মিল মালিকদের
তাঁবেদার ভারতসরকারের একচোখামিতে ১৫ বছরে উচ্ছেদ হয়েছেন ২৩ লক্ষ তাঁতির সঙ্গে দেড়
কোটি মানুষ
অথবা
গত ১৪ বছরে ভারতের গ্রামে থেকে জনসংখ্যার ২.৫ শতাংশ শিল্পী-শ্রমিক
হারিয়ে গেলেন
পারম্পরিক তাঁতির
সংখ্যা দ্রুতহারে কমেছে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পাবানাকা লক্ষ্মী, সংসদকে এ তথ্য
জানিয়েছেন। খবর ভারত সরকারের প্রচার দপ্তরের(http://pib.nic.in/newsite/erelease.aspx?relid=70550)। মন্ত্রী বলছেন ১৯৯৫-৯৬
সালে দ্বিতীয় তাঁত শুমারির সময় সারা ভারতে, তাঁত শিল্পী ছিলেন ৬৫.৫০ লক্ষ। তৃতীয়
তাঁত শুমারি(২০০৯-১০)তে সে সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৩.৩১ লক্ষে। অর্থাৎ কমেছে
প্রায় ২২.২১ লক্ষ। দেশের এত পরিমানে তাঁতি ভারতের গর্বিত তাঁতের শিল্পিত ইতিহাস
থেকে হারিয়ে গেলেন, উচ্ছেদ হয়ে গেলেন নিজের বাপ-দাদার সংস্কৃতি থেকে, সে বিষয়ে
বিন্দুমাত্র হাহুতাশ নেই ভারত জনপদে। মন্ত্রিসাহেবা তাঁর বক্তব্য পেশ করে হাত মুছে
ফেললেন। বিরোধী পক্ষ হইচই করলেন কোলগেট নিয়ে, ডলারের তুলনায় টাকার দাম পড়া নিয়ে-
কিন্তু গ্রামের এই যে কয়েক কোটি প্রযুক্তিবিদ স্রেফ হারিয়ে গেলেন গ্রামের শ্রম
মানচিত্র থেকে, সে বিষয়ে রারোর কোনও তাপ উত্তাপ নেই। সব কিছু যেন অতি স্বাভাবিক এক
ঘটমান বর্তমান। কয়েক বছর আগে অন্য কোনও কোথায় উত্তরবঙ্গের এক প্রখ্যাত কংগ্রেস
সাংসদ আলগোছে বলেছিলেন এসব স্বাভাবিকভাবেই উঠে যাবে, শিল্পায়ন দরকার – এদের মুখে
ভাত তুলেদিতে হবে তো। হয়ত কেন্দ্রের, রাজ্যের সরকার এবং বিরোধী পক্ষও একই রকম
উন্নয়ণকর্মে বিশ্বাসী। তাই অস্বাভাবিক উন্নয়নমূলক নিস্তব্ধতা।
অথচ এই
সংখ্যাটি শুধু কয়েক লক্ষ নয় – অনেক অনেক বেশি। উচ্ছেদ হওয়া তাঁতিদের নিজস্ব
পরিবারের প্রায় প্রত্যেক সদস্য তাঁতের সঙ্গে জুড়ে কোনও না কোনও কাজ করেন। তাঁতিদের
পরিবারপিছু ৫ জন সদস্য করে ধরলে প্রায় ১ কোটি গ্রামীণ শ্রমিক গ্রামএর শ্রম শিল্প
পরিসর থেকে মুছে গেলেন। এখানেই শেষ নয়। অন্ততঃ দশ জন প্রযুক্তি কর্মী প্রয়োজন একটি
তাঁত চালাতে। সুতো গোটানো, সুতো রং করা, শাড়ি মাড় দেওয়াসহ আরও হাজারো কাজে জড়িয়ে
থাকেন। এই মানুষগুলোও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন গ্রাম-ভারতের কর্ম ইতিহাস থেকে, দেশের
মানুষকে বিন্দুমাত্র বুঝতেনা দিয়ে, অথচ কারোর মাথব্যথা নেই। কোনও হাহাকার নেই।
২ কোটি ২০
লক্ষেরও বেশি শ্রমিক এই তাঁতিদের সঙ্গে বেকার হলেন। মোট যত শ্রমিক বেকার হলেন
তাঁদের সংখ্যা – ১ কোটি তাঁতি ও তাঁদের পরিবার + তাঁদের সঙ্গে জুড়ে থাকা অন্য ২.২
কোটি শ্রমিক = ৩.২ কোটি। ভয়াবহ এক সংখ্যা। অথচ ভারতে কোনও হেলদোল নেই। কোনও রাজকীয়
রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক জলও ঘোলা হল না- ভারতের জনসংখ্যার ২.৫ শতাংশেরও বেশি শ্রমিক
গ্রামের শ্রম বাজার থেকে হারিয়ে গেলেন। এ বিষয়ে কে কি করেছেন জানি না কিন্তু, বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও
বস্ত্র শিল্পী সঙ্ঘ বা কলাবতী মুদ্রা বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলার দুটি দৈনিক,
বর্তমান এবং অধুনালুপ্ত প্রাত্যহিক খবরে একটি চিঠি এবং একটি প্রবন্ধ লিখে ছেন এবং
বিভিন্ন মিটিং, ডেপুটেসন দেওয়া সহ নানান ভাবে এই তথ্য সামনে আনার চেষ্টা করেছিল।
ভারত সরকারও
স্বাধীনতার পর পর থেকেই, মুখে যাই বলুক, আদতে ব্রিটিশদের দেখানো পথে রাষ্ট্র(দেশ
নয়) উন্নয়নের কাজ করেছে। এবং সেই পথ ধরেই দেশ জুড়ে কোটি কোটি মানুষ(খুব সাদা
হিসেবে অন্ততঃ ১০ কোটি) যে উচ্ছেদ হয়েছেন তাদের মধ্যে সারা ভারতের তাঁতি আর
গ্রামীণ শিল্পী যাদের আমরা হস্ত শিল্পী বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করি, তারাও রয়েছেন।
তাঁদের সংখ্যা জুড়লে এই পরিমাণটা কোথায় দাঁড়াবে জানি না। এখানে শুধু আমরা তাঁতিদের
নিয়েই আলোচনা করব।
১৫ বছর ধরে তিল
তিল করে বললে শোভা পাবে না, বলতে হবে খুব দ্রুত, ভারতের জনসংখ্যার ২.৫ শতাংশ তাঁতি
এবং তাঁতের সঙ্গে জুড়ে থাকা প্রযুক্তিবিদ উচ্ছেদ হয়ে গেলেন। অর্থাৎ, এই পরিমাণ
মানুষ বছরে ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং সমাজ থেকে নীরবে হারিয়ে গিয়ে
শহরে হয় দিনমজুর, নয় হকার, বা রিক্সা চালক, কিম্বা বাড়ি তৈরির শ্রমিক হয়েছেন। অথচ
এরা অনাদি অতীত থেকে বয়ে নিয়ে চলছিলেন ভারতের ঐতিহ্য, দেশে বিকশিত প্রযুক্তি। এদের
হাতের জাদুতে একদা তৈরি হয়েছিল বাংলার বিশ্ব পরিচিতি। এদের এদেরমত শিল্পীদের
নির্ভর করে ব্রিটিশদের আগে পর্যন্ত বাংলার অর্থনীতি ছিল উদবৃত্ত। এই গ্রামীণ শিল্পী-প্রযুক্তিবিদেরা
উচ্ছেদের কোপে পড়ে হারিয়েগেলেন, হয়ত মিশে গেলেন শহর বিকাশের কাজে নিয়োজিত অসংখ্য
পরিচয়হীন মুখের সাথে।
এমন নয় যে
বাংলার গ্রামের নারীরা শাড়ি পড়া ছেড়ে দিয়েছেন। যদিও ধুতি পড়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন
বাংলার ইংরেজি শিক্ষিত পুরুষকুল। আজও বাংলার কোটি কোটি মহিলা বাংলার পারম্পরিক
শিল্পকে কোল দিয়ে চলেছেন, শাড়ী তাদের জীবনের এক বিশিষ্ট অঙ্গ, অংশ। তাহলে ভুলটা
কোথায় হল? এই প্রবন্ধে, ভারত সরকারের বস্ত্র মন্ত্রকের বাজেট বিশ্লেষণ করে আমরা
দেখব, ভারতে কেন এই পরিমাণ তাঁতির সংখ্যা কমল। ভারত সরকার কাকে সুবিধা দিচ্ছেন?
বাজেট বিশ্লেষণ থেকে পরিষ্কার ৪৩ লক্ষ পারম্পরিক তাঁতির জীবন জীবিকা, ভারতের
ঐতিহ্যের বদলে অত্যধিক গুরুত্ব পেয়েছে কলে চলা পশ্চিমী মিল মালিকদের স্বার্থ।
বিগত ১০ বছরে বস্ত্রশিল্প
ক্ষেত্রে সরকারি বরাদ্দ কমেছে লক্ষ্যনীয় ভাবে। যদিও বস্ত্র মন্ত্রকের বাজেট বরাদ্দ
যথেষ্ট পরিমানে বেড়েছে। ১৯৯৭-৯৮ থেকে ২০০৬-৭ পর্যন্ত মন্ত্রকের বাজেট বরাদ্দ
বেড়েছে চার গুণ ৭৩৯.০৪ কোটি টাকা থেকে ৩০৪৫.৭৫ টাকা। মন্ত্রকের বরাদ্দ বাড়ছে অথচ ভারতের বস্ত্র শিল্পীদের বরাদ্দ কমছে,
এ তথ্য ভারতের বাজেট বরাদ্দের তালিকা থেকে তৈরি করা যায়। যদিও সারা বিশ্বের অন্য
দেশের সরকারগুলো ঐতিহ্যমন্ডিত হস্ত বা বস্ত্র শিল্পীদের উৎপাদনের দিকে নজর দিয়ে বাজেটে
অর্থবরাদ্দ বাড়ালেও ভারত সরকার ক্রমাগত সেই বরাদ্দ কমিয়েছে। যদিও ভারতের পরিকল্পনা
কমিশন স্বীকার করছে, কৃষি শ্রমিকের পরেই ভারতের হস্ত ও বস্ত্র শিল্পীদের সংখ্যা।
তবুও ভারতের সরকারি পরিকল্পনায় বিগত নবম এবং দশম পরিকল্পনায় বস্ত্রশিল্পীদের নিয়ে
খুব বেশি সুনিশ্চিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় নি।
আদতে ভারত সরকারের
পরিকল্পনায়, বস্ত্রশিল্পীদের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে কলের বুনন
পরিকল্পনা। গত কয়েকটি পরিকল্পনায় হাতে চালানো তাঁত আর ভারত সরকারের মূল পরিকল্পনা
আর গুরুত্বের মধ্যে নেই। সরকারের পরিকল্পনায় চলে এসেছে কলের বুননের শিল্প। বিগত
কয়েক বছরের বাজেটে হাতে চালানো তাঁতের বাজেট বরাদ্দ বাড়ার বদলে কাপড়ের কলের বরাদ্দ
বেড়েছে অনেক বেশি।
No comments:
Post a Comment