আমাদের দলের
পক্ষথেকে গ্রামীণ সংস্কৃতির কুড় খুঁজে পাওয়ার, গ্রামীণ সংস্কৃতির রক্ষকদের প্রতি
ন্যুনতম শ্রদ্ধানিবেদনের চেষ্টার একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মুটেগিরি এই বইটি – যদিও আমরা বিশ্বাসকরি মুটেগিরিও করতে বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন। বহুদিনধরে নিজেদেরমত করে আমরা চেষ্টা করছি বাঙলা সংস্কৃতির জ্ঞাণচর্চার
উদ্যমগুলোকে নথিকরণ করার। গ্রামীণরা হাজার হাজার বছরধরে যে
জ্ঞাণচর্চার কাজটি করে আসছেন, সেই কাজের স্বীকৃতি তাঁরা যে সাধারণের থেকে পেয়েছেন,
গ্রামেগঞ্জের নানান মৌখিক কাব্যকাহিনীতে তার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে। সেই সাধারণ স্বীকৃতিটুকু তাদের দেওয়ায় কার্পণ্য রয়েছে শহুরে পশ্চিমি
জ্ঞাণবিজ্ঞাণ নিয়ে চর্চা করা মানুষদের, ব্যতিক্রম সবসময়েই, সব কালেই, সব শহুরে
সমাজেই বিদ্যমান। বইটি লেখার পরে কিন্তু একটি আদত কথা
স্বীকার না করলে আমরা নিজেদের কাছেই ছোট হয়ে পড়ব, আজও আমরা দেশিয় গ্রামীণ
জ্ঞাণচর্চার মূলের ধারে কাছেও পৌঁছতে পারি নি। দুদশক গ্রামেগঞ্জে ঘুরেফিরে কয়েকটি জ্ঞাণের টুকরো নথিকণের কাজটুকু পর্যন্ত
পৌঁছতে পেরেছিমাত্র। তার বেশি কিছু নয়। সমগ্র বইটি জুড়ে পশ্চিমি জ্ঞাণচর্চার নানান চিন্তাভাবনা, পদ্ধতি দগদগে
ঘায়েরমত ছড়িয়ে রয়েছে।
প্রকাশিত বক্তব্যের প্রমাণরূপে শুধুই লিখিত পুঁথিগুলিকেই মান্যতা দেওয়ার
পশ্চিমি জ্ঞাণচর্চার ইতিহাসের বাইরে দাঁড়িয়ে আমরা চেষ্টা করেছি নতুন করে নতুনভাবে
ভারতীয় সভ্যতার চলনকে দেখার। এই বইটি
লিখতেগিয়ে আমরা বেশকিছু ইংরেজি বই অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছি, প্রত্যেকটি বইতেই একই
ধারা বহন করে চলা হয়েছে। বিগত দুশ বছরের শিল্পবিপ্লবজাত
সভ্যতার বিকাশে পশ্চিমিভাবুকেরা জ্ঞাণচর্চাকে তুলে নিয়েগিয়েছেন নতুন এক উচ্চতায়,
সে কথা কবুল না করলে মুর্খতা হবে। তত্সত্বেও এও
সত্যি যে, গ্রামীণ মানুষের প্রতি প্রগাঢ় অবিশ্বাসই পশ্চিমি সভ্যতার জ্ঞাণচর্চার
মূল ধারা। এই দর্শণ চারিয়ে গিয়েছে জ্ঞাণচর্চার
অন্যএক বিভাগ, প্রযুক্তিচর্চাতেও। প্রাথমিকভাবেই
শিল্পবিপ্লবের শুরু থেকেই পশ্চিমি প্রযুক্তি বিকাশ-গবেষণার এক বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল
মানব শ্রমকে প্রতিস্থাপিত করে যন্ত্রের প্রতিযোগী করে তোলা। মানুষকে উদ্বৃত্ত এবং তার মুখের কথাকে অবিশ্বাস করাই যে সভ্যতার ধর্ম, তার
অন্ততঃ ভারতীয় সভ্যতাকে দেওয়ার কিছুই নেই(ঠিক সেই জন্যই ইওরোপকে বাধ্য হয়ে প্রবল
প্রতাপে শুরু করতে হয় ওরাল হিস্ট্রি – মৌখিক ইতিহাস প্রকল্প,
যেন এটিও ইওরোপিয় জ্ঞাণচর্চার নতুনতর শাখা)। প্রাথমিকভাবে,
মানুষের প্রতি অবিশ্বাসের ধারণা থেকেই তৈরি হয় এ ধরণের জ্ঞাণচর্চার ইতিহাসের
প্রক্রিয়াটি, যা আজও ফলে ফুলে বিকশিত হয়েছে জ্ঞাণবিজ্ঞাণ, প্রযুক্তি চর্চার
নানাবিভাগে। বিনা বাক্যব্যয়ে, বিনা প্রশ্নে শহুরে
ভারতীয় জ্ঞাণচর্চার ধারাটিও মিলেমিশে গিয়েছে এই ধারার সঙ্গে। এর সঙ্গে মৌলিক বিরোধ আমাদের থাকবেই।
বাল্যকাল থেকে পশ্চিমি একমুখী, এককেন্দ্রিক, স্ট্রাকচারাল,
স্ট্যান্ডার্ডাইজড জ্ঞাণচর্চার পরিবেশে যে ভাবে গড়ে উঠেছি আমরা, সেই প্রভাব আজও
আমাদের অনতিক্রম্যভাবে ঘিরে রেখেছে, ভারতীয় গ্রাম সমাজে বিশবছর কাটিয়ে দেওয়ার পরও। ভারতেবর্ষের সমাজ পশ্চিমি সভ্যতার তৈরি নানান স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনকে
এড়িয়ে গিয়েই নিজেরমতকরে গড়ে পিটে নিয়েছে সভ্যতার রেণুগুলি। একটি সমাজ অন্য সমাজের প্রচলিত জ্ঞাণচর্চার রীতিনীতি বহুসময়ই মেনে চলেনা। তাতে এক সমাজের সঙ্গে অন্য সমাজের সখ্য, জ্ঞাণ অথবা ভাবের আদানপ্রদানে
বিন্দুমাত্র অভাব ঘটেনি, ভারতীয় গ্রামীণ সভ্যতার হাজার হাজার বছরের বনিয়াদও ভেঙে
পড়েনি। প্রত্যেক সমাজের নিজস্ব জ্ঞাণচর্চার
ধারাকে সকলেই মান্যকরত। সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে, সবার
জ্ঞাণচর্চার ইতিহাসকে নিজের সঙ্গে নিয়ে চলার নামই ভারতের সমবায়ী সভ্যতা। আমরা বিশ্বাস করেছি এতে ভারতীয়ত্ব আরও দৃঢ় হয়েছে, ভারতীয় সভ্যতা আরও গভীর
হয়েছে, যতদিন না পশ্চিম হাতে অস্ত্র নিয়ে গায়ের জোরে ভারতীয়ত্বকে
উপড়ে ফেলে তার সভ্যতার জ্ঞাণচর্চাকেই সমূলে প্রোথিত করার চেষ্টা করেছে।
আমরা বিগত দুই দশক ধরে চেষ্টা করেছি এই সভ্যতার নানান প্রকরণ, জ্ঞাণচর্চা,
শেখার, বোঝার, জানার। আজও আমরা এই ব্যতিক্রমী সমাজের দেশের
মানুষের ভাষা ব্যবহার, উপমা ব্যবহার, লেখ্য প্রকরণ, রচনাশৈলীর দার্শণিক
বিন্দুগুলির কিছুমাত্র ছুঁতে পারিনি। এটি আমাদের
অযোগ্যতা। যতদিন কাজ করেছি, ততদিনধরে মনেমনে
গুমরছিল আমরা গ্রামসমাজের অনেককিছুই ছুঁতে পেরেছি, অর্জন করতে পেরেছি। বইটির প্রথম খসড়া লেথার পর গ্রামকে দার্শণিকভাবে জানার, শেখার সমস্ত গর্ব
খান খান হয়ে ভেঙে পড়েছে। আজও নিজেদের গ্রাম বাঙলার দর্শণের
সাধারণ ছাত্র নামে অভিহিত করতে পারি কী না, সে দক্ষতাটুকুও আমরা কেউ অর্জন করেছি
কী না, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। নতমস্তকে বলি দুদশকের গ্রামজন, গ্রামদর্শণ জানাবোঝার অহমিকা একবছরের বই
রচনাকালে বড় প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে। এখোনো আমরা, আমাদের মনন, কলম জর্জরিত হয়ে রয়েছে কেন্দ্রিকৃত পশ্চিমি
জ্ঞাণচর্চায়। চাপিয়ে দেওয়া এই দর্শণ থেকে যে
বেরোতে হবে, এটুকু আমাদের এখনকার প্রচেষ্টা। এই লেখায় ক্ষমতারমত
হাজারো শব্দ অবলীলায় সদর্থে ব্যবহার করেছি, যা আদতে চাপিয়ে দেওয়া, কেন্দ্রিকৃত
সভ্যতার শেখানো বুলি, যা আমরা ছেটবেলা থেকে অর্জন করেছি পশ্চিমি পদ্ধতিতে
পড়াশানার মাধ্যমে। এখোনো এর বাইরে বেরিয়ে আসার পথ পাই
নি। খুঁজে চলেছি।
সবশেষে নিরপেক্ষতার প্রশ্ন। বইটি লেখার দৃষ্টিভঙ্গীতে লেখকদের সমকালীন নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ
পেয়েছে কীনা তা নিয়ে সমকালীন পন্ডিত, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা ভ্রুকুঁচকে তাকাবেন
জেনেও বলাযাক, আমরা মনেকরি লেখাটি যথেষ্ট সমকালীন, কিন্তু নিরপেক্ষ নয়। লেখকের নিরপেক্ষতা একটি সম্পূর্ণ পশ্চিমি ধারণা। পশ্চিমি লেখকেরা ঐতিহাসিকভাবেই নিজেদের জ্ঞাণবিজ্ঞাণচর্চা বিষয়ে এতই
পক্ষপাতমূলক যে তাঁদের জ্ঞাণবিজ্ঞাণচর্চায় বারবার নিরপেক্ষতা ঘোমটার আড়াল টানতে
হয়। আমাদের আরও বিশ্বাস কোনও লেখা অথবা কোনও লেখকই
সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতি নিরপেক্ষ হতে পারেননা। তাঁকে কোনও না কোনও পক্ষ গ্রহণ
করতেই হয়। এই বইতে আমরা, পার্থ এবং বিশ্বেন্দু
অন্ততঃ সরাসরি দেশিয় জ্ঞাণচর্চা, দেশি মানুষের উদ্যমের পক্ষে দাঁড়িয়েছি। এর অর্থ দেশিমানুষদের কোনও গৃহীত পদক্ষেপের সমালোচনা এড়িয়ে গিয়ে শুধুই
চিনির সিরা দিয়ে লেখনকর্ম নয়। যখন নিজেদের
সংস্কৃতির অঙ্গন ছেড়ে চিরাচরিত শিল্পীরা অনেকসময়ই আশ্রয় নিচ্ছেন শেকড়ছেঁড়া এক
সংস্কৃতির কোলে, তথন কিন্তু সেই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধতা করতে বিন্দুমাত্র হাত
কাঁপেনা আমাদের। তবুও আমরা দেশি সংস্কৃতির পক্ষে। নিরপেক্ষতার ধরিমাছ না ছুঁই পানির খেলায় এ বইএর লেখকেরা যে অন্ততঃ নেই এ
কথা জোর দিয়ে নতুন করে বলা যাক।
অলমিতি। জেহার।
বিশ্বেন্দু
নন্দ, পার্থ পঞ্চাধ্যায়ী,
কলাবতী মুদ্রা
নথিকরণ দলের পক্ষে
No comments:
Post a Comment