স্বাধীনতার পর
থেকে ভারত সরকার বড় শিল্প বানাতে তার সমস্ত উদ্যম নিয়োজিত করল। যদিও প্রথম পরিকল্পনায় কৃষিতে সরকারের বড় নজর ছিল। মহলানবিশ-নেহরু
প্রনীত অর্থনীতির অগ্রগতিতে, বিগত ৬৫ বছরে ন্যুনতম ১০ কোটি আদিবাসী এবং গ্রামীণ শ্রমিক, কারিগর নিজের জমি, কাজ, শ্রম থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন। সরকারি-বেসরকারি উদ্যমের ঘাড়ে চেপে দখল
হয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ। দখল হয়েছে স্থানীয় বাজার। ভারতের স্বাধীন সরকার গায়ের জোরে, বসতির পর বসতি
উচ্ছেদ করে, জঙ্গল দখল করে, পুলিস মিলিটারি দিয়ে নিজের দেশের কারিগরি, শিল্পকে ধংস
করে বড় পুঁজিকে যায়গা করে দিল। বৃটিশদের প্রবল অত্যাচার সয়ে গ্রামের ছোট উদ্যম যতটুকু বেঁচে ছিল,
স্বাধীনতার পরে, সরকারি বিকাশ নীতিতে তা শেষ হয়ে যাওয়ার মুখে।
সরকার এখন দয়া পরবশ হয়ে, গ্রামীণ কারু আর বস্ত্র শিল্পীদের
সাহায্যের খুদকুঁড়ো দিচ্ছেন। কিন্তু আগামীদিনের আরও দুর্দশা থেকে বাঁচাবার উদ্যম নেই। ১৯৯৫-২০১০ এই পনের বছরে ভারতজুড়ে ২২ লক্ষেরও বেশি তাঁতি তাদের সাবেকি
কাজ ছেড়েছেন। পরিবার ধরলে প্রায় ১ কোটি মানুষ। একটি তাঁতের সঙ্গে সরাসরি অন্তত ১০ জন প্রযুক্তিবিদ জুড়ে থাকেন। এই ২২ কোটি কাজ হারানোয় আরও আড়াই কোটি কারিগর বেকার হলেন। মোট চার কোটির কাছাকাছি মানুষ তাদের কাজ থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন - এটি সরকারি হিসেব, শুধু তাঁতেই। ১৯৮৪র রাজীব গান্ধির নয়া তন্তু নীতির পর পরই ভারতে যতটুকু দেশের প্রযুক্তি টিকেছিল, উচ্ছেদ করে, সরাসরি বিদেশি
প্রযুক্তির হাতে দেশের প্রযুক্তির বাজারকে পুরোপুরি তুলে দেওয়া হল। ভারতের দেশিয়
প্রযুক্তি ধংস করে বিদেশি প্রযুক্তি ডেকে আনার তাত্বিক বিষয়ে বিশদে আলোচনার জন্য http://lokfolk.blogspot.in/search/label/%E0%A6%AB%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%BE পোস্টটি দেখতে পারেন।
রাজীবের কাছা খোলা দর্শনটিকে আরও গভীর, দার্শনিক, বাস্তবিক রূপ দিল নয়ের দশকে নরসিংহ-মনমোহন
সরকার। একদিকে দেশের সব কিছু ছেড়ে, বিদেশি উদ্যমে আস্থা পোষণ এবং অন্যদিকে আমেরিকার নির্দেশ মেনে সামাজিক নানানকাজ থেকে সরকার নিজের বিনিয়োগ এবং নিয়ন্ত্রণ আলগা
করার সময়ের শুরু। এর বিপরীতে বড় পুঁজিকে যথা সম্ভব সাহায্যের সক্রিয় আশ্বাস। কিছুটা ইয়োরোপ আর পুরোটা আমেরিকা বুকে
পুষে ভারতের মধ্যউচ্চবিত্ত বেলাগাম শহরীকরন আর ভোগবাদপন্থায় বিশ্বাস রাখল। সরকারি স্বাস্থ্য, জনশিক্ষাসহ
নানান সামাজিক উদ্যমে সরকারি বিনিয়োগ ক্রমশঃ কমতে শুরু করল। সরকারি-বেসরকারি
গাঁটছড়া উদ্যমের নামে সরকার নানান প্রকল্পে নিজেদের বিযুক্ত করতে শুরু করল। লাভ বড় পুঁজির বিনিয়োগকারীদের সিন্দুকে ঢুকত। ক্ষতি দায় সরকারের অর্থাৎ জনগণের।
সামাজিক দায়িত্ব
ভুলে বড় পুঁজির প্রভাবে ন্যুনতম শাসনের দর্শন ক্রমশঃ থানা গাড়ল। নয়ের দশকের আগের সরকারগুলি ঘোমটা
পরে বড় পুঁজির দাসত্ব করেছে। কিন্তু বাঁ হাতে হলেও কিছুটা সম্পদ সামাজিক খাতে ব্যয় করতে হত। নরসিংহ রাও সরকারের পর থেকে প্রায় সব ভারত সরকারই চক্ষুলজ্জাহীনভাবে
বড় পুঁজির তরফদারি করা শুরু করল। বড় পুঁজি নানান আর্থিক সাহায্য এবং কর ছাড় পেল। বিপদে পড়লে এদের উদ্ধারে
সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এল সরকার। সরকার আর বড় পুঁজি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের সাথে হাত মিলিয়ে এমন এক
পরিবেশ তৈরি করার কাজ শুরু হল, যাতে দেশের মধ্যবিত্তের মনে হয় (যাদের একাংশ সরকারি-বেসরকারি আমলাতন্ত্র। এদের উদ্যোগে বিশ্ব বড় পুঁজি, ভারতের অধরা বাজার ধরার কাজ
করতে শুরু করেছে। সরকারি স্তরেও বলা হচ্ছে অত্যধিক মুনাফা করা দারশনিকভাবে খুব
খারাপ কাজ নয়। বরং কয়লা, তেল, ব্যাঙ্ক ইত্যাদির জাতীয় করণ করার চেষ্টাটাই পিছিয়ে
পড়া চিন্তা) বড় পুঁজি আর বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া ভারত বিকাশের গতি নেই। কর্পোরেট
জগতের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার সওয়াল একের পর এক বাস্তবায়িত হওয়া
শুরু হয় আমলাদের উদ্যমে। রাজনৈতিক ঐক্যমত্য তৈরি করা হয়। বড় পুঁজির সেবাদাস মধ্যবিত্তরা মুক্ত কচ্ছ হয়ে বড়
পুঁজির পদ লেহন শুরু করে।
বিশ্বে এ
ধরণের ঘটনাক্রম খুব নতুন অভিজ্ঞতা নয়। ভারত এই খেলায় নতুন। এশিয়া, ইয়োরোপ আমেরিকা,
লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলিতে ঠিক যেমনভাবে উন্নয়ন ঘটেছিল সেই
পথ ধরল ভারত সরকার। কেননা বড় ব্যবসা, বড় পুঁজি সরকারি সাহায্য ছাড়া বাড়তে পারে না। এটি ঐতিহাসিক সত্য। ভারতের উচ্চমধ্যবিত্ত সেই ভাঙ্গা পথে চলতে চাইছে। আমরা দেখেছি,
এই কর্পোরেট নীতিতে দেশ চালাতে গিয়ে একের পর এক দেশ মুখ থুবড়ে পড়েছে। জার্মানি
থেকে গ্রিস থেকে ব্রাজিল থেকে ইন্দোনেশিয়া সকলেই আজ নতুন ভোরের অপেক্ষায়। বড়
পুঁজির চাপ রয়েছে। কিন্তু পুরনো পথ ছাড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। উচ্চমধ্যবিত্ত ভারত
আজ দাঁড়িয়ে সেই ফেলে আসা ভাঙ্গাচোরা পথে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখছে।
No comments:
Post a Comment