেয়। ...বাঙলার ভূতপূর্ব লেঃ গভর্ণর
স্যার আলেকজান্ডার ম্যাকেঞ্জি ১৮৯৬ সালে ইম্পিরিয়াল বাজেট আলোচনার সময় বলেন, - এই
প্রদেশরূপী মেষকে মাটিতে ফেলিয়া তাহার লোমগুলি নির্মূল করিয়া কাটিয়া লওয়া হইতেছে।
যতক্ষণ পর্যন্ত পুনরায় রোমোদ্গম না হয়, ততক্ষণ সে শীতে থর থর করিয়া কাঁপিতে থাকে(অবশ্য
রোমোদ্গম হইলেই পুনরায় উহা কাটিয়া লওয়া হয়।)
No comments:
Post a Comment