হেস্টিংসের দুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জেনারেল
ক্লেভারিং আর ফিলিপ ফ্রান্সিস বিলেত থেকে এলেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নিদান দিতে। প্রথম
সুযোগেই হেস্টিংসের দুই লুঠেরা হাত, কান্তবাবু আর গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের বড়লোকিতে
কাতর মহারাজা নবকৃষ্ণ, সাহেবদের সামনে ঠুকে দিলেন এক পত্র বোমা। এই চিঠির ছত্রে
ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে, ব্রিটিশ প্রভু হেস্টিংস এবং বাংলা সুবার জমিদার, তালুকদার,
বড়ও চাষী সাঙ্গপাঙ্গদের ডান হাতে, বাঁ হাতে, চোখের চামড়া না ফেলে ঘুষ নেওয়ার
অসামান্য দক্ষতার বর্ণনা। লেখা হয়েছে নজর(উপহার), দামী মনিমুক্তো, অলঙ্কার,
পরিধেয়র সঙ্গে নানান আনুষঙ্গিক দ্রব্য ছাড়াও দেওয়া হয়েছে অজস্র অর্থ। চিঠিতে লেখা
অর্থের পরিমানে চোখ কপাল ছাড়িয়ে চাঁদিতে ওঠার উপক্রম। এরও প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে,
১৮২০র মাগ্যি-গণ্ডার কলকাতায় ২ টাকা রোজগার করে ঠাকুরদাস মেদিনীপুরে মাকে টাকা
পাঠাবার মত সচ্ছল হয়ে উঠেছিলেন। চিঠিতে লেখা হচ্ছে An account of the money
received by Governor Hastings and other gentlemen from the Zaminders,
Talookdars and Farmers of the subah of Bengal from his accession to the
government till the arrival of the General(Clavering) and other gentlemen;
exclusive of Nuzzers(presents), pearls, Jewels, Cloths and complementary
presents…
Dacca Rs.
Ready money 5,00,000
Mr.Barwell 4,00,000
Rungpore etc
Ready money 1,00,000
Promisery 1,00,000
Moorshidabad-Exclusive of Mr।Middleton 3,00,000
Dinagepore 2,00,000
Boglepore 2,00,000
Beerbhum, Bishnupur etc., 1,50,000
Midnapore
Mr.Vansitart
and other Gentlemen 3,50,000
Raja Kissenchand 1,50,000
Burdwan-Exclusive of Mr. Chas
Stewart
Through Diwan Brojkishore 2,00,000
Phoolbundy 1,50,000
Mundalghat salt contract 1,50,000
Hooghly, Hijli etc.
Ready Money 1,00,000
Settlement for salt 6,00,000
Jessore etc.,
On account of sault of Raymangal etc., 2,00,000
Farmers of 24 praganas 0,50,000
From Raja Huzuri Mul and Madan Duttfor relinquishing
the farm of
Poornea 1,00,000
Profit of Butta, premium of bills from Raja Huzuri Mal
& Doyalchand 1,50,000
From servants wages 1,00,000
Total 42,00,000
Governor Hastings received from Nawab Shuja-ud-Daula
& others without participation as follows –
From Nawab Mubarak-ud-Daula through
Munny Begam
Munny Begam 2,00,000
From the sets 50,000
Raja Rajbullav 1,00,000
From the Zamindari of Rani Bhowani 1,25,000
From the Zamindari of Rani Bhowani 1,25,000
From Nawab Shuja-ud-Daula in cash 5,00,000
Promisory 5,00,000
From the raja of Benaras in cash 2,00,000
Promisory 1,00,000
17,75,000
Mr। George Vansittart without participation –
From Shuja-ud-Daula 2,00,000
From the raja of Benaras 1,00,000
62,75,000
(সূত্রঃ রজতকান্ত রায়, পালাশির ষড়যন্ত্র ও
সেকালের সমাজ)
মীর কাসীম পুস্তকে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় বিচারের
হিসেব তুলে বলছেন পলাশির পর কোন কোন আমলা কীভাবে পুরস্কৃত হলেন
Mr. Drake 280,000 280,000
Col. Clive
As
a member 280,000
As
a commander 200,000
As
a donation 1600,000 2080,000
Mr. Watts
As
a member 240,000
As
a donation 800,000 1040,000
Major Kil Patrik
As
a member 240,000
As
a donation 300,000 540,000
Mr. Manningham 240,000 240,000
Mr.
Beecher 240,000 240,000
Six members of council 1 Lakh each 600,000
Mr. Walsh 500,000
Mr. Scraftom 200,000
Mr. Lushington 500,000
Cap. Grant 100,000
Army & Navy 600,000
ঐ পুস্তকেই বলা
হচ্ছে, ১৭৬০ খৃষ্টাব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বর কলিকাতায় এই ইতিহাস-বিখ্যাত
গুপ্ত-দরবারে অধিবেশন হয়. তাহাতে ভ্যান্সিস্টার্ট সভাপতি এবং কর্ণেল কেলড, সমনার,
হলওয়েল এবং ম্যাগুয়ার সদস্য স্বরূপ উপস্থিত ছিলেন. ...এই গুপ্তসন্দর্শন শেষ হইলে
... মীর কাসিমের পক্ষাবলম্বন করাই স্থির হইল। কৃতজ্ঞ মীর কাসিম সকলকেই যথাযোগ্য
পুরস্কার বিতরণে সম্মত হইয়া ছিলেন,
Resolution in favour of Cassim
1760(in pound)
Mr. Summer 28000
Mr. Hallwell 30000
Mr. M’c Guire 20635
Mr. Smirh 15354
Major York do
Gen. Caillaud 22916
Mr. Vansistart 58333
ওপরের তালিকাটি পলাশি উত্তর কয়েক দশকের মধ্যে বাঙলার
একটিমাত্র প্রান্তে দেওয়া ঘুষের অংকটি বাঙলা সুবা থেকে ইংরেজদের ওপর মহলের ঘুষ
আদায়ের গা ছমছমে উপন্যাস না হলেও নভেলাতো বটেই। এই
লুঠ(কু)কর্মটি পরবর্তী দেড় শতাব্দকালে ক্রমশঃ ক্রমশঃ আকাশ ছোঁবে। কত সম্পদ
ইংলন্ডে ঘুষ বাবদ গিয়েছে যদিও তা হিসাব করা অসম্ভব, তবুও এই পরিমান আঁকতে পারলে
সভ্যতার রঙিন মুখোশপরা ইংরেজদের সরাসরি নগ্ন করে দাঁড় করয়ে দিতেপারে খোলা বাজারে।
ঐতিহাসিকদের সাফাই, উচ্চপদস্থ আমলারা মাঝের অথবা নিচের তলার কর্মচারীদেরমত সরাসরি
ঘুষের টাকাটা নিতেন না। তাঁরা ক্লাইভ, হেস্টিংস, পিটদের ঘুষের রোজগার দেখতে
পাননি। রাণী ভবানী শুধু হেস্টিংসকে সরাসরি দিয়েছেন সে যুগের
১,২৫,০০০ টাকা ঘুষ, মির জাফরের বিধবা মুন্নি বেগম ক্লাইভকে দিয়েছে সে যুগে ৫ লক্ষ
টাকা।
এ চোখে দেখা হাতে লেখা হতিহাস। এর বাইরে! যদি চোখ বুজেই ধরেই নেওয়া
যায় যে, প্রাগুক্ত প্রবক্তাদের কথাই বেদবাক্য, তাহলে বামহস্তক্রিয়ার শেকড় চারিয়ে
যায় অনেক নিচ পর্যন্ত। এঁদের দাবি অনুযায়ী যারা মহামহিম কোম্পানির বড় আমলাদের
জন্য হাতে হাতে অর্থ নেওয়ার বামহস্তক্রিয়ায় জড়িয়ে থাকতেন, সেই মাঝারিতলার না
দেখতে পাওয়া মুখেদের, বাম হাতের রোজগার বড় কম ছিল না বোধহয়। বড়,
মাঝারি আর ছোট রুইকাতলাদের সঙ্গে পুঁটিমাছেদের সরকারি-বেসরকারি ঘুষ প্রাপ্তিযোগ
জুড়লে লুঠের বখরার টাকা আজকের অর্থেরমানে আকাশ ছাড়িয়ে যাবার আশংকা থাকে।
বাঙলা সুবা জুড়ে তখন ঘুষের আর লুঠের রাজত্ব। সূর্যাস্ত
আইনে জমিদারি বাঁচাতে রাণী ভবানী হেস্টিংসকে ১,২৫,০০০টাকা ঘুষ দিয়েও পার পেলেন না। সদাশয় পালক
ইংরেজ বাহাদুরকে বাংলা জানালেন ১১৭৯ আর ১১৮০তে নিজের জমিদারি ইজারা নিতে সেলামি
দিতে হয়েছে ৪,৪০,০০১ টাকা মাত্র। মুরলী পোদ্দার, সদানন্দ পোদ্দার আর
হটু বিশ্বাসের হাত দিয়ে হেস্টিংসের দেওয়ান কান্তবাবু সরাসরি নিয়েছেন ১,২৫,০০০টাকা। যুগল উকিল,
রূপ পোদ্দার আর মুরলী পোদ্দারের হাত দিয়ে আর প্রায় মরতে বসা জগতশেঠের কুঠির
মাধ্যমে শান্তিরাম সিংহ(ইনিই কী কালিপ্রসন্ন সিংহর পিতা এবং জোড়াসাঁকো সিংহ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা?) ২ লক্ষ টাকা রোজগার করেছেন। এর মধ্যে
এক লক্ষ টাকা রাজবাড়ি আর শেঠভবনে গয়নাগাটি বেচে জোগাড় করতে হয়েছে। এ ছাড়াও যে
তৃতীয় ব্যক্তিটি প্রণামী পেয়েছেন তার নাম ভবানী মিত্র। নয়ান
পোদ্দার, মুরলী পোদ্দার, রামকৃষ্ণ পোদ্দার, অখিল পোদ্দার, সদানন্দ, আনন্দরাম উকিল,
পরীক্ষিত মোরারের হাতে হাতে এবং আনন্দরাম উকিলের মধ্যস্থতায় মোতিচাঁদ শেঠের পাট ও
দর্পনারায়ণ(ঠাকুর!) উকিলের মাধ্যমে পরগণা নুরুল্লাপুরের উপর ঢাকায় প্রদেয় পাট
মার্ফত মোট ৩,৭৫,৪৫২ টাকা পেয়েছেন। এতসব ঘুষঘাস দিয়েও শেষ পর্যন্ত
রাণীর হারবন্দ পরগণা হেস্টিংসের বেনিয়ান কান্তবাবুর পুত্র লোকনাথ নন্দীর গ্রাসে
পতিত হয়। কান্তবাবুর স্বজাতি দেওয়ান দয়ারাম রায়ও রাণীকে
বন্ধকীমহলের ওপর ধার দিয়ে জমিদারির একঅংশ দখল করে নাটোরের পাশে দীঘাপাতিয়া জমিদার
রাজ সৃষ্টি করলেন(রানী ভবানী, যিনি সরাসরি না হলেও সিরাজ হত্যা এবং পলাশীর ষড়যন্ত্রের অন্যতম অংশী, প্রায়শ্চিত্ত করলেন নিজেকে নিঃস্ব করে আর ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে নিজের জমিদারির সব উজাড় করে দিয়ে, ব্রিটিশ গণহত্যার মুখে পড়া বাংলার মানুষকে খাইয়ে) )। ১৭৮১তে উত্তর স্বরূপপুর নামক বিরাট পরগণা কলকাতার
বেনিয়ান দর্পনারায়ণ ঠাকুরকে বেচে দেওয়া হয়। সমগ্র বাঙলার শ্রদ্ধা অর্জণকরা
নাটোরের রাণী ভবানীরমত বাঙলা সুবাতে একডাকে চেনা এক জমিদারিতেই ইংরেজরা যদি এই
ঘুষের রাজত্বের লুঠতরাজ চালাতে পারে, তাহলে বাঙলা থেকে শুধুমাত্র কত ঘুষের টাকা
ব্রিটেনে গিয়েছে তা আদপেই অংক কষার বাইরে।
ভারত থেকে রপ্তানি হওয়া, আরও গভীরভাবে বললে,
বাঙলা সুবা থেকে বছরে বছরে লুঠ হয়ে যাওয়া অর্থে আর প্রযুক্তিতেই ব্রিটেনের
মানুষমারা, পৃথিবী ধংসকারী শিল্পবিপ্লবের ভিত গড়ে ওঠে। এর সঙ্গে
ঢাকের বাঁয়া হিসেবে যোগদেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের দাস ব্যবসা ভিত্তিক চিনি(আখ)র ব্যবসা
আর আফ্রিকা থেকে লুঠ করে আনা দাস ব্যবসার উদ্বৃত্ত। ইংলন্ডের
মূলধন নানান ইওরোপিয় দেশে বিনিয়োগ হত। ১৮১৫ থেকে ১৮৩০ পর্যন্ত ইওরোপিয়
রাষ্ট্রগুলির সরকারি সিকিউরিটিতে প্রায় ৫ কোটি ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং মূলধন
নিযুক্ত হয়। লাতিন আমেরিকায় ২ কোটি পাউন্ড আর আমেরিকায় প্রায় ১ কোটি
পাউন্ড নিবেশিত হয়। এইসব উদ্বৃত্ত জমা হয়ে ইংলন্ডের শিল্পজাত দ্রব্যের
বিকাশ হতে থাকে বছরের পর বছর।
এ প্রসঙ্গে ১৯১৩কে ভিত্তিবর্ষ ধরে ব্রিটেনের ঐ
সময়ের জিডিপির ইতিবৃত্ত – ১৭২০-২১ –
২.১, ১৭৬০-৬১ – ২.৬, ১৭৭০-৭১ –
৩.৩, ১৭৮০-৮১ – ৩.৫, ১৭৯০-৯১ –
৪.৬, ১৮০০-০১ – ৫.৭, ১৮১০-১১ –
৭.১, ১৮২০-২১ – ৯.৭, ১৮৩০-৩১ –
১৮.৩, ১৮৪০-৪১ – ১৯.৬। লক্ষ্য
করার বিষয় ১৮০০র পর থেকে ব্রিটেনের জিডিপি ৫ ছাড়িয়ে উর্ধমুখী। ১৮৩০এর পর
লাফিয়ে লাফিয়ে দুই অংক ছাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে কুড়ির ঘরে প্রবেশ করেছে। তবুও
মার্শাল আর আর তার পূর্বসূরীদের পথ বেয়ে বলতেই হবে বাঙলা লুঠের অর্থে ইংরেজদের
শিল্পবিপ্লবসাধন একটি অতিকথামাত্র, এর মধ্যে বিন্দুমাত্র সত্যতা নেই বললেই চলে। এর
পাশাপাশি বাঙলা থেকে শিল্পজাত পণ্যদ্রব্য ও কাঁচামাল আমদানি রপ্তানির হিসেবটুকু
দেওয়া যাক –
১৮৭০ ১৮৯২ ১৯০৭
শিল্পজাত
পণ্যদ্রব্য
টাকার হিসাব
আমদানি ২৫৯,৮৬৫,৮৭২ ৩৬২,২৩১,৮২৭ ৬৯৮,৮৯৫,০০০
রপ্তানি ৫২,৭৮০,৩৪০ ১৬৪,২৪৭,৫৬৬ ৩৯২,৯৮১,০০০
কাঁচামাল
টাকার হিসাব
আমদানি ১৩৭,৫৫৫,৮৩৭ ২৬৩,৮১৮,৪৩১ ৫৯৯,৬৬৮,৩৭৪
রপ্তানি ৫৯৬,৭২৭,৯৯১ ৮৫৫,২০৯,৪৯৯ ১,১৪১,২৩১,৩৩৫
No comments:
Post a Comment