পলাশি চক্রান্তের পর অশান্ত পরিবেশের সুযোগ নিতেন শাসনক্ষমতার দিকে হাত বাড়ানো ইংরেজদের সঙ্গে সঙ্গে নানান অঞ্চলের জমিদারেরা। তারা প্রায়শঃই নবাবকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দিতেন। বাঙলা সুবার কর আদায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রায়শাসক ইংরেজরা এই বাকি খাজনা আদায়ে সেনা ব্যবহার করতে শুরু করায় ক্রমশঃ ইংরেজ শাসন বাঙলা সুবার ওপর নতুন করে জাঁকিয়ে বসার সুযোগ পায়। ১৭৬৫ থেকে কোম্পানি রাজত্ব না পেয়েও শুধু দেওয়ানি পেয়েই বাস্তবে রাজা হয়ে বসে। অত্যাচারী দেওয়ান রেজা খাঁ আর নিজের পদ বাঁচাতে সদা ব্যস্ত নন্দকুমার ইংরেজদের নানানভাবে খুশি করতে অসম্ভব ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ইংরেজদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে উপেক্ষিত হয় জমিদার তথা রায়তদের, আরও গভীরভাবে বলাযাক বাঙলার সার্বিক স্বার্থ। বাঙলার বিকাশের অন্যতম অছি বাঙলার জমিদারির ওপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতা, ২৪ পরগণা, মেদিনীপুর, চট্টগ্রাম আর বর্ধমানের রাজস্ব আদায়ের সনদ পায়। এসব এলাকায় কেম্পানির সঙ্গে জমিদারদের নতুন করে চুক্তি আর ভূমি বন্দোবস্ত হয়। ১৭৬৫ থেকে ১৭৭২ পর্যন্ত নতুন করে ভূমি ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়নি।
মহম্মদ রেজা খাঁ আর তাঁর অধীনস্থ আমলারা আমিলদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। যে জমিদার বেশি রাজস্ব দিতে রাজি হতেন, তাকেই জমিদারির বন্দোবস্তের দায় দেওয়া হত। দেশের ঐতিহ্য ভেঙে আমিলদারি ব্যবস্থায় নব্য-জমিদারেরা ইজারাদারের ভূমিকা পালন করতে থাকেন। আমিল, জমিদারদের সঙ্গে রায়তদের সরাসরি আদানপ্রাদানের ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে থাকে। দ্রুত অর্থ রোজগার করতে নব্যজমিদারেরা যে কোনও ধরণের অমানবিক অত্যাচারী কাজকর্ম করতে এক পায়ে খাড়া থাকতেন। এদের ওপর সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণও ছিলনা। কোম্পানি দাবি অনুযায়ী অতিরিক্ত পরিমানে রাজস্ব আদায় করতে জমিদারদের প্রায় আইন ছাড়া লাঠিয়ালের ভূমিকা পালনের কাজে নিজেদের নিয়োগ করতে থাকেন। রায়তদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চলতে থাকে। ১৭৬৭তে কোম্পানির ডিরেক্টর সভা মেনে নিতে বাধ্যহয় যে রাজসাহি, ঢাকা, বীরভূম, রাজমহলে বহু রাজস্ব অনাদায়ী। আমিল জমিদার আর সরকারের দাবি মেটাতে বহু রায়ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি, পশু, পুত্রকন্যাসহ সর্বস্ব বিক্রিকরে দিতে বাধ্য হয়। কম আর অনাদায়ী রাজস্বকে বেশি রাজস্ব আদায়ের প্রক্রিয়া তৈরি করার নিদান খুঁজতে সুপারভাইজার নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত হল। সদাশয় কোম্পানি বাহাদুরের তখনও ধারণা বাঙলার বদমাইশ রায়তরা প্রশাসক আমিলদের সঙ্গে মিলে কোম্পানির রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে(বহু বাঙালি ঐতিহাসিকও একই ভাষায় এই বক্তব্য পেশ করেছেন)। ইংরেজদের ধারণা ছিল বাঙলার ভূমিরাজস্ব আরও অনেক অনেক বেশি। সুপারভাইজারেরা ১৭৭২ পর্যন্ত এই পদে আসীন ছিলেন। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীরা অনভিজ্ঞ তরুণ আর সংখ্যায় কম থাকায়, তাদের পক্ষে সবদিকে নজর রাখা, সবাইকে নিয়ন্ত্রণে রেখে যথাসম্ভব বেশি রাজস্ব আদায় সম্ভব হয়নি। সুপাপভাইজারদের সঙ্গে নিয়ে চতুর গোমস্তা আর বেনিয়ানরাই ক্রমশঃ জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেন বাঙলার কর ব্যবস্থায়, ইংরেজদের প্রাপ্য কর দিয়ে তারা আরও বেশি ব্যক্তিগত রোজগারের চেষ্টা করে গিয়েছেন।এই অবস্থা থেকে বেরোতে কোম্পানি পাঁচ বছরের মেয়াদে বাঙলার জমিদারির সর্বোচ্চ ইজারা দেওয়া শুরু করল – যাকে পাঠ্যপুস্তগুলিতে পাঁচশালা বন্দোবস্তরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। আগে ইজারাদারদের সর্বোচ্চ হারে ইজারা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিলই, কিন্তু মেয়াদকাল ছিল তিন বছর – এই সময়কাল পাঁচ বছর করা হল। এই কাজ করতে তৈরি হল, গভর্নর আর চারজনকে নিয়ে, কমিটি অব সার্কিট। খালসা বা রাজস্ব বিভাগ মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় স্থানান্তরিত হল। ১৭৭৩এ রেভিনিউ বোর্ডের তত্বাবধানে বাঙলা সুবাকে কলকাতা, পাটনা, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর, ঢাকা ও বর্ধমান এই ছয় ভাগে ভাগ করা হয়। ইংরেজ কালেক্টরের পরিবর্তে আবার নতুন করে দেশিয় দেওয়ান আর আমিলরা খাজনা আদায়ের ভার পান। পাঁচশালার বৈশিষ্ট্য ছিল ১) জমিদার, ইজারাদার অথবা তালুকদার নিজস্ব এলাকায় বর্ধিত হারে খাজনা দেওয়ার কড়ারে ইজারা পেলেন, ২)নিলামের আগেই সরকার হস্তবুদ তৈরি করে রায়তদের দেয় খাজনা, আবওয়াব প্রভৃতি নিশ্চিত করে ফেলেন, ৩)কোনও রকম নতুন কর নিষিদ্ধ হল, ৪) এই বন্দোবস্তে ইজারাদারদের কাছ থেকে জামিন নিলেন হেস্টিংস, ৫) কালেক্টরদের ব্যক্তিগত ব্যবসা, নজর, সেলামি সব বেআইনি ঘোষণা হল। বন্ধ হল বেনিয়ানদের সুদের কারবার। কিন্তু সব ভাল ভাল ব্যবস্থা সব খাতায় কলমে রইল। মাত্রারিক্ত রাজস্ব আদায়ের বণিকসুলভ মনোবৃত্তিতেই পাঁচশালা বন্দোবস্তের পতন সুনিশ্চিত ছিল। ১৭৭১এ নদিয়ার কর আদায় ছিল ৭,৩৬,৮৯৯ টাকা, পাঁচশালায় সেই কর আদায়ের বন্দোবস্ত দাঁড়ায় ১০,৬৪,৫৩০ টাকা। এই বন্দোবস্ত যে কেউই ইজারা নিতে পারতেন। হুজুরিমল আর মদনদত্ত দুই বণিক পুর্ণিয়ার ভূমিরাজস্বের ইজারা নেন। কোম্পানির সঙ্গে জুড়ে থাকা অনেকেই বেনামিতে ইজারা নেন। এই কান্ডে সরকারের বহু অর্থ অনাদায়ি থেকে যায়। রাজস্ব মকুব করতে হয়। নিষেধ সত্বেও কালেক্টররা সুদের আর মহাজনি কারবারে নতুন করে হাতপাকান। ১৭৭৫এ হেস্টিংস আর তাঁর বন্ধু বারওয়েল কর আদায়কারী হিসেবে ছোট জমিদারদের নিয়োগকরার সুপারিশ করেন।
No comments:
Post a Comment