ব্রিটিশদের
উপনিবেশের ভালত্বের প্রচারের ব্যাপকতার মাঠা শহুরে ভারতীয়দের মাথায়ই শুধু
স্থায়ীভাবে ধরে নি, তারা সেই অদ্ভুতুড়ে তত্ব প্রয়োগ করে, গ্রামীণ বাঙলা ধংস করে,
আর্থিকভাবে নিজেদের জীবন শুধরে নিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপকার করে গিয়েছেন। পলাশির পরই
গ্রামীণ বাঙলা, স্বদেশে ব্রিটিশদের লুণ্ঠন আর শোষণের বিরুদ্ধে এক্কাট্টা হয়ে
স্বাধীণতা সংগ্রামের ধ্বজা তুলে নিয়েছিলেন, ব্রিটিশের সেনা বাহিনীর সামনে বুক
চিতিয়ে মারা যাচ্ছিলেন অকাতরে, নিজেদের স্বাধীণতা বজায় রাখতে। তখন শহুরে
উচ্চমধ্যবিত্ত বাঙালি হয় জমিদারি কিনছেন, নয়তবা দেওয়ানি বা বেনিয়ানি করে দুপয়সা
কামাই করছেন, নয় নুন, আফিম বা নীলের ব্যবসায় ব্রিটিশদের জাঁকজমকওয়ালা অপচয়মুখী
জাবনযাত্রা নকল করে, কোম্পানির বা ইংগ্লন্ডেশ্বরীর স্নেহশীল ছাতার তলায় থেকে, দামি
চাকরি নিয়ে, ইওরোপিয় জীবনযাত্রা নকল করে ধণী হওয়ার মৌতাতে মশগুল।
তান্ডা, রাজমহল গৌড় নবদ্বীপ বয়ে এসে কলকাতা তখন বাঙলার
রাজধানী। ইংলন্ডের অথবা ইওরোপের নানান ব্যক্তিত্বের অথবা স্থানের
সঙ্গে বাঙলাকে তুলনার শ্লাঘাজনিত দারিদ্র্যের যুগের সূচনা হয়ে গিয়েছে। ব্রিটিশ
পন্ডিতদের(পরে মার্ক্স-এঙ্গেলস) প্রচারে একটিই স্বতঃসিদ্ধ ছড়িয়েছে শহর বাঙলা
জুড়ে, ব্রিটিশরাই বাঙলার উদ্ধারকর্তা। বাঙলার বিশ্ববিদ্যালয় হাতিবাগান,
নবদ্বীপ, ভাটপাড়া, বর্ধমান, বিষ্ণুপুরের সঙ্গে ধনীদের সন্তানদের বিচরণভূমি
অক্সফোর্ডএর তুলনা, কলকাতার সঙ্গে ফ্লোরেন্সের তুলনা, রামদুলাল অথবা জগতশেঠদের
রথসচাইল্ডের সঙ্গে তুলনা টানার সময় এসে গিয়েছে কলকাতায় রাজধানী পত্তনের সঙ্গেই। ধণার্জণের আশায়,
ব্যক্তিগত উদ্যমকে অস্তমিতকরে ব্রিটিশ আর ঔপনিবেশিক সরকারের নানান কাজকর্মের সঙ্গে
মিলেমিশে, গ্রামের পাট তুলে দিয়ে, গ্রামের আশা আকাঙ্খার সঙ্গে নিজেদের বিযুক্ত
করে, শহরে জাতে ওঠার শিহরণে নিজেদের চিন্তাবোধ ব্রিটিশদের পায়ে বিলিয়ে, ইওরোপবাদী
আধুনিক হওয়ার প্রণোদনায়, ব্রিটিশ শাসিত কলকাতার তিনটে পঞ্চায়েত(গ্রাম সমষ্টি) দখল
করে, তিন পঞ্চায়েতের হাজারো গ্রামীণদের উচ্ছেদ করে ভিড় জমাচ্ছেন ভারতীয় নব্য
আর্থিক কুলীনেরা। এঁরা সকলেই উপনিবেশের প্রভুত্বে বিশ্বাসী, চিন্তার
মুক্তির নামে ভাবনার দাসত্বের কারবারি। আমিরাবাদ, কলকাতা প্রভৃতি পরগণার
প্রভাবশালী জমিদারেরা গঙ্গোপাধ্যায়, দে, রায়চৌধুরীদের উত্তরসূরী মনোহর রায়, মনোহর
সিংহ কলকাতায় বাসস্থান তৈরি করছেন আর ব্রিটিশদের জীবনযাত্রা নকল করে
সাম্রাজ্যযোগ্য হয়ে উঠছেন। প্রমথনাথ মল্লিক, কলিকাতার কথায়
বাঙালির নকলনবিশি নিয়ে গ্রাম কলকাতার একটি ছড়া উল্লেখ করছেন, ধন্য ওহে
কলিকাতা, ধন্য ওহে তুমি, যতকিছু নতুনের তুমি জন্মভূমি / দিশি
চাল ছেড়ো দিয়ে বিলেতের চাল, নকুলে বাঙালি হল যে
কাঙাল / রাতারাতি বড়লোক হইবার তরে,
ঘরছেড়ে কলিকাতা গিয়ে বাস করে।
লটারি কমিটির টাকায় কলকাতাকে দ্বিতীয় লন্ডন করে তুলছে
কোম্পানি। সহায়ক হয়েছেন
গোমস্তাগিরি, দেওয়ানি, বেনিয়ানিতে বামমহস্ত নিয়মে নানান রোজগারে, নীল, আফিম
সর্বোপরি নুন ব্যবসায়ী বাঙলার মধ্যবিত্ত আর ধনীরা। এই ইঙ্গ-বঙ্গ ধণিক-বণিক জোটের উত্তরাধীকারীরা নবজাগরণের
অগ্রদূতরূপে সম্মানিত আজও। রাজা রাজবল্লভ এবং
মহারাজা নন্দকুমারের পুত্র গুরুদাস সুতানুটিতে, মহারাজা নবকৃষ্ণ শোভাবাজারে,
আমিচাঁদ হালসিবাগানে, মহীশূর আর অযোধ্যার নবাব টালিগঞ্জ আর মেটিয়াবুরুজে, আন্দুল
রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ভ্যান্সিস্টার্টএর দেওয়ান রামচরণ আন্দুলে, হুইলার সাহেবের
দেওয়ান দর্পনারায়ণ ঠাকুর পাথুরিয়াঘাটায়, দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ আর ওয়ারেন
হেস্টিংসএর দেওয়ান কান্তবাবু (কাশিমবাজারের বেনিয়া কৃষ্ণকান্ত নন্দী, ওরফে
কান্তবাবু ওরফে কান্ত মুদি কাশিমবাজারে কুঠির রেসিডেন্ট ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে
সখ্য করেন। পরে পলাশি-পূর্ব চক্রান্তকালে একদা হেস্টিংসের জীবন রক্ষাকরে পলাশি-উত্তর
সময়ে বাঙলার অন্যতম ক্ষমতার উত্স হয়ে ওঠেন।
হেস্টিংস যখন বেনারসের রাজা চৈত সিংএর দরবার লুঠ করছেন, তখন রাণীর সম্ভ্রম বাঁচিয়ে
কান্তবাবু অপরিমিত অলঙ্কার, রাণীর ব্যক্তিগত লক্ষ্মী-নারায়ণ মুর্তি, শালগ্রাম
শিলা, একমুখী রুদ্রাক্ষ, দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ এবং সনাতন ভারতে পুজ্য নানান ধরণের
দেবদেবী ও পূ্ণ্যবস্তু উপহারস্বরূপ সংগ্রহ করেন। অর্থ আর ইংরেজদের সঙ্গে সামাজিক
সঙ্গের জেরে তেলি সমাজ থেকে তিলি(তুলা =
ব্যবসায়ী)তে উন্নীত হন। কান্তবাবু সম্বন্ধে
সে সময়ের কলকাতার একটি ছড়া উল্লেখ করেছেন প্রমথনাথ মল্লিক, কলিকাতার কথায় – কান্তবাবু হয়ে কাবু, হাবুডুবু খায়, তুড়ুং লাগান হোক ক্লেভারিংএর
রায় / হেস্টিংস যাহার হাত, তারে করে কাবু, বাঙলার
হেন লোক আছে কেহ বাবু! তিনি বহরমপুরের দেওয়ান
কৃষ্ণকন্ত সেন নিমক মহলের সর্সের্বা ছিলেন, তাঁর সঙ্গে পার্থক্য করার জন্য প্রথমে
মুদি পরে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দাতব্য করে নন্দী উপাধিতে পরিচিত হন) জোড়াসাঁকোয়,
রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রর পূর্বপুরুষ পিতাম্বর মিত্র, মুনসি সদরুদ্দিন
মেছুয়াবাজার, বৈষ্ণবচরণ শেঠ, গৌরী সেনেরা বড়বাজার প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাস করা শুরু
করেন বড়মানুষ থেকে ভদ্রলোক হওয়ার আশায়। রামমোহন, দ্বারকানাথ, বিদ্যাসাগর, রাধাকান্তদেব প্রভৃতি
সকল গ্রামছাড়া ঐ আধুনিক মানুষের
কর্মস্থল ইংরেজ স্থাপিত কলকাতা।
No comments:
Post a Comment