তবে সাহস যুগিয়েছেন বটে জয়া মিত্র। বহুদিন তাঁর
সঙ্গে গ্রামসমাজের নানান উনোঝুনো বিষয় আলোচনা করার স্পর্ধা থেকে নানান প্রশ্ন
জেগেছে, যার প্রত্যক্ষ ফল কিন্তু বক্ষ্যমান বই। তিনি নিজে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাঙলার গ্রামীণ বিষয়গুলি আলোচনা করেছেন, সেই সব
তথ্য বহুবার তাঁর সবুজ পত্রিকা ভূমধ্যসাগরএ উপস্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছেন। হয়ত সেগুলি সরাসরি মধ্যবিত্তের বিশ্বাসঘাতকতা বিষয়ে নয়, কিন্তু
গ্রামসমাজের জোরের যায়গা, মানুষগুলির নিজস্বতার যায়গা, তার দর্শণের মূল ভাবনাগুলি
কিন্তু বারবার উঠে এসেছে তাঁর সঙ্গে আমাদের নানান আলেচনায়, তাঁর পত্রিকায় লেখার
মধ্যে। লেখাগুলি লিখে পরোক্ষে এই বইটি তৈরির
প্রণোদনা পেয়েছি। অমিতযত্নে অকালপক্ক এই দলের নানান
লেখার নানান ভুল ত্রুটি নিজের হাতে সংশোধন করেছেন(শাঁখ আর শাঁখা নিয়ে এক লেখায়
লিখেছিলাম শাঁখা ভাঙা, তিনি শুধরে বলেছিলেন শাঁখা ভাঙা নয়, গ্রামে কমে যাওয়াকে বলে
বাড়ন্ত হওয়া। এ শব্দবন্ধটি আমরা জানতাম না তা নয়,
কিন্তু সঠিক প্রয়োগের পথ দেখেয়ে দেওয়ার ভালবাসা থেকে বহু মুহূর্তে খুলে যেত
গ্রামীণ দর্শণের ভাবনার নানান দিকগুলি)।
আমরা তাঁর কাছে সযত্নে পাঠ নিয়েছি গ্রামীণ সৌজন্যবোধের নানান বিষয়ে। এতদিন যে বিষয়গুলিকে শহুরে ভাবনায় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হয়েছে তাকেও যে এত
মমত্ববোধে লেখার কালো অক্ষরে, দুই মলাটের মধ্যে ঠাঁই দেওয়া যায়, এগুলিও যে লোখার
বিষয়বস্তু হতে পারে, ছাপা যেতে পারে, তা তাঁর সঙ্গে আলাপ হওয়ার আগে আমরা ধারণাই
করতে পারিনি। সময়ে অসময়ে আলোচনায় নানান বিষয়ের
আলপটকা নানান তত্ব তাঁর সামনে তুলে ধরার এবং তা নিয়ে নানান সুখাদ্য-সুপানীয় লেপচু
লাল চা সহযোগে কলকাতায় তাঁর নানান ব্যস্ততার মধ্যেই সহাস্য আলোচনার প্রশ্রয়
দিয়েছেন তিনি। ছুটে গিয়েছি তাঁর ভদ্রাসন আসানসোলে। অনেকবার আমাদের পথ দেখিয়েছেন। অসম্ভব গ্রাম্য
সৌজন্যে নানান প্রশ্ন জানতে চেয়েছেন। আমরা
স্বাভাবিকভাবেই আমতা আমতা করলে তিনি প্রায়পালভেঙেপড়া আলোচনার নৌকোকে পাড়ে নিয়ে
যাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন নিজ উদ্যমেই পাদপূরণ করে। একজনবাদে আমাদের দলের কেউ সেই অর্থে খুব একটা উচ্চশিক্ষিত নই, গবেষণা কাজে
বিন্দুমাত্রও দড় নই। বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডী
ছুঁয়ে-নাছুঁয়েই অনেকেরই বিধিবদ্ধ শিক্ষায় দাঁড়ি পড়েছে। অনেকে আবার ততদূরেও যেতে পারে নি। পশ্চিমের তৈরি
একমুখীন বাঙলা শিক্ষাদান কাঠামোর নানান আশ্চর্ষজনক কান্ড, শিক্ষাক্ষেত্রের বাইরের
মানুষ হিসেবে খুব শুনেছি। জয়া মিত্রর কাছে যে শিক্ষা পেয়েছি,
তা আদতে উভমুখী। আমরা অনেকেই আশ্চর্য হয়ে যেতাম, যখন
তিনি আমাদের কাছ থেকে নানান গ্রামীণ প্রকরণ জানতে চাইতেন। কলকাতার জ্ঞাণী মহলে আমাদের যতকমটুকু অভিজ্ঞতা, তাতে দেখেছি প্রায়
প্রত্যেক প্রখ্যাত বক্তার সামনে আমরা নির্বাক শ্রেতা মাত্র। জয়া মিত্র উজ্জ্বল ব্যতিক্রম, আমাদের দৃষ্টিতে তিনি কলকাত্তাই জ্ঞাণ
সমাজের মানুষ নন। গ্রামীণ উভমুখী দর্শণের চলতা ফিরতা
উদাহরণ তিনি। প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথা
বলে, আলোচনা করে তাঁদের নানান তত্ব আঁজলা করে ভরে নিতে হয়, এমন ধারণা আমাদের
হেঁটমুন্ডউর্ধপদ হয়েছে তাঁর সঙ্গ করে। আনেকসময় তাঁর
সঙ্গে কথা বলে মনেকরতাম গ্রামীণ সংস্কৃতি দর্শণের অনেক কিছু আমরা জানি। কিন্তু পরে দেখেছি, আমরা যা বলেছি, লিখেছি তার অনেককিছুর নীরব স্রষ্টা
তিনি, কোনও দিন তিনি সে কথা আমাদের মনে করতে দেন নি। তাঁর কথা, অনুবাদকর্ম থেকেই জেনেছি অনুপম মিশ্রজীর কাজ, তিনি আমাদের কাছে
জেনেছেন ধরমপালজীর লেখা। আমাদের দেখা একমাত্র প্রখ্যাত
ব্যক্তিত্ব, যিনি বলেন, তিনি যা কিছু বলছেন, লিখছেন, প্রায় সব কিছু শিখেছেন
গ্রামীণদের কাছ থেকে।
স্বাধীণতার পূর্ববর্তী সময়কার বাঙলার প্রায় সব কজন প্রাতঃস্মরণীয়
ব্যক্তিত্বের কর্মপ্রণোদনার প্রতি প্রশ্ন তোলার যোগ্যতা নিয়ে আমরা খুবই অস্বস্তিতে
ছিলাম। অপ্রাতিষ্ঠানিক এই কাজটি আমরা আদৌ
প্রকাশ করতে পারব কী না সে বিষয়ে আমাদের নিজেদের দলের মধ্যেই যথেষ্ট সংশয় ছিল। সে সময় তিনি আমাদের বয়সে নেমে এসে আমাদেরমত করে নানান বিষয় বিশদে আলোচনা
করেছেন, নানান তথ্য জানতে চেয়েছেন, কোনও তথ্য তাঁর না জানা থাকলে তিনি অবাক
বিষ্ময়ে সেই তথ্য নিয়ে আলোচনা করেছেন দিনের পর দিন। আমাদের অভয়, প্রশ্রয় এবং আশ্রয় দিয়েছেন নানান ভাবে। বিশেষ করে ভারত এবং কার্ল মার্ক্স-এর সম্বন্ধ নিয়ে গোটা একটা অধ্যায় রচনার
পরিকল্পনা আমাদের বহুদিনের। কিন্তু বাঙলা
ভাষায়, বাঙলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সে কাজটি কতটুকু করা সম্ভব, তা নিয়ে আমরা
যথেষ্টই সন্দিহান ছিলাম। কাজটি করারপর তাঁকে যখন আমরা নমুনা
দেখাতে গিয়েছি, বিশদে আলোচনা করেছি। তিনি সেই
কাজকে অসম্ভব সমর্থন করেছেন। আমরা সাহস
পেয়েছি।
আমরা বাঙলার গ্রাম দর্শণ বহুকাল ধরে নিজেদেরমতকরে চিনতে
জানতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু এ কাজে
প্রয়োজন ছিল সর্বভারতীয় গ্রামীণ প্রেক্ষাপট এবং তার দর্শণেরভাব গ্রহণ করা। বাঙলার গ্রামগুলির যে দর্শন ভিত্তিকরে গড়ে উঠেছে, সেই
দর্শনেই কী ভারতের অন্যান্য গ্রামীণ সমাজ জারিত, এই প্রশ্নটি আমাদের দলের মধ্যে
বার বার উঠত। এই উত্তর আমরা খুব
একটা বাঙলায় বসে পাইনি, যতদিন না আমরা জয়া মিত্রর দেখা পেয়েছি। তিনি অসম্ভব ধৈর্যে আমাদের নানান প্রশ্নের উত্তর দেওয়া
শুধুই নয়, ভারতের নানান প্রান্তের গ্রামের মানুষের দর্শণে জরিত হয়ে নিজের নানান
অভিজ্ঞতা আমাদের বর্ণনা করেছেন কেনোরকম দ্বিধা না রেখেই। ভারতীয় গ্রামীণদের জ্ঞাণ, প্রযুক্তি, জীবনধারণ পদ্ধতি
নিয়ে আমাদের নানান ধারণায় ধার দিয়ে আরও চকচকে করেছেন। এটুকু কথা আমরা বলতে চাই জয়া মিত্র সঙ্গে আলাপ না হলে
হয়ত এই বইটি লেখা বন্ধ হত না, কিন্তু যে গ্রামীণ দর্শণের ব্যখ্যা আমরা করেছি এই বইতে,
যে জীবনপ্রবাহের কথা এখানে বলতে চেষ্টা করেছি, সেই লেখার সুতিকাগার কিন্তু জয়া
মিত্রের সঙ্গে আলোচনার পরিবেশ থেকেই সূচনা হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে দেখা নাহলে গ্রামীণ দর্শনের সর্বভারতীয়
প্রেক্ষিতটিই হয়ত অধরা থেকে যেত। এর সঙ্গে আরও একজন একজন করে মানুষের অংশগ্রহণে এই বইটি
বিতর্কিত হয়ে উঠেছে যেমন, তেমনি কিন্তু আমারা যারা এই বইএর পেছনে কাজ করেছি
নিয়মিত, তাদের মনোমত হয়ে উঠেছে।
No comments:
Post a Comment