আমিলদের প্রধান কাজ ছিল জমিদারদের নিয়ন্ত্রণে রাখা, যাতে
তিনি সঠিক পরিমানে কর আদায় করেন এবং দিল্লির সরকারের অনুগত হয়ে থাকেন। প্রত্যক পরগণায় বংশানুক্রমিকভাবে একজন স্থানীয় জমিদার বা চৌধুরী নিযুক্ত
হতেন। এদের দায় ছিল সরকারকে খাজনা তুলে দেওয়ায়। এই খিদমতের জন্য তাঁরা বাত্সরিক আয়ের এক দশমাংশের হকদার ছিলেন। নিজামত, দেওয়ানি, কানুনগো, এই পদগুলির অধিকারীরা সরকারি কর্মচারী। নানান
এলাকায় বদলিও হতেন। অথচ জমিদার, চৌধুরি বা তালুকদারেরা
কেউই সরকারি কর্মচারী ছিলেন না। এরা বাঙলার
ভূশক্তির বংশানুক্রমিক প্রতিভূ হয়ে ওঠেন। বাঙলা সুবার জমির
খাজনার এক অংশ এদের মাধ্যমে যেত খালিসায় – কেন্দ্রিয়
তহবিলে। আর এক অংশ মনসবদাররা বিভিন্ন সওয়ার
রাখার জন্য জায়গির ভোগ করতেন। জমিদারিতে
জমিদারদের যেমন হক থাকত, জায়গিরে কিন্তু মনসবদারদের সেই হক থাকত না। সরকারি তহবিল থেকে মনসবদারদের সরাসরি বেতন দেওয়া না হলে সেই ঘাটতি মেটাতে
কোনও এক এলাকার খাজনা তাদের সাময়িকভাবে দেওয়া হত। নিজামত আর দেওয়ানির মাথারা তাদের পদানুযায়ী নগদ বেতন পেতেন। খাজনা আর মালজমি থেকে যে খাজনা আদায় হত, তার বাইরে বেশ কিছু নিষ্কর জমি
ছিল জমিন দপ্তরের আওতায় যা জমিদার বা নবাব বা সরকারেরা বন্টন করতেন মদদইমাশ,
লাখেরাজ(খেরাজ নামক কর বহির্ভূত জমির সত্ত্ব, লা-টি ঋণাত্মক উপসর্গ হিসেবে ব্যবহার
হচ্ছে যেমন লাজবাব), খয়রাত, আয়মা, পীরোত্তর, দেবোত্তর, মহাত্রাণ, চাকরান, পাইকান
হিসেবে। মোটামুটি এই ছিল বাঙলায় নবাবি আমলের
আগেরকার খাজনা আর জমিজিরেত সংক্রান্ত কাঠামো। বাঙলা, বিহার ওড়িশা– অর্থাত সুবা বাঙলার মোগল শাসক
দিল্লির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওযায় নতুন করে পদোন্নতি, পদবিভাজন, পদসৃষ্টির কাজ
শুরু হল। বাঙলাকে নতুন করে নতুন দৃষ্টিতে সাজানোর কাজ শুরু করলেন বাঙলা সুবার নবাব
একদা ঔরঙ্গজেবের প্রিয়পাত্র, পরে বাঙলার স্বাধীণ নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ।
জমিদারের কাজ ছিল সরকারের নির্ধারিত কর্মচারীর নির্ধারিত
রাজস্ব আদায় দেওয়া। কোনও জমিদার এই রাজস্ব আদায়ে অপারগ হলে জমিদারির মালিকানাসত্বের
জন্য আদায়িকৃত রাজস্বের একাংশ মালিকানা হিসেবে পেতেন। এই সূত্র অনুযায়ী জমিদার শুধুমাত্র মধ্যসত্বভোগী ছিলেন
না। তিনি ছিলেন এলাকার
জমির অছি। জমিদারদের মোটামুটি
তিন ভাগে ভাগ করা হত – ওয়াতন, মধ্যসত্বভোগী আর প্রাথমিক মালগুজারি। ওয়াতন বা স্বরাট জমিদারেরা ছিলেন প্রায় স্বাধীণ-
স্বয়াত্ব শাসনের অধিকারী। এরা বাদশাহকে বার্ষিক
রাজস্ব দিয়ে, যুদ্ধের সময় সৈন্যবাহিনী সরবরাহ করে সাহায্য করতেন। অধীনস্থ
জমিদারদের থেকে রাজস্বও আদায় করতেন। রাজস্ব দাখিলের খিদমত বাবদ তারা রুসুম বা নানকর ভাতা
পেতেন। কুচবিহার, কোচ-হাজো
রাজা বা ত্রিপুরার রাজারা প্রথম শ্রেণীর জমিদার। এই জমিদারিগুলো তৎকালীন বাংলা সাম্রাজ্যের সীমান্ত। মুঘল
নথিপত্রে এদের মর্যাদা, সুযোগ-সুবিধে, অধিকারসমূহ অন্য জমিদারদের থেকে পৃথক। এরা নিয়মিত বার্ষিক রাজস্ব দিলে বাদশাহ এদের স্বায়ত্ব
শাসনের বৃহত্তর অধিকার মেনে নিতেন। এদের শক্তি এতই বড় ছিল যে কেন্দ্রিয় শাসন দুর্বল হলে
এরা সবার আগেই স্বাধীন হয়ে যেতেন। মনেরাখতে হবে, দিল্লির শাসন নড়বড়ে হওয়ার সময়ই
মুর্শিদকুলি খাঁর স্বাধীণতা সংগ্রামের আগেই ত্রিপুরা, কুচবিহার আর অসমের জমিদারেরা
স্বাধীন হয়ে যান। তবে মুর্শিদকুলি খাঁ
নবাব হলে এরা সকলে তার বশ্যতা স্বীকার করে তাকেই রাজস্ব দিতেন। তবে ত্রিপুরা, অসম আর কুচবিহার রাজের নিজস্ব
রাজস্বস্থাপন আর রাজস্ব সংগ্রহের প্রথা ছিল। বাঙলার উত্তর, পূর্ব, আর পশ্চিম সীমান্তের জমিদারেরাও
প্রায় স্বাধীন ছিলেন। মুঘল শাসন এদের ওপর
তেমন কর্তৃত্ব করতে পারেনি। মুঘল সরকারকে নামমাত্র রাজস্ব দিয়ে বহিরাক্রমণথেকে
বাঙলাকে রক্ষা করতেন। এর বিনিময়ে তারা
স্বশাসন ভোগ করতেন। বিষ্ণুপুর, বীরভূমের
রাজারা এই ভাগে পড়তেন। জঙ্গলমহলের রাজারাও
এই ভাগে ছিলেন। পঁচেট, ময়না,
চন্দ্রকোণার জমিদারদের নিজস্ব দুর্গ ছিল। পাবনা, রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, কামরূপ, কুড়িবাড়ির
জমিদারেরাও নামমাত্র মুঘলদের অনুগত ছিলেন। দিল্লিতে এরা নামমাত্র পেশকাশ দিয়েই অনুগত ছিলেন। এরা বাঙলার নবাবকে নিয়মিত রাজস্ব দিতেন না। মনসব আর খেলাত দিয়ে এদের সাম্রাজ্যে ধরে রাখার চেষ্টা
হত। বাঙলার ভূমিরাজস্বের কেন্দ্রবিন্দুতে
ছিলেন বাঙলার ছয় বড় জমিদার – বীরভূম, বিষ্ণুপুর, বর্ধমান, নদিয়া, নাটোর,
দিনাজপুর। এরা ভূমিরাজস্বের ৫০
শতাংশই আদায় দিতেন। নবাবি আমলে অনেক
জমিদারি প্রসারিত হয়েছিল, যেমন রানী ভবানীর নাটের রাজ। এছাড়াও স্থাপিত হয় মুক্তাগাছা আর ময়মনসিংহেরমত নানান সুবৃহত
জমিদারিও। সম্রাট নতুন
জমিদারদের স্বীকার করতেন আর সনদ দিতেন। বড় জমিদারেরা বাদশাহের সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে পারতেন। এরা চাকলাদার, কানুনগো, চৌধুরি হিসেবেও কাজ করতেন, রাজা
মহারাজা উপাধি পেতেন, সৈন্য পালতে পারতেন। ছোট জমিদারি বা তালুকদারি ছিল অসংখ্য। এরা সরাসরি সনদ পেতেন না। এদের প্রশাসনিক দায় ছিল না বা সৈন্যবাহিনী রাখারও
অনুমতি ছিল না। তালুকদারদের ভাগ ছিল
দুধরনের – হুজুরি আর মাজকুড়ি। হুজুরি তালুকদারেরা রাজস্ব সরাসরি রাজকোষে জমা দিতেন।মোগল শাসনতন্ত্র অনুযায়ী বাঙলা সুবায় ৩৪টি সরকারের প্রত্যেকটিতে আলাদা আলাদা করে ফৌজদার থাকার কথা কিন্তু ১৭২২এ সমগ্র বাঙলাদেশকে ১৩টি সুবৃহত চাকলায় ভাগ করে ২৫টি জমিদারি - ইহ্তমাম আর ১৩টি জায়গিরে বন্দোবস্ত করেন। জলাজমিঅধ্যুষিত বাঙলায় ঘোড়সওয়ার বাহুল্য বিবেচনা করে খরচ কমাবার জন্য তিনহাজারি ফৌজদার বরখাস্ত করে মনসবদারদের জায়গিরগুলি ওড়িশাতে সরিয়ে বাঙলার তিনচতুর্থাংশ মালজমি খালিশার অন্তর্ভূক্ত করেন (ঐতিহাসিকদেরমতে জাফর খাঁর এই পদক্ষেপেই পলাশির চক্রান্ত এবং পলাশীর রণাঙ্গনে হারের কুড় লুকিয়ে ছিল)। ১০টি বৃহত্তম এলাকার মধ্যে সব থেকে বড়টি ছিল ঢাকার নায়েব নাজিম শাসিত নিয়াবত আর অন্য নয়টি ছিল – চট্টগ্রাম(ইসলামাবাদ), মেদিনীপুর, পুর্ণিয়া(জালালগড়), রাজশাহি, সিলেট, রঙপুর, রাঙামাটি, কাটোয়া, হুগলির বন্দর এলাকা(সপ্তগ্রাম, আজকের আদি সপ্তগ্রাম রেল স্টেশন)। এই দশটি এলাকা বহু ছোট ছোট তালুক আর জমিদারি নিয়ে গঠিত। পরের দিকে বর্ধমান, বিষ্ণুপুর, নদিয়া, বীরভূম, যশোহর, রাজশাহি আর দিনাজপুর এই সাতটি আর শুধুমাত্র জমিদারি হিসেবেই স্বীকৃত নয়, নবাবীর অন্তর্ভুক্ত প্রায়-স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল। এই ঐতিহাসিক বন্দোবস্তের নাম জমা কামেল তুমারি। প্রায়-স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল, তাই এগুলির নজরদারিতে আর কোনও সরকারি আমিল রইল না। প্রয়োজনে মুর্শিদাবাদ থেকে আমিল পাঠিয়ে খাজনা আদয় করা হত। মুর্শিদাবাদের জগত শেঠেদের দেওয়া কর্জের মাধ্যমে ঠিক সময়ে জমিদারেরা খাজনা জমা করতেন নবাবের দরবারে। সেই খাজনা জগত শেঠের হুন্ডির মাধ্যমে বাদশাহী নজরানা রাজধানীতে পৌঁছে যেত। তখন মুর্শিদাবাদে জগত শেঠের কুঠিই বাদশাহী তোষাখানা। তাদের। জমিদারি কিস্তি আর টাঁকশাল নিয়ন্ত্রণ করে জগত শেঠেরা বাঙলা সুবার অর্থনীতির ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। আক্ষরিক অর্থে জগতশেঠদের ট্যাঁকে গোঁজা থাকত ট্যাকশালের চাবি, বাদশাহি তোষাখানায় নয়। বাঙলার অর্থনীতির ওপর এতই দবদরা ছিল। পরেরদিকের বাঙলার জমিদারি প্রকল্পের ভিত্তি ছিল মুর্শিদকুলি খাঁর ভাগবাঁটোয়ারা।
No comments:
Post a Comment