প্রণতি বিনয় ঘোষ
সবে দাড়ি গজানোর বয়সে কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো বইএর দোকানগুলোতে ঘুরতে ঘুরতে একখন্ড, পরে মোটামুটি পরিপক্ক হলে, প্রকাশ ভবনসূত্রে হাতে আসে চারখন্ডে বিনয় ঘেষের পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি বই। প্রত্যেকটি খন্ড আজও নতুন। আমাদের এই বইতে বিনয়বাবুর নানান দার্শনিক অবস্থান কঠোর সমালোচনা করেছি। খুব আশ্চর্য মনে হয়, যিনি এডামের শিক্ষা সমীক্ষা এক লাইনে সেরে দেন, যিনি বিদ্যাসাগরের কলকাতা আগমনকে যুগসন্ধিরূপে বর্ণনা করেন, যিনি বিদ্যাসাগরের ভারতীয় নানান দর্শণের ন্যুনতা ঘোষণাকে অমিতব্যয়ীবাক্যে স্বাগত জানান, যিনি মেকলের ১৮৩৫ সালের অশ্লীলতম মিনিটটিকে প্রগতিশীলতার ছাপ্পা মারেন, পারম্পরিক গ্রামব্যবস্থাহন্তা শহর কলকাতার বাড়বাড়ন্তে অত্যধিক খুশি হন, শেষ বয়সে সমালোচনা করলেও প্রথমজীবনের রচনাগুলিতে বাঙলা তথা কলকাত্তাই নবজাগরণের দর্শণে ডুবেছিলেন গলাপর্যন্ত, মধ্যবিত্তের ক্ষমতা দখলীয় মার্ক্সীয় দর্শণ বিষয়ে অপরিমেয় উচ্ছসিত, সদ্য বিলেত থেকে ভারত তথা বাঙলায় আগত নতুন কেন্দ্রিকৃত পৃথিবী ধ্বংসের কারিগর পশ্চিমি প্রযুক্তিতে গদগদ এবং বেতর, ব্রিটিশদের ভারতের পরিকাঠামো ভাঙা কর্মকে সমর্থন করছেন দু হাত তুলে, তিনিই অবলীলায় ইওরোপিয় শিক্ষায় শিক্ষিত বামপন্থীকথিত অজ্ঞ, মূঢ়, সামন্ততান্ত্রিকতায় আপাদমস্তক ডুবেথাকা গ্রামীণ বাঙলার মানুষদের কৃতির, জ্ঞানের জয়গান গাইছেন কম্বুকন্ঠে, তাদের জোরের যায়গা ধরিয়ে দিচ্ছেন, শুধুই সাবলটারন, দলিত, প্রান্তিক বলে তাদের অসহায়তাকে প্রচার করছেন না। নিজেদের অভিজ্ঞতায় মাঠেঘাটে দেখেছি, সেই বইএর খন্ডগুলির বেশ কিছু তথ্যে অসংগতি। তাঁর সেই সীমাবদ্ধতাটি আমাদের খুব একটা ভাবায়নি, বিমুখও করে নি। ভাবিয়েছিল, মার্ক্সীয় দর্শণে আপাদমস্তক ডুবে থাকা এই মানুষটির বাঙলার গ্রাম্য মানুষের প্রতি অসম্ভব প্রেম আর শ্রদ্ধাটিকে নজর দেওয়ার, যে অনির্বচনীয় গ্রামবাঙালি প্রেম আমরা দেখেছি তাঁর পূর্বজদের লেখ্যভঙ্গীতেও। তিনি আমাদের আজও টেনে রেখেছে ভীষণভাবে।
মধ্যবিত্তের স্বঘোষিত বামপন্থার দায়ের বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টার আগেই, গ্রামীণ মানুষগুলো নিজস্ব দর্শণে ভারতীয় সভ্যতাকে প্রায় নিজহাতে গড়ে তুলেছেন, সেই ধারণাটি কিন্তু প্রথম আমরা ভাসাভাসাভাবে পেয়েছি বিনয় ঘোষের রচনা সূত্র থেকেই। সুকুমার সেন থেকে অরুণ রায়, অনেকেই চেষ্টা করেছেন বাঙলার নানান সাংস্কৃতিক সূত্রে বিদেশি প্রভাবের দর্শণকে প্রাধাণ্য দেওয়ার – যেমন মমি পুতুল, যেমন কমলে কামিনী। একসময় এ তত্বে আমরা অনেকেই জারিত ছিলাম। গ্রামীণ বাঙলার সব কিছুই বিদেশি প্রভাব প্রভাবিত, এই অপমানজনক তত্বের বাইরে প্রথম বেরিয়ে আসার প্রথম উত্সাহ আর উদ্যম অর্জন করেছি বিনয় ঘোষ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, জয়া মিত্র, দীনেশ চন্দ্র সেন মশাইএর রচনা থেকে।
আজও পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির খন্ডগুলি খুললে মজা পাই বেশ। ইওরোপিয় বামপন্থার চিরবালকত্বের বিচ্ছুরণে, তাঁরই প্রদর্শিত পথে প্রচলিত শহুরে ধারণাগুলিকে ভিত্তিকরে, তাঁর বাঙলার গ্রামসমাজ ভিত্তিক দর্শণিক ভাবনার ওপর বেশ কলম চালিয়েছি, পাতায় পাতায় যার চিহ্ন আজও লাঞ্ছিত হয়ে রয়েছে। সেই বালখিল্যতায় আজ অত্যন্ত লজ্জা বোধ করি – এ তথ্য জানাতে লজ্জা নেই। এই খন্ডগুলি আমাদের সামনে গ্রাম বাঙলার নতুন এক জগতের দ্বার খুলে দিয়েছিল, যেটি ভবিষ্যতে আমাদের প্রশ্নগুলিকে কৌতুহলে রাপান্তরিত করতে সাহায্য করবে। এগুলির মধ্যেদিয়ে, বিনয়বাবুর বাড়ানো হাতধরে, বাঙলার গ্রামীণ বিশ্বে প্রবেশ করেছি। কিন্তু সেই মায়াময় কদলি রাজ্য থেকে বেরোনোর উপায় রাখেননি বাঙলার গ্রামীণ মানুষেরা। বিনয়বাবুর ট্র্যাডিশনাল আর্ট এন্ড ক্রাফ্ট অব ওয়েস্ট বেঙ্গল বইটি অথবা চারখন্ডের পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি আজও ভীষণ বাস্তব। মার্ক্সীয় দর্শণ বিশ্লষণে তিনি সর্বজনীনভাবে গ্রামীণদের বাছাবাছা অপমানজনক শব্দে বিদ্ধ করেছেন – কিন্তু বাঙলার গ্রামকে বিশ্লষণে বেতর হয়ে ওঠেন গ্রামীণদের কৃতকর্ম দর্শণ বাখানে, অন্ততঃ সেই ভাবনাটি পাঠকের মধ্যে চারিয়ে দিতে পারেন তার রচনার মাধ্যমে – অন্ততঃ আমাদের মধ্যে। তাঁর একদা প্রতিদ্বন্দ্বী বামপন্থী রাজনৈতিক ভাবনার সঙ্গীরা আমাদের শ্রদ্ধা দেখে সাবধান করে প্রশ্নতুলেছেন বিনয় ঘোষমশাইএর গ্রামীণ মানুষদের শ্রদ্ধার বিষয়টি। তিনি গত হওয়ার পর, বাস্তবে গ্রামীণ মানুষদের কৃতির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল কী ছিল না সে বিষয়টি আমাদের কাছে আজ ন্যুন। এমনও হতে পারে, হয়ত বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিলই না, তার কাজ ছিল শুধুই পন্ডিতির ঢংএ গ্রামের মানুষের কৃতি বিশ্লেষণ আর ফোর্ড ফাউন্ডেশনেরমত সংস্থাগুলির চক্করে আমেরিকা যাওয়ার কেরিয়ার তৈরির প্রচেষ্টামাত্র – হতে পারে নাও হতে পারে - কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি বইতে যে অনুভূতি বিশ্লেষণ করেছেন তা প্রবলভাবে আজও সত্য।
অনেকে সাহিত্যিক কুম্ভীলকবৃত্তিরও অভিযোগ এনেছেন বিনয় ঘোষের বিরুদ্ধে। আমরা তাঁর লেখার গুণগ্রাহী, এমন অশৈলী, ইল্লুতে কান্ডে, বিনবাবু জাতীয় গ্রন্থাগারে বসে, নানান বই থেকে টুকে টুকে, এই বইগুলি লিখেছিলেন, এমন শহুরে মুচমুচে নানান তথ্যও আমাদের যেচে সরবরাহ করেছেন নানান গুণিজন (বুকঠুকে বলি, আমরাও বহুবই থেকে টুকেটুকে এই বইখানি রচনা করেছি – এই বইতে কোথাও কোথাও আমাদের এমনও মনে হয়েছে যে, পাতার পর পাতা এটি যেন, অন্য বইগুলির উদ্ধৃতির বাহন হয়ে উঠছে)। এই কাজ শুরুর আধ দশক আগেই তিনি গত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আমরা তাঁর মত-অমত কোনওটাই পাইনি, জানারও সুযোগ হয় নি, এত্ত সব মধ্যবিত্তসুলভ শহরসুলভ মন্তব্য বাজিয়ে দেখার সুযোগও পেতে চাইনি। আমাদের সম্বল তাঁর রচিত নানান প্রবন্ধ আর গ্রন্থগুলি। কলকাতার প্রণম্য মহাজ্ঞাণীগুনী মহলে কোনও দিনই আমাদের খুব একটা গতায়াত ছিল না। কলকাতার জ্ঞাণীদের মধ্যে তিনি খুবএকটা সর্বজনগ্রাহ্যও ছিলেন এমনও নয়, আজও সে তথ্য আমাদের সামনে খুব নতুন নয়। আমরা নিজেদের গুণীও মনে করি না। গাঁইয়াদের সঙ্গে প্রায় বারমাস থাকি – নিজেরা গাঁইয়া হয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। তাই বিনীতভাবেই আমরা বিনয়ঘোষের যথেষ্ট সমালেচনা করেও গ্রামীণদের বিষয়ে তাঁর দর্শণপন্থী।
অধিকাংশ বিষয়ে একমত না হয়েও, তাঁর বিদ্যাসাগর এবং ততকালীন বাঙালি সমাজ বইটি আমাদের সে সময়টুকুর বাঙলার সমাজ তথা কলকাতাকে বুঝতে সাহায্য করেছে। বিদ্যাসাগর মশাইএর সময়কে ধরে তিনি যে বাঙলার নবজাগরণের ইতিহাস রচনা করেছেন, সেই রচনাটির নানান তথ্যপঞ্জী আমরা কাজে লাগিয়েছি বইএর বহু অধ্যায়েও। মেট্রপলিটন মন, বাঙলার নবজাগরণ ইত্যাদি বইএর মূল দার্শণিক প্রতিপাদ্যের সঙ্গে আমাদের এই কাজের যোজন প্রমাণ দূরত্ব। কিন্তু খেটেখুটে যে তথ্য তিনি আহরণ করেছেন সে সবের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, সে সব আমরা এই বইএর বহু স্থানে ব্যবহার করেছি। তিনি এবং সুপ্রকাশ রায় ঘোষিত মার্ক্সবাদী, তাই তাঁরা বইএর অঙ্গে অঙ্গে কার্ল মার্ক্সএর নানান উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন, মার্ক্সীয় দর্শণের মাধ্যমে সমাজ বিশ্লেষণের কাজটি করছেন। আমরা এই দুই মার্ক্সবাদীর নানান রচনা থেকে সরাসরি পেয়ে যাই মার্ক্সীয় দর্শণের নির্যাসটুকু, বাঙালির মার্ক্সিয় মানসটুকু।
No comments:
Post a Comment