এতদিন ধরে এশিয়ার শিল্প দ্রব্য কিনতে, ইয়োরোপ দামী ধাতু নিয়ে আসত। ফলে এশিয়ার সঙ্গে বিপুল বানিজ্য ঘাটতি বয়ে নিয়ে চলতে হত ইয়োরোপকে। পলাশী চক্রান্তে ভারত-ইয়োরোপের বানিজ্য ঘাটতি হেঁটমুন্ডঊর্ধ্বপদ হয়ে পড়ল। পলাশীর পরের সময়ের বাঙলা লুঠ চলতে চলতে কোম্পনির নজর পড়ল চিনের দিকে। পরিকল্পনা, ভারতের মতই ইয়োরোপ-চিন বাণিজ্যের পালা বদল।
প্রাথমিকভাবে, বাঙলার উদ্বৃত্ত রূপো চিনে পাঠিয়ে দামী চা কিনতে শুরু করে। অর্থাত এশিয়ার বড় দুটো দেশে ইওরোপ থেকে দামিধাতু আসা বন্ধ হয়ে গেল। পলাশির পর বাঙলার সঞ্চিত রূপো চিনে যেত। গভর্নর ভেরলেস্টের হিসেব, দেওয়ানি লাভের পরবর্তী পাঁচ বছরে ইংলন্ড আর চিনে পাঁচ কোটি পাউন্ডের রূপো পাঠানো হয়েছে। তবে হ্যমিল্টন বলছেন বাঙলা থেকে রপ্তানিকরা সোনা যেত চিনে, ব্রিটেনে নয়। চিনে এই সোনা ব্যবহার হত চা আর সিল্ক কেনার জন্য। কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট নন ইয়োরোপীয় প্রভুরা। ফলে ব্রিটিশ-ভারত-চিনের বাণিজ্য ঘাটতি থেকেই গেল। পরে আমরা দেখব চিনে বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে কোম্পানি চিনে সোনার বদলে আফিম রপ্তানি শুরু করে। এরপর ভারতের খাজনার পরিমান এত বেড়ে গেল যে, সেই টাকায় চিনে কাপড় আর আফিম যেতে লাগল। এবার ক্যান্টনে সুতির কাপড়ের রপ্তানির পরিমান কমিয়ে আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল আফিম রপ্তানির পরিমান।
প্রাথমিকভাবে, বাঙলার উদ্বৃত্ত রূপো চিনে পাঠিয়ে দামী চা কিনতে শুরু করে। অর্থাত এশিয়ার বড় দুটো দেশে ইওরোপ থেকে দামিধাতু আসা বন্ধ হয়ে গেল। পলাশির পর বাঙলার সঞ্চিত রূপো চিনে যেত। গভর্নর ভেরলেস্টের হিসেব, দেওয়ানি লাভের পরবর্তী পাঁচ বছরে ইংলন্ড আর চিনে পাঁচ কোটি পাউন্ডের রূপো পাঠানো হয়েছে। তবে হ্যমিল্টন বলছেন বাঙলা থেকে রপ্তানিকরা সোনা যেত চিনে, ব্রিটেনে নয়। চিনে এই সোনা ব্যবহার হত চা আর সিল্ক কেনার জন্য। কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট নন ইয়োরোপীয় প্রভুরা। ফলে ব্রিটিশ-ভারত-চিনের বাণিজ্য ঘাটতি থেকেই গেল। পরে আমরা দেখব চিনে বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে কোম্পানি চিনে সোনার বদলে আফিম রপ্তানি শুরু করে। এরপর ভারতের খাজনার পরিমান এত বেড়ে গেল যে, সেই টাকায় চিনে কাপড় আর আফিম যেতে লাগল। এবার ক্যান্টনে সুতির কাপড়ের রপ্তানির পরিমান কমিয়ে আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল আফিম রপ্তানির পরিমান।
সরকারিভাবে ব্রিটিশ বাঙলার আফিম আর ব্রিটিশ বহির্ভূত
অঞ্চল মালওয়ার আফিম চিনে রপ্তানি হত। ব্রিটিশ বাণিজ্যের গতিজাড্যে
বাঙলা-বিহার-মালওয়ার রক্ত জল করা আফিম চাষের উদ্বৃত্ত চিনাদের মৌতাতে রেখে ইওরোপ
আর ব্রিটেনের জন্য মহার্ঘ চা কেনা হতে লাগল। ১৭৬৬র ১১ জানুয়ারি কলকাতার সিলেক্ট
কমিটি ইঙ্গ-চিন বাণিজ্যের জন্য তিন লক্ষ পাউন্ড বরাদ্দ করে। হাউস অব
কমন্সের প্রতিবেদনে, চিন বাণিজ্যের জন্য প্রতিবছর এক লাখ পাউন্ড বরাদ্দ ছিল। সুমাত্রা
আর মালয়ে ব্যবসার জন্য কোম্পানি বাঙলা থেকে প্রতিবছর ৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে। দেওয়ানি
লাভের পর প্রতিবছর মাদ্রাজ-বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে পঁচিশ থেকে তিরিশ লাখ টাকা
পাঠানো হত। এক অংশ প্রশাসনের ঘাটতি মেটাতে অন্য অংশ পণ্য ক্রয় করতে। কমিটি
অব সিক্রেসির মতে ১৭৬১-৬২ থেকে ১৭৭০-৭১ পর্যন্ত বাঙলা সুবা
থেকে মাদ্রাজ-বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে ২৩,৫৮,২৯৮ ভর্তুকি পাউন্ড পাঠানো হয়। আলোচ্য
শতকের শেষেরদিকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আর বিশ্বের নানান দেশে যুদ্ধবিগ্রহে
কোম্পানির বার্ষিক ব্যয় প্রচুর বেড়ে যায়। ১৭৭৩-৮৩র আমেরিকার স্বাধীণতা
যুদ্ধের সূত্রে ফরাসি উপনিবেশ পণ্ডিচেরি, চুঁচুড়া আর মাহে দখল করে। আর ফরাসি
বিপ্লবের সূত্রে শ্রীলঙ্কা, মালাক্কা, বান্দা আর এমবোইনা দখল করে। ফলে এই
যুদ্ধ বিগ্রহে কোম্পনির আর্থিক দায়দায়িত্ব বেড়ে যায় অনেকগুণ। বাঙলা থেকে
ঋণ নিয়ে কোম্পানি এই যুদ্ধের ব্যয়ভার সামলাত। ১৭৬১-৬২
থেকে ১৭৭০-৭১ পর্যন্ত কোম্পানির বাঙলা সুবায় ঋণ ছিল ১৩,৩৭,৭৩১ পাউন্ড। যদিও
ব্রিটিশপন্থী অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলছেন, ১৭৮০রপর কোম্পানির লুঠ নাকি বন্ধ হয়ে
যায়।
অথচ নতুন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এই লুঠ ১৯৪৭ পর্যন্ত চলেছিল, শুধু ২৪ পরগণা জেলাতেই
আয়-ব্যয়ের তুলনায় আয়ের পাল্লাছিল ছিল চারগুণ বেশি ভারি।
আগে যে আলোচনা করলাম তাকে সংক্ষেপিত করলে বোঝাযাবে যে
চারটি পদ্ধতিতে বাঙলা থেকে লুন্ঠিত সম্পদ বাইরে বেরিয়ে যেতে থাকে ১) এদেশিয়
সম্পদের মাধ্যমে কোম্পানির বেচাকেনার জন্য পণ্য কেনা, ২) চিনের বাণিজ্য ঘাটতি
বাঙলার রাজস্ব থেকে মেটাতে হত, ৩) বাঙলা ছাড়াও অন্যান্য বোম্বাই-মাদ্রাজ
প্রেসিডেন্সির ব্যয়ও বাঙলা থেকে মোটাতে হত, সেখানের রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য পুঁজির
যেগান যেত বাঙলা থেকেই ৪) যুদ্ধ বিগ্রহের জন্যও অর্থ জেগাত বাঙলা। আদতে যে
লাভের উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে পা রেখেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, কোম্পানি স্থাপনের
প্রায় দেড়শ বছর পর সেই উদ্দেশ্য সুদে আসলে উসুল করে নেয় কোম্পানির শাসক
বাহাদুরেরা। ইংলন্ডের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাথমিকভাবেই বাঙলার
বাণিজ্য আর উদ্বৃত্ত রাজস্ব দিয়েই ব্রিটেন তার দেশের কলের চাকা ঘুরিয়েছে। শুধু
ব্রিটেনই নয়, বৈদেশিক বাণিজ্যে, বিশেষ করে এশিয়ার ভারতচিনসহ নানান দেশের সঙ্গে
বাণিজ্যকর্মে অধমর্ণ ইওরোপকে উত্তমর্ণ মহাদেশরূপে গড়ে তুলতে প্রাথমিক যোগদান
দিয়েছে।
ইংরেজদের আগে অন্যান্য ভারতীয় সমাজেরমত বাঙলাও বহু কাল
ধরে বহু লুঠেরা দেখেছে, সয়েছে, আবার নতুন করে সমাজ সাজিয়েছে। সব শেষের
লুঠেরা ছিল মারাঠি বর্গীরা। তাদের মুখের হুঙ্কার রূপি দেহি
বাঙলার সমাজে সমাজে ছড়িয়ে যায়। রূপি না পেলে বর্গীরা নাকে জলভরারমত
নানান প্রাণকাড়া অত্যাচার করত। লুঠেপুটে যা পেত ঘোড়ায় চাপিয়ে নিয়ে
যেত মারাঠা মুলুকে। কিন্তু সুসভ্য
ইংরেজরা সব লুঠেরার বাড়া। তারা লুঠের পরও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র
নয়।
তাদের অত্যাচারী শাসন আর বিত্তবাসনা আকাশের সীমানাকেও হার মানায়। পলাশির
দেড় দশক পর ক্লাইভ পার্লামেন্টে ইমপিচমেন্টের উত্তরে সদম্ভে বলতে পারেন – ‘A great price was
dependent on my pleasure, an opulant city lay at my mercy; its richest bankers
bid aginst each other for my smiles; I walked through vaults which were thrown
open to me alone, piled on either hand with gold with jewels! Mr. Chairman, at
this moment I stand astonoshed at my own moderation.’ শাসকদের মডারেশনই
বটে। ক্লাইভের বামহাতের খেলা অথবা হেস্টিংসের অনৈতিক ব্যবসায়
অর্জিত সম্পদের এতই অস্বস্তি আজকের ইংলন্ডে বর্তমান যে, যে মানুষদুটির হাত ধরে
নগণ্য এক মহাদেশ আজ বিশ্বে অগ্রণী সভ্যতার তকমা অর্জন করল, তাদের একটিও মূর্তি
অথবা রাস্তার নাম নেই লন্ডন শহরে। শহরটি যেন বেমালুম ভুলেগেছে ক্লাইভ
অথবা হেস্টিংসেরমত নিজেদের জীবন বাজি রেখে একদা ইওরোপের ভাগ্য ফেরাবার ব্রিটিশ
কলাকুশলীদের।
বর্গীরা একবার মুর্শিদাবাদে হানাদিয়ে যা পেয়েছিল তা নিয়ে
নাগপুরে নিয়ে যায়। দুকোটি আর্কট টাকা লুঠ যেন দুআঁটি খড় চুরির সমান। কিন্তু
বর্গীর হামলার পর পড়ে থাকা বাঙলার সম্পদ দেখে, চকচকে চোখ ইংরেজরা প্রজন্মের পর
প্রজন্ম ধরে বাঙলা লুঠের চক্রব্যুহ পরিকল্পনা তৈরি করল। বাঙলা
সরকারের প্রতিশ্রুতিতে তিন কোটি টাকায় নতুন লুঠের রাজত্ব শুরু হল। পলাশির
চক্রান্তের ফসল তোলা জাফর আলি খান বা মির জাফর উতকোচের অর্থ কোম্পানিকে না দিয়ে
ক্লাইভকে দিলেন। ক্লাইভের সঙ্গে যেসব ইংরেজ আমলা ছিলেন তারাও বাঙলা
ঘুষের অর্থে ইংলন্ডের ধনীতম মানুষ বনে গেলেন। ১৭৬৫তে
ফেব্রুয়ারিতে মীরণের শিশুপুত্রের সিংহাসনের বসার অধিকার খারিজ করে দিয়ে মীরজাফরের
অবৈধ পুত্র নাজমুদ্দৌল্লাকে সিংহাসনে বসান তিনজন ইংরেজ, লিসেস্টার, সিনিয়র, মিডলটন। এর জন্য শিশু
নবাবের থেকে সাড়ে বাষট্টিলক্ষ টাকা নজরানা পেলেন। সিংহাসনে
আদৌ আরেহন করবেন কী না, সে সম্বন্ধে নিজের ভাগ্য পরখ করতে রেজা খাঁ ইংরেজদের দিলেন
প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা। এ ছাড়াও সিলেক্ট কমিটির অনেক বড় কর্তাও এই সুযোগে ধনী
হলেন।
রোগেভুগে মরে গিয়ে একমাত্র ফাঁকিতে পড়লেন ক্লাইভের
পলাশীপূর্ব সঙ্গী এডমিরাল ওয়াটসন। সবাই বখরা পেলেও
ওয়াটসনএর উত্তরাধিকারীদেরকে সেই অংশ দেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে যান। ওয়াটসনের ভাইবিরাদরিরা ইংলন্ডে আইনের দরজায় দাঁড়ালে
ক্লাইভ তাদের নির্দিষ্ট অর্থ নজরানাস্বরূপ পাঠিয়ে দেন। পলাশীর চক্রান্ত থেকে ১৭৬৬ পর্যন্ত দ্বৈত শাসনে বাঙলার
নবাবদের সঙ্গে নানান চুক্তি করে কোম্পানির কর্মচারীরা নিজেদের দেশে সে পাঁচকোটিরও
বেশি টাকা চালান করে। পলাশী চক্রান্তের
ইংরেজদের প্রাপ্য অর্থ মেটাতে গিয়ে শূণ্য তহবিল নিয়ে বাঙলার জনগণের স্বাধীণতা
সংগ্রাম ধংস করতে ইংরেজদের সেনা ব্যবহার করল মিরজাফর। বাঙলার স্বাধীণতা সংগ্রাম
দমনের শর্ত হল ১৭৬০ থেকে তারা বাঙলার ২৪ পরগণা, বর্ধমান, মেদিনীপুর, চট্টগ্রামের
জমিদারি পাবে। খাজনা তুলবে নবাবের
বদলে ইংরেজরা। বিশ্বের প্রথম কর্পোরেট
আউটসোর্সিংএর কাজ আদায় করল ইংরেজরা। বাঙলা তথা ভারতের
খাজনা শাসনযন্ত্রে ইংরেজদের প্রবেশের সেই শুরু, যার শেষ হবে সমগ্র দেওয়ানি আর
নিজামত তাদের হতে চলে যাওয়ার সঙ্গে। দেওয়ানি আর নিজামত
লাভের সঙ্গে বাঙলার উদ্বৃত্ত রাজস্ব ইংরেজদের অমিতপরিমান বাণিজ্যিক পুঁজি তৈরি হল।
No comments:
Post a Comment