সৈদাবাদে জগৈই ও ছিদাম নামে দুই সহোদর ছিল.
...ইহারা নিতান্তই গরীব ছিল...ছিদাম খেতের আলুপটল ইত্যাদি তরকারি বাজারে বিক্রয়
করিত...কিছুকালপরে সে ইংরাজদিগের রেশমের কুঠিতে দালালি আরম্ভ করিল।
ইংরাজদিগের কাশিমবাজারের রেশমের কুঠির এ্যাসিস্টান্ট ওয়ারেন হেস্টিংস ছিদামকে
বিশেষ কার্যদক্ষ মনে করিয়া তাহাকে রেশমের কুঠির প্যাদার কার্যে নিযুক্ত
করিল....ছিদাম রেশমের কুঠির প্যাদার কার্যে নিযুক্ত হইয়া অত্যল্পকাল মধ্যেই
হেস্টিংস সাহেবের প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিল।
এই সময়ের রেশমের কুঠির প্যাদাদিগেরও বিলক্ষণ দশ টাকা আয় হইত।
....ছিদামের বিবাহের সাতআট বত্সর পরে মেস্তর উইলিয়ম বোল্টস সাহেব কাশিমবাজারের
ফ্যাক্টরের(কুঠির প্রধাণ অধ্যক্ষের) কার্যে নিযুক্ত হইয়া আসিলেন। ইনি
বাঙালিদিগের রক্ত শোষণ করিয়া কয়েক বত্সরে প্রায় বিরানব্বই লক্ষ টাকা উপার্জন
করিয়া ছিলেন। পরে আবার কলিকাতাস্থ মেয়রের কোর্টের জজের পদেও নিযুক্ত
হইয়াছিলেন। ছিদামের কর্ম তত্পরতা দেখিয়া উইলিয়ম বোল্টস সাহেব বড়
সম্তুষ্ট হইলেন। তিনি মনে মনে স্থির করিলেন যে, ছিদামকে রেশমের কুঠির
দেওয়ানের পদে নিযুক্ত করিবেন। কিন্তু শেষে আবার কী মনেকরিয়া ইস্ট
ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যের দেওয়ানের পদে নিযুক্ত করিয়া নিজের যে বাণিজ্য ছিল,
সেই বাণিজ্যের দেওয়ানের পদে ছিদামকে নিযুক্ত করিলেন
....রেশমের কুঠির গোমস্তাদিগের মধ্যে ছিদামের ন্যায়
কার্যদক্ষ লোক অতি অল্পই ছিল। ছিদাম কোনপ্রকার কুকার্য কোনপ্রকার
নৃশংস আচরণ করিতেই কুণ্ঠিত হইত না। সুতরাং ছিদাম বোল্টস সাহেবের
নিজের বাণিজ্যের গোমস্তাগিরি কার্যে নিযুক্ত হইলেও ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির
বাণিজ্যেরও অনেক কাজকর্ম তাহাকে দেখিতে হইত।
অনেক বিষয়েই তাহার উপদেশ ও পরামর্শের আবশ্যক হইত।
বোল্টস সাহেব বলিতেন ছিদাম আমার দক্ষিণ হস্ত।
ছিদাম একপ্রকার বোল্টস সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারী বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।
যত অর্থ লোলুপ স্বার্থপরায়ণ ইংরাজ তখন এদেশে বাণিজ্য করিতেন তাঁহারা ছিদামের
প্রশংসা করিতেন। ছিদাম গোমস্তাগিরি পদে নিযুক্ত হইলে পর চৌদ্দ মাসের
মধ্যে প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা উপার্জন করিল।
ছিদামের সহায়তাপ্রাপ্তি নিবন্ধন বোল্টস সাহেব শুদ্ধ কেবল তাহার নিজের বাণিজ্য
দ্বারা অত্যল্প কাল মধ্যে নয় লক্ষ টাকা উপার্জন করিলেন।
ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যেও বিলক্ষণ লাভ হইতে লাগিল।
বোল্টস সাহেবের সময়েই মুর্শিদাবাদ হইতে অনেক তন্তুবায় স্বীয়-স্বীয় ঘর বাড়ি
পরিত্যাগপূর্বক স্থানান্তরে পলায়ন করিয়াছিল।(চণ্ডীচরণ
সেন, নন্দকুমার ও শতবত্সর পূর্বের বঙ্গ সমাজ)
বাঙলা-বিহারের
এক লাখ টোল-চতু্ষ্পাঠি, ন্যায় অথবা স্মৃতি শাস্ত্র, বাঙলার সর্বজনের স্বাধীণ
বিদ্যাশিক্ষার পরিকাঠামো, বিশ্ববিদ্যালয়সম শিক্ষা ব্যবস্থা ধংস করে নব্য বাঙালিরা
ব্রিটিশ সমাজ-শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা বলে আত্মীকরণ করছেন কোটি
কোটি গ্রামীণদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, যার মূল্যায়ণ আজও হয় নি। এরা কোথাও
আবার ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে মিলে স্বাধীণতা সংগ্রামী গ্রামসমাজকে দমনও করছেন।
প্রত্যেকদিন, প্রত্যেকটি ঘন্টায়, প্রত্যেক মুহূর্তে নিজেদের দেশ, নিজেদের সমাজ,
নিজেদের ঐতিহ্যের, নিজেরদের পূর্বজদের কৃতকর্মের অবমাননার পালা চলছে নাম-সংকীর্তণ
আর শহুরে ভদ্রলোকী-খেউড় সহকারে, ব্রিটিশ কোম্পানি রাজের সরাসরি প্রযোজনায়। যে
আলালি-খোকামির ঘটাকরে নাম দেওয়া হবে বাঙলার নবজাগরণ। পরে
বামপন্থীরা আর মনেপ্রাণে ব্রিটিশ সংস্কৃতিরপ্রতি নতজানু বুদ্ধিবিভাষাময় মানুষজন নবজাগরণকে
সংস্কারমুক্তি আন্দোলন নাম দিয়ে নিজেদের পৃষ্ঠকণ্ডুয়ণ করবেন। বিনয় ঘোষ ব্রিটিশদের
পক্ষে দাঁড়িয়ে তাদের সমাজভাঙা কর্মকে সমর্থন করতে, কোনও ঘোমটা না টেনে সরাসরি
বলছেন, নতুন যুগের নতুন মহানগরে যুগমানসের
অভিব্যক্তির সূত্রপাত হয়েছে। বিজ্ঞাণ, ব্যক্তিস্বাধীণতা,
সংস্কারমুক্তি, গণতন্ত্র ও শিক্ষার নতুন ভাবাদর্শের আমদানি হচ্ছে পণ্যদ্রব্য ও
কাঁচামালের সঙ্গে কলকাতার বন্দরে। অর্থনৈতিক সংঘাতের সঙ্গে
আদর্শ-সংঘাতও দেখা দিচ্ছে মহানগরে। অনিবার্য ঐতিহাসিক নিয়মে নবযুগের
বাঙলার নবজাগৃতিকেন্দ্র হচ্ছে কলকাতা। ব্রিটিশ
সমাজ-সংস্কৃতি-জীবনযাপন পদ্ধতির অনুকরণে হুগলির তীরে গড়ে উঠছে নতজানু ব্রিটিশবাদী
শহুরে ভারত। সনাতন ভারতের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের স্বার্থের সঙ্গে
সরাসরি সঙ্ঘাত লাগছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে বেড়েওঠা চাকুরিজীবি, ধণিকপুরুষ,
ব্যাসায়ী, দালাল আর দাদনি বণিকদের।
সপ্তদশ শতকে যখন বাঙলায় মোগল রাজশক্তি পূর্ণ মাত্রায়
শাসন করছে, সে সময়, বাঙলার অর্ধ সহস্রাব্দপূর্বে সমাপ্ত বৌদ্ধ রাজত্বের সামাজিক
ত্রিভূজের শীর্ষে অবস্থান করা বণিকেরা সেই রাজ্যের পড়ন্ত সময়ে ফিরে এলেন বর্ণময়
সনাতন সমাজের শৃঙ্খলে, পতিত হওয়ার নিদান শিরোধার্য করে(তত্ব সূত্র বেনের মেয়ে
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী)। ব্যবসায়ীরা শুধু বিদেশে নয়, দেশেও
ব্যবসা করেছেন। মঙ্গলকাব্য সাক্ষী। মেগল আমলে,
মির জুমলা বা শায়েস্তা খাঁরমত উচ্চপদস্থ কর্মচারী অথবা আলিবর্দি খাঁর দাদা হাজি
আহমদ বা সিরাজের মা আমিনা বেগম সোরা কেনাবেচার ব্যবসা করলেও, রাজদরবারের কড়া নীতি
ছিল রাজপুরুষদের ব্যবসার পরিবেশ থেকে সরে থাকা। এই নীতি
কঠোরভাবে মেনে চলা হত। ঔরঙ্গজেবের ভাষায় রাজপুরুষদের ব্যবসা সওদাইখাস আর
সাধারণের ব্যবসা সওদাইআম। মোঘলদের ধারণা ছিল, রাজকর্মচারীদের ব্যবসায় জড়িয়ে
পড়া, তাদের পদমর্যাদার প্রতি শোভাবর্ধক নয়। আর সেসময় সরকারি রাজপুরুষেরা বিশেষ
করে মোঘল রাজদরবারের চাকুরেরা নিয়ম মেনে সাম্রাজ্যের ব্যবসা বাণিজ্যে হস্তক্ষেপ
করতেন না। সরকারি পদের অপব্যবহার করে কেউ ব্যক্তিগতভাবে বাণিজ্য
করতে পারতেন না(সূত্রঃ পালাশির ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ, রজতকান্ত রায়)। পলাশিপূর্বে, ক্রমশঃ সমুদ্র পথের
বাণিজ্য বিদেশি সওদাগরদের হাতে গেলেও, সড়ক পথের বাণিজ্যে কিন্তু দেশিয়
ব্যবসায়ীদের রমরমা। হুগলি বন্দরে তখন চিন, ইরান, তুরানের ব্যবসায়ীদের ভিড়। কাশিমবাজার
আর মুর্শিদাবাদে গুজরাটি ব্যবসায়ীদের রেশম উপনিবেশ গড়ে উঠেছে। গুজরাট
থেকে আসত তুলা আর বাঙলা থেকে জলপথে সেখানে যেত রেশমজাতদ্রব্য। কাশ্মীর
থেকে ব্যবসায়ীরা এসে নিমকমহল থেকে নিয়ে যেত নিমক।
মুর্শিদাবাদ, পাটনা, ঢাকা, হুগলির ব্যবসায়ীরা সমবেত হয়ে বাঙলার ব্যবসা বিকাশের
পরিবেশ চাঙ্গা করে রেখেছিল। বাঙলা তথা ভারতের অর্থনীতি ছিল
উদ্বৃত্ত।
পলাশির ঠিক আগে মুর্শিদাবাদ বয়ে হুগলি হয়ে ব্যবসার
কেন্দ্রবিন্দু কলকাতা বন্দরে সরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল ক্রমশঃ ইংরেজদের
নলচালনায়। বাঙলা সুবার টাকার
নিয়ন্ত্রণ জগত শেঠদের হাতে ছিল বলে সেই কাজটা তখনও সমাধা হয় নি। মাদ্রাজে কোম্পানির টাঁকশাল ছিল। কোম্পানি আর্কট টাকা ছাপাত। বাঙলায় নবাবেরা টাকা ছাপানোর দায়িত্ব ইংরেজদের হতে দেন
নি। দাদুর প্রভাবে সিরাজ বুঝতেন ইংরেজদের চরিত্র। তিনি ইংরেজদের বিশ্বাস করতেন না। বাঙলার বড় টাঁকশালটা তখন মুর্শিদাবাদে আর রাজমহলে ছিল
আর একটা। নবাব বছর বছর তার
ইজারা দিতেন। সিরাজের সঙ্গে লড়াই
হওয়ার চল্লিশ বছর আগে ইংরেজরা ফারুখশিয়রের রাজদরবার থেকে প্রায় এক লক্ষ ডলার খরচ
করে ব্যবসার দস্তক নেয়। সেই দস্তক জাল করে
অন্যান্য বিদেশি ব্যবসায়ীদেরও অবাধে ব্যবসার সুযোগ করে তাদের কাছ থেকে ভেট নিত।
No comments:
Post a Comment