জয়াবন্দনার সঙ্গে যাঁদের কথা না বললে অমিত অপরাধ হবে, তাঁদের মধ্যে স্মরণ
করি, প্রয়াত রঘুনাথ গোস্বামী মশাইকে যাঁর হাত ধরে আমরা পথচলা শুরু করেছিলাম। ১৯৯৪ থেকে রঘুনাথবাবুর সঙ্গে বাঙলার মুখোশের গবেষণা শুরু করতে না করতেই
প্রয়াত হলেন। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ভবানীবৌদি, ভাগনে
দিলীপদাও আমাদের অনেকদিন আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন। রঘুনাথবাবুই পরিচয় করিয়েদিয়েছিলেন নীলাদ্রি চাকীর সঙ্গে। বিশ্বের নানান প্রান্তের, এমনকী এস্কিমোদেরও জীবন নিয়ে গড়িয়াহাটের
বাড়িতে অনেক দূর আলেচনা চলেছিল নীলাদ্রিদার সঙ্গে। তাঁর বাড়িতে নানান দেশের নানান গ্রামীণ কারিগরীর দ্রব্য দেখেছিলাম। বিশ্বের নানান দেশের নানান তুচ্ছসম গ্রামীণ কারিগরীর সঙ্গে তার মাধ্যমেই
আমাদের প্রথম আলাপ। একসঙ্গে অনেক কাজ করার কথা হয়েছিল। আমাদের অনেকের অনেক ধারণা বদলে তিনি আবার ফিরে গেলেন কানাডা।
ভারতের মহিলা লোকনাট্যের গবেষক, ধ্রুব দাসএর হাত ধরে দলবেঁধে প্রথম
দেখেছিলাম রায়গঞ্জে লোকনাট্য উত্সব। ছিলেন শিশির
মজুমদার মশাই যার জন্য আমরা নানান অচেনা অজানা বন্ধুরা এক হতে পেরেছিলাম। আজও বিধান বিশ্বাস সরকারি কর্মেও সময় বার করেন গ্রাম সমাজের কাজে। অঙ্গিরা গোস্বামী আজ বিদেশে, সেখানেও তিনি তাঁর পুরোনো কাজে ব্যাপ্ত। লেখকদের একজন বিশ্বেন্দু, বিধান আর আঙ্গিরা একসময় একমনা ছিলেন – অঙ্গিরার আজ বাঙালির প্রার্থিত দেশ আমেরিকায় বাস। ললিতা ঘোষ আমাদেরই দলের একজনের সহধর্মিনী। জেলেপাড়ায় কলিকাতা কৈবর্ত সমিতিতে সঙ্গ পেযেছি শংকর প্রসাদ দের। তিনি আজও আমাদের গর্ব। কৈবর্ত সমাজের
ওপর একটি দিগদর্শণ বই লিখেছেন। সঙ্গ পেয়েছি
কাঞ্চন মুখোপাধ্যায়ের। কৈবর্ত সমিতিতে আসতেন একঝাঁক শিক্ষক – জ্ঞাণেশ মুখোপাধ্যায়, পবিত্র সরকার, সুধীর কুমার করণ, সুখবিলাস বর্মা,
মহুয়া মুখোপাধ্যায়, দেবযানী চালিহা, পশুপতিপ্রসাদ মাহাত, বটু পাল, খালেদ চৌধুরীসহ
আরও অনেক জ্ঞানীগুনী। প্রায় দুতিন বছর সোমেন রায় আমাদের
তাঁর ঝাড়গ্রাম বাড়িতে স্থান দিয়েছিলেন অসীম ঔদার্যে। তাঁর সঙ্গে ঘুরে শুধু জঙ্গলমহল নয়, চিনেছি বাঙলার নানান জনপদ, সম্পদ। তাঁরসঙ্গে মতের পার্থক্য ছিল, পথের পার্থক্য হয় নি। অকাতরে অর্থ ব্যয় করেছেন। তাঁর সঙ্গে
মিলে তৈরি করেছিলাম ১২ খন্ডের ক্যাসেট ভালবাসার গান প্রতিবাদের গান। উলগুলানের শতবর্ষে। অসীম সাহায্য
করেছিলেন তুষার তালুকদারমশাই, সাংবাদিক তাপস গঙ্গোপাধ্যায় মশাই। বন্ধু যতীন আর নারায়ণ মাহাতর বন্ধুত্বময়, তত্বময় আলেচনা আমাদের আজও সঙ্গী। ইন্দ্রজিত চৌধুরীর সঙ্গে বহু আলোচনা হয়েছে। তিনি আমাদের অনেক কিছু জানিয়েছেন।
বাঙলার তথা ভারতের পথ ব্যবসায়ীদের সঙ্গ করেছি, তাঁদের প্রচলিত ব্যবসার
জ্ঞাণের কথা অনেক অজানা কথা জানতে পেরেছি। তাঁদের
আন্দোলনের সঙ্গী হয়েছি প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। অনাদি সাহার অবদান ভোলা যাবে না। এই সমাজকে
চেনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন শক্তিমান ঘোষ। পারম্পরিক
ব্যবসা সম্বন্ধে জানতে তিনি নিজে হাত বাড়িয়ে যে পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছেন, সে কথা
আজও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণকরি। তাঁর হাত না
ধরতে পারলে আমাদের পারম্পরিক পরিযায়ী ব্যবসায়ীদের সম্বন্ধে অনেক ভুলধারণা থেকে যেত। এ আন্দোলনে অনেক গুনী ব্যক্তির সাহচর্য পেয়েছি তার মধ্যে সত্যজিত দাশগুপ্ত
অন্যতম। তাঁর সঙ্গে আলোচনা আজও হয়। একসময় সুনন্দন রায়চৌধুরী আর সুশান্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে নানান বিষয়ে
দীর্ঘ আলোচনা আমাদের নতুন করে ভাবতে সাহায্য করেছে। ছান্দারের উত্পল চক্রবর্তী আর বাঁকুড়ার গৌতম দে ভাবিয়েছেন। আলোচনা করে উপকার পেয়েছি হৈমন্তী চট্টোপাধ্যায় অনুপ মতিলালের সঙ্গেও। এঁরা আমাদের কথা যথেষ্ট মন দিয়ে শুনেছেন, আমরা তাঁদের স্মরণ করছি।
সবশেষে যাদের সঙ্গ না করলে এই বইটিই লেখা হত না, যাদের কাছে গিয়ে পুরোনো
পড়া ভুলে নতুন সব কিছু শিখেছি, সেই গ্রামীণ শিল্পী, মানুষদের কথা যত বলি ততই যেন
বেড়ে চলে। ফুলিয়ার হরিপদ বসাক আমাদের চোখ খুলে
দিয়েছেন বয়নশিল্প নিয়ে আলোচনায়। তিনি না হলে
এপার, ওপার বাঙলার বয়ন শিল্প আর শিল্পীদের হৃদয়নিংড়োনো ব্যথা হয়ত টেরটি পেতাম
কিন্তু অন্তরের অন্তঃস্থলে পৌঁছতে পারতাম না। মধুমঙ্গল মালাকারের কথা যত বলাযায় ততকম। আমাদের কয়েকজনের শুধু ঠেকনা নিয়ে, নিজের উদ্যমেই দাঁড় করিয়েছেন বঙ্গীয়
পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘ আর বঙ্গীয় পারম্পরিক অভিকর শিল্পী সংঘ। আমরা শিখেছি হরকুমার গুপ্ত, কে কে হাজরা, নারায়ণ রায়, বাজার হেমব্রম,
পোস্তবালা, বিমলাবালা, বিজয় মাহাত, বসন্ত মালাকার, ভবানী বিশ্বাস, নেপাল সূত্রধর ও
তাঁর পুত্র-নাতিরা, সুবল দাস বৈরাগ্য, প্রয়াত বাউল সুবল দাস, অরুণ ভাস্কর, রবি
বিশ্বাস, মণিমালা চিত্রকর, বৃন্দাবন চন্দ, চিত্ত রাণা, মাধাই মহান্ত, মানিক
সূত্রধর, শীতল ফৌজদার, ভবানী বিশ্বাস, নারায়ণ পৈত আরও আরও অনেকের থেকে অনেক কিছু। এঁদের অনেককে নিয়ে ভূমধ্যসাগরএ বেশ কয়েকটি লেখা লিখেছি, কিন্তু আরও
একটি পুরো বই তৈরি করার প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়াও
সুশান্ত মুখোপাধ্যায়, সুজিত নটি মুখেপাধ্যায়, মধুমিতা মুখোপাধ্যায়, সত্যজিত
দাশগুপ্ত, বন্দনা মুখেপাধ্যায়, দীপঙ্কর মুখেপাধ্যায়, বিশ্বজিত মহাকুড়, গনেশ
সেনগুপ্ত, অনিন্দ্য সরকার, কুণাল দেব, দেবল দেব, বাদল ঘোষ, করুণাপ্রসাদ দে, টুবলু
বহ্নিশিখা সেন, অনুরাধা তলোয়ার, স্বপন গঙ্গোপাধ্যায়, মোহন বিশ্বাস, সুতনু
ভট্টাচার্য, শুভ্রাংশু ভট্টাচার্য, প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায়, শুভ্র চট্টোপাধ্যায়,
সৌম্য আচার্য, সৌমিত্র ভট্টাচার্য, শিবব্রত চট্টোপাধ্যায়, শংকর ঘোষ, সব্যসাচী
চক্রবর্তী, প্রসেনজিত সিনহারাও নানান সময়ে নানানভাবে সমাজ বুঝতে সাহায্য করেছেন।
No comments:
Post a Comment