এত বিশদে এই জমার তথ্য দেওয়ার একটাই কারন, ইংরেজ
ঐতিহাসিকদের তত্ব অনুসারে ব্রিটিশেরা ইওরোপ থেকে নতুন হিসেব রাখার জ্ঞাণ নিয়ে
এসেছিলে, যে জ্ঞাণ বাঙলা তথা ভারতের ব্যবসায়ীদের ছিল না। মোঘল আমলের ভারত বিস্তৃত শাসনের হিসাব রাখার জটিলতাতো বটেই, তার আগেও
অন্ততঃ আটহাজার বছর ধরে ভারতীয় সভ্যতা যে বিশাল জটিল অথচ বিশদ হিসেব রাখার
ব্যবস্থা তৈরি করেছিল, তা খুব কম কী। এছাড়াও
প্রচার ছিল ইংরেজরা বীমা ব্যবস্থার জন্মদাতা। যথোচিত পূর্বদেশিয় বিনয়ের সঙ্গে বলা যাক, ভারতের ব্যবসায়ীরা কয়েক হাজার
বছর ধরে বিশ্বজোড়া ব্যবসার জাল তৈরি করেছিলেন, সেই জটিল জালের এক অংশ ছিল জটিল
পুঁজি-ধার-বিনিয়োগের জটিলতম ব্যবস্থা আর বিদেশে ব্যবসা করতে যাওয়ার সময় বীমা
ব্যবস্থা – যার উল্লেখ নানান দেশিয় ঐতিহাসিক তাঁদের
গবেষণায় বারবার উল্লেখ করেছেন। এই বিষয়টি
যদিও এই বইএর আলোচনার বাইরে তবুও উল্লেখ করা গেল পাঠকদের সঠিক তথ্য দেওয়ার জন্যই।
মোগল সম্রাটেরা
কয়েক শতবছরের পরীক্ষা-নীরিক্ষার মাধ্যমে ভারত বিস্তৃত খাজনার যে কাঠামো তৈরি
করেছিলেন, তা হল, ভারতের প্রজাদের মালজমির উদ্বৃত্ত ফসল অর্থে পরিণত হয়ে মেঘল শাসক
আর ভূস্বামীদের মধ্যে বাঁটা হত। মোগল শাসকদের
জন্য যেত জমা – কৃষকদের থেকে এই জমা আদায় করতেন
জমিদার, তালুকদার আর ভূস্বামীরা। এই খিদমতের
জন্য তাঁরা রসুম ও নানকর পেতেন। রসুম আর নানকর
নিয়ে যে জমির কর আদায় করতেন তার একটি অংশ যেত নবাব সরকারে আর একটি যেত জায়গিরদারের
হাতে। ঠিকমত যাতে এই জমা আদায় হয়, তার জন্য মুর্শিদকুলি
পুণ্যাহ প্রথা চালু করেছিলেন। বছরের প্রথম
দিন অর্থাত পয়লা বৈশাখে জমিদার অথবা তাঁদের উকিলেরা মুর্শিদাবাদে সমবেত হয়ে
প্রতিশ্রুত খাজনার শেষ কিস্তি নবাবের সামনে দিনার মোহরের নজরানাসহ পেশ করতেন। নবাব জমিদারদের নানান রকম খেলাত অর্থাত পাগড়ি, পোষাক, বাহন অথবা কোমরবন্দ
দান করতেন। জমিদারিতে ফিরেগিয়ে তাঁরা আবার
পুণ্যাহ পালন করতেন প্রজাদের নিয়ে। ঐতিহাসিকেরা
আলিবর্দি খাঁ (আলিবর্দি খাঁ- বাংলার
শেষ স্বাধীন নবাব
আলিবর্দি খাঁ
সিরাজউদ্দৌলার মাতামহ। সিরাজউদ্দৌলা নবাব আলীবর্দী খাঁর উত্তরসূরি। আলিবর্দি খাঁ বাংলা, বিহার, ওড়িশার নবাব ছিলেন। পিতা মির্জা মুহম্মদ, আজম শাহের (আওরঙ্গজেবের দ্বিতীয় পুত্র) দরবারের কর্মকর্তা ছিলেন। তার
পিতামহ আওরঙ্গজেবের সৎ ভাই। আজম শাহ তাকে পিলখানার পরিচালক
হিসেবে নিয়োগ করেন। ১৭০৭ এর যুদ্ধে আজম শাহের মৃত্যুর পর মির্জা
মুহাম্মদ আলী সমস্যার সম্মুখীন হন। বাকি জীবন তিনি সপরিবারে ১৭২০ সালে বাংলায় কাটাতে চলে
আসেন। বাংলার তৎকালীন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ তাকে গ্রহণ করেন নি। ফলে, মির্জা
মুহাম্মদ আলী চুতায় গমন করেন, শাসক সুজাউদ্দিন
মুহাম্মদ খান তাকে
সম্মানের সাথে গ্রহণ করেন। সুজাউদ্দিন তাকে মাসিক ১০০ টাকা
বেতনের চাকুরিতে নিয়োগ করেন। কাজ ও
বিশ্বস্ততায় পদোন্নতিতে ওড়িশার কিছু জমিদারির তদারকির সুযোগ পান। ওড়িশায় মির্জা মুহাম্মদ আলী প্রশাসনিক দক্ষতা
লাভ করেন। ওড়িশার দ্বায়িত্ব পালন ছাড়াও সুজাউদ্দিনের শ্বশুর মুর্শিদকুলি
খানের মৃত্যুর
পর বাংলার মসনদ দখলে সুজাউদ্দিনকে তিনি সাহায্য করেন। ফলশ্রুতিতে মির্জা কে চাকলা আকবরনগর
(রাজমহল) এর ফৌজদার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
১৭২৮ সালে তাকে আলীবর্দি উপাধি দেওয়া হয়।
নতুন ফৌজদারের অধীনে রাজমহলের জনগন শান্তি ও সমৃদ্ধি লাভ করে। প্রদেশের
প্রায় সকল ক্ষেত্রে আলীবর্দি সুজাউদ্দিনের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। বছরে
একবার রাজমহল থেকে মুর্শিদাবাদে তার ডাক পড়ত। ১৭৩২ সালে সম্রাট মুহাম্মদ শাহ বিহারকে বাংলা সুবার অধীনে নিয়ে আসেন।
কিন্তু নবাব সুজাউদ্দিন সম্পূর্ণ অঞ্চল নিজের অধীনে রাখার থেকে, আলীবর্দীকে বিহারের নিজাম হিসেবে নিয়োগের
সিদ্ধান্ত নেন। কিছু দিন আগে আলীবর্দির কনিষ্ঠ কন্যা আমিনা বেগম তার কনিষ্ঠ ভাইপো
জৈনুদ্দিন আহমেদ খানকে বিয়ে করেন। আমিনা বেগমের গর্ভেই বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার জন্ম হয়। আলীবর্দীর নিজের কোন পুত্র
সন্তান ছিল না। আলীবর্দী সিরাজউদ্দৌলাকে তার উত্তরসূরি ঘোষণা করেন। সূত্রঃ http://bn.wikipedia.org/wiki/আলিবর্দী_খাঁ )র আমলের এক পুণ্যাহ অনুষ্ঠানের কথা বলছেন যেখানে দেশের নানান অঞ্চল থেকে
কম করে ৪০০ জমিদার এবং অন্যান্য রাজকর্মচারী এসেছেন আর খাজনা দাখিল করছেন। নবাবরা পরেরদিকে খানা আদায় এবং শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার
জন্য বড় জমিদারির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
No comments:
Post a Comment