১৭৬৫ সনের ১৮ই সেপ্টেম্বর ক্লাইব এবং তাহার
কৌন্সিলের মেম্বরগণ লবন তামাক ও গুবাকের বাণিজ্য সম্বন্ধে আর কয়েকটি কঠিন নিয়ম
প্রচার করিলেন, নবাবের লাভালাভ কিংবা প্রজাসাধারণের সুবিধার প্রতি একবার ভ্রমেও
দৃষ্টিপাত করিলেন না। কিন্তু পাছে ডিরেক্টরগণ এই নিয়ম না
মঞ্জুর করেন সেই আশংকায় এইরূপ বন্দোহস্ত করিলেন যে লবণ, তামাক, এবং গুবাকের বাণিজ্যে
বণিকসভার যে লাভ হইবে তাহাতে শতকরা পাঁচিশ টাকা হারে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পাইবেন
বাকী টাকা গবর্ণর কৌন্সিলের মেম্বর, সৈন্যাধ্যক্ষ এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির
সমুদায় ছোট-বড় সমুদায় কর্মচারীগণ স্বীয় স্বীয় পদমর্যাদা অনুসারে ভাগ করিয়া লইবেন।
এই বাণিজ্যের লাভ হইতে প্রায় কোন কর্মচারীই বঞ্চিত হইলেন না।
খ্রীষ্টধর্ম প্রচারার্থ যে দুইজন ধর্মযাজক(chaplains)
কলিকাতায় তত্কালে অবস্থান করিতেন তাঁহারাও কিছু কিছু পাইতেন।
লবণের বাণিজ্য এইরূপ একচেটিয়া করিবার
অব্যবহিত পূর্বে ক্যারাপিট আরাটুন নামক জনৈক আরমানিয়ান বণিক ত্রিশ হাজার মণ লবণ
গোলায় ক্রয় করিয়া তাঁহার দিনাজপুরস্থ গোলায় মজুদ রাখিয়া ছিলেন।
তিনি যখন শুনিতে পাইলেন যে, দেশের সমুদয় লবন ইংরেজরা ক্রয় করিয়া, পরে অত্যাধিক
মূল্যে দেশিয় বণিকদেগের নিকট বিক্রয় করিবেন বনিয়া স্থানে স্থানে নবাবের পরওয়ানা
জারি করাইয়াছেনব, তখন তাঁহার নিজের গোলার লবন বিক্রয় বন্ধ করিয়ে রাখিলেন।
তিনি মনে করিলেন যে এই নিয়ম প্রচারের পর লবণের মূল্য পাঁচগুণ বৃদ্ধি হইবে, সুতরাং
সেই মূল্যে বাজারে আপন লবন বিক্রয় করিয়া অন্তত এই বত্সরে কিছু লাভ করিতে পারিবেন,
মনে মনে এই সংকল্প করিয়া আরাটুন সাহেব স্বীয় গোম্তাকে লবনের গোলা বন্ধ করিয়া
রাখিতে আদেশ করিলেন. কিন্তু ইংরেজগণ তাহার গেলার নবণ আত্মসত্ করিবার অভিপ্রায়ে
নানানবিধ অবৈধ উপায় অবলম্বন করিতে লাগিলেন।
ত্রিশ হাজারমণ লবণ তাঁর গোলায় মজুদ রহিয়াছে. এখন একটাকা হারে মণ ক্রয় করিতে
পারিলেও বাঙালি বণিকদিগের নিকট পাঁচটারা হারে বিক্রয় করিয়া একলক্ষ বিশ হাজার টাকা
লাভ করিতে পারিবেন।
বণিকসভার বেরেলস্ট এবং সাইক সাহেব এই আরমানিয়ান
বণিকের লবন হস্তগত করিবার নিমিত্ত বিশেষ চেষ্টা করিতে লাগিলেন. অবশেষে তাংহাকে
দুইটাকা হারে প্রত্যেক মণের মূল্য দিতে স্বীকার করিলেন।
কিন্তু আরাটুন সাহেবে তাঁহার লবন দুই টাকা হারেও বিক্রয় করিতে সম্মত হইলেন না।
তকন ইংরাজগণ বল পূর্বক তাঁহার গোলা ভাঙিয়া সমুদয় লবণ হস্তগত করিবেন বলিয়া
কৃতসংকল্প হইলেন। বাণিজ্যে লাভ হইলেই হইল।
টাকা সঞ্চয় করাই তাঁহাদিগের একমাত্র খ্রিষ্টীয়ধর্ম।
বণিকসভার অধ্যক্ষ বেরেলস্ট এবং সাইক সাহেব আরাটুন সাহেবের গোলা ভাঙিয়া, তাঁহার
তাঁহার দিনাজপুরের গোলার লবণ হস্তগত করিবার নিমিত্ত লেপ্টেন্যান্ট ডবসনকে কয়েকজন
গোরা ও সিপাহীর সহিত দিনাজপুর প্রেরণ করিলেন।
ডবসন সাহেব দিনাজপুর পৌঁছিয়া আরাটুন সাহেবের লবণের গোলা ভাঙিয়া, তাঁহার সমুদয় লবণ
হস্তগত করিলেন। (চন্ডীচরণ সেনের নন্দকুমার ও শতবত্সর পূর্বের বঙ্গ
সমাজ থেকে)
বাঙলা থেকে
যে বিপুল পরিমান সম্পদ লুঠে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সমগ্র পলাশির শতাব্দটি থেকে, তাকে
মোদ্দাভাবে চার ভাগে ভাগ করছেন রজতকান্ত রায়(যদিও অন্যান্য লুঠ প্রক্রিয়াগুলি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। লুঠ সংক্রান্ত তৃতীয় পোস্টে সেগুলি বিশদে আলোচনা করা হয়েছে) – ১। ঘুষের
অর্থ, হিরে, জহরত, মণিমুক্তো নানান প্রক্রিয়ায় দেশে পাঠানো, ২।
ইওরোপ-ইংলন্ডে প্রায় বিনামূল্যে বাঙলার রপ্তানি পণ্য আর সোনা-রূপো পাঠানো, ৩। ইস্ট
ইন্ডিয়া কোম্পানির ওপর বিল অব এক্সচেঞ্জ, ৪। বাণিজ্যে অন্যান্য বিদেশি কোম্পানির
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পদাঙ্ক অনুসরণ। ইংরেজ ব্যবসায়ীরা তেল, নুন, আফিম,
আদা, চিনি, সুপারি, তামাক, ঘি, মাছ, শুঁটকি, খড়, চট, বাঁশ, কাঠেরমত তুচ্ছাতিতুচ্ছ
ব্যবসায় একচেটিয়া দখল কায়েম করল। এই দ্রব্যগুলোর একচেটিয়া ব্যবসা
সাধারণের জীবনে প্রভাব ফেলবে, এ তথ্য জানতে বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। দেশের
মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠল। পলাশির পর সত্তর বছর ধরে বাঙলার
বাণিজ্যে এত কমদামি মাল নিয়ে কারবার বাঙলার মানুষ এর আগে দেখেনি।
ক্রমে ক্রমে ইংরেজরা ধান চালের বাণিজ্যে হস্তক্ষেপ করতে
লাগল।
মির কাশেমের সময় বাঙলা জুড়ে অন্ততঃ পাঁচশো ইংরেজ কুঠি গজিয়ে উঠেছে। ইংরেজদের
সহায়তায় বাঙালি গোমস্তা, বেনিয়ান আর দেওয়ানরা কোম্পানির দস্তক দেখিয়ে অবাধ মুক্ত
বাণিজ্য চালাচ্ছে। ইংরেজদের লুঠতরাজের নেতৃত্বে যোগ্য
সঙ্গত প্রদান করছে। শুধু ইংলন্ডেই নয়, বাঙলায় ইংরেজরা
মুক্ত বাণিজ্যের দাবি করল। অবাধ, মুক্ত বাণিজ্য বলতে কোম্পানির
সহায়তায় সেনাবহর সঙ্গে নিয়ে ব্যবসায়ী আর ছোট উত্পাদক রায়তদের কাছ থেকে দাদনের নামে
সিকি দামে, অথবা পণ্যদ্রব্য লুঠ করে, ৫০০ শতাংশ দামে সেই দ্রব্য আবার রায়তদের
বিক্রি করত। এই ব্যবসায় বাঙালি আর ইংরেজরা কত অর্থ লুঠ করেছে তার
লেখাজোখা নেই।
১৭৬২র মে মাসে মির কাশেম ভ্যন্সিস্টার্টকে লিখছেন, এই হল আপনাদের ভদ্রলোকেদের ব্যবহার।
আমার দেশে সর্বত্র তারা উপদ্রব করে, জনগণের ওপর লুঠতরাজ চালায়, আমার কর্মচারীদের
অপমান জখম করে, প্রত্যেক গ্রাম পরগণা, ফ্যাক্টরিতে তারা লবন, সুপারি, ঘি, চাল,
খড়, বাঁশ, মাছ, চট, আদা, চিনি, তামাক, আফিম, ও অন্যান্য জিনিষ কেনা বেচা করে।
আমি আরও অনেক বস্তুর নাম করতে পারি অপ্রয়োজনে বিরত হলাম।
তারা বলপ্রয়োগ করে কৃষক বণিকদের পণ্য একচতুর্থাংশ দামে ছিনিয়ে নেয়, জবরদস্তি করে
কৃষককে এক টাকার জিনিষ পাঁচ টাকায় কিনতে বাধ্য করে। আবার পাঁচটি টাকার জন্য তারা এমন এক
মানুষকে অপমান ও আটক করে, যে একশ টাকা ভূমি রাজস্ব দেয়।
আমার কর্মচারীকে কর্তৃত্ব করতে দেয় না। প্রত্যেক শুল্ক থেকে বঞ্চিত হওয়ায়
আমার রাজস্ব ক্ষতির পরিমান দাঁড়াচ্ছে পঁচিশ লক্ষ টাকা।(পালাশির
ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ - পালাশির
ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ, রজতকান্ত
রায়) মির কাশেম দেখলেন দেশিয় বা ইংরেজ, কোনও ব্যবসায়ীই সরকারি মাশুল
দিচ্ছেনা। ঘোষণা করলেন ব্যবসায়ীদের আর শুল্ক দিতে হবে না। দস্তকও
দেখাতে হবে না।
ইংরেজ বণিকেরা রাতারাতি নবাব হওয়ার চেষ্টায় দেশটাকেই
শ্মশানে তোলার তোড় জোড় করছিল। অবাধ মুক্ত বাণিজ্যের একটি কথার কথা। ছুতো। ইংরেজদের
ভাষায় অবাধ বাণিজ্য নীতি হল, ইংরেজদের বাণিজ্যের হবে অবাধ, আর দেশি ব্যাপারীদের
বাণিজ্যের রেশ থাকবে ইংরেজদের হাতে। ইংরেজরা মির কাশেমের বকলমে এই
অদ্ভুত বাণিজ্য নীতি প্রয়োগ করতে গিয়ে দেখল তার শ্বশুরের তুলনায় মির কাশেম অতি
কড়া ধাতের মানুষ। মির কাশেম রুখে দাঁড়ানোয় পুরোনো কিছু জমিদারির
দেওয়ানরা, যেমন রাণী ভবানীর দেওয়ান দয়ারাম রায়, ইংরেজ ব্যবসায়ীদের কুঠির রেশম আটক
করেন।
বোয়ালিয়া কুঠির দ্রব্যও ছিল। ইংরেজদের ভয় হল দেশিয় বণিকদের ভয়
দেখিয়ে আর বল প্রয়োগ করে যে অবাধ ব্যবসার জাল ছড়িয়েছে ইংরেজ বণিকেরা, সেই জাল
সহজেই ছিঁড়ে যেতে পারে। পাটনা কুঠির ব্যবসাদার আর বড় সাহেব এলিস নবাবের ফৌজএর
ওপর চড়াও হলেন। যুদ্ধ শুরু হল। ইংরেজরা মির জাফরকে আবার নতুন করে
মুর্শিদাবাদের মসনদে বসাল, লক্ষ্য আরও লুঠের বহর বাড়ানো। নবাব
অযোধ্যায় পালিয়ে যাওয়ায় অবাধ লুঠের মাঠ উন্মুক্ত হয়ে গেল ইংরেজদের সামনে। লড়াইতে
বোয়ালিয়া কুঠির আটক দ্রব্য ছাড়তে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হল ইংরেজদের। ১৭৬৬তে এই
অভিজ্ঞতায় জমিদারদের নগদী সৈন্য বরখাস্ত করল ইংরেজরা। দেশের
অভ্যন্তরে পাঁচশোর বেশি বাণিজ্য কুঠি বানিয়ে গোমস্তি কারবারের, যে বাঙলাজোড়া
লুঠের ব্যবসা শুরু হল, তাতে দেশের সনাতন ব্যবসায়ীদের ব্যবসার মাজা ভেঙে গেল, তাঁরা
প্রতিবাদ করলেও প্রতিরোধ করতে পারলেন না। টিকে গেলেন ইংরেজদের তাঁবেদার
গেমস্তা, বেনিয়ান আর দেওয়ানদেরমত দালালচক্র। এরাই বাঙলার
নবজাগরণের অগ্রদূতরূপে পরিগণিত হবেন।
উইলিয়ম বোল্টস বলছেন ইংরেজদের আর কোম্পানি এজেন্টদের
শুধু আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যই অত্যাচারমূলক ছিলনা, রপ্তানির জন্য দ্রব্য কেনাও ছিল
অভিসন্ধিমূলক। অর্থনীতিবিদ বা ঐতিহাসিকেরা যদিও বলছেন কোম্পানির
ব্যবসায়ী বা উত্পাদকদের কাছ থেকে দ্রব্য কিনত, কিন্তু কেনাটা আদতে অভিনয়মাত্র, আদত
পদ্ধতিটা ছিল যথাসামান্য অর্থ ব্যয় করে লুঠ, না পারলে হুমকি। চন্ডীচরণ
যে আরাটুনের ঘটনা বলেছেন সেটি সর্বৈব বাস্তব। এদেশিয়
শহুরে বেনিয়ান গোমস্তাদের সহায়তায় আগে থেকেই কোম্পানি, বাঙলার উত্পাদকের ঘর থেকে
কত পরিমান দ্রব্য, কত দামে কিনবে তা ঠিক হয়ে যেত। গোমস্তা,
বেনিয়ান, দালাল আর পাইকারেরা তাঁতিদের আড়ংএ ডেকে পাঠাত। দাদন দিয়ে
পণ্য সরবরাহ চুক্তি করত কোম্পানি। কোম্পানির কাছ থেকে টাকা নিতে
অস্বীকার করলে তাদের বেত মারা হত। গোমস্তাদের খাতায় উত্পাদকদের নাম
লেখা থাকত। কখোনো আবার এক গোমস্তা থেকে আর এক গোমস্তার অধীনেও
চালান করা হত। তাঁতিরা চাহিদামত পণ্য তৈরিতে ব্যর্থ হলে তার সব পণ্য
আটকে বিক্রি করে সেই টাকা উশুল করত। দেশের কারিগরদের উত্পাদনের কাঠামো
ধংস করে ক্রমশঃ রেমশ ও সুতি বস্ত্র
ইংলন্ডে পাঠানো বন্ধ করে সুতো পাঠানোর জন্য তুলো চাষে বাধ্য করা হত চাষীদের
(সূত্রঃ সুপ্রকাশ রায়, ভারতের স্বাধীণতা
সংগ্রাম ও কৃষক বিদ্রোহ )।
পলাশি উত্তরকালে সুসভ্য
ব্যবসায়ী শাসক ইংরেজদের অবাধ এই বাণিজ্যের লুঠতরাজী দেখানো পথে, দ্বিতীয়
সহস্রাব্দের বিশ্বায়ণের মহাভাগে সুসভ্য
গণতান্ত্রিক ইওরোপিয়-আমেরিকীয় ব্যবসায়ী আর তাদের দেশিয় ব্যবসায়ী ফড়েরা
বিশ্বের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন দেশিয় সম্পদ লুঠের রাজত্ব কীভাবে তৈরি করতে হয়। দেশগুলির ধণসম্পদ প্রাকৃতিক সম্পদ অভিধা দিয়ে, ইস্ট
ইন্ডিয়া কোম্পানির দেখানো পথে, সরকার-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলিকে
পাশ কাটিয়ে অবাধে লুণ্ঠন করার কাজ শুরু হয়েছে। দেশের জনগোষ্ঠীগুলো হাজার হাজার বছর ধরে এই সম্পদগুলির
রক্ষণাবেক্ষণ করে এসেছে। এশিয়া, আমেরিকা বা
আফ্রিকার সনাতন সমাজের হাজার হাজার বছরের বিকশিত মেধা ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সম্পদ,
জ্ঞাণ, ভাবনা অপহরণ করে, তার ওপর আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব আইন প্রয়োগ করে, তথাকথিত
তৃতীয় বিশ্বের অবশ্য বধ্য জনগণের রায়ে গঠিত অবোধ
সরকারগুলোকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে বিশ্বজোড়া আবাধ বাণিজ্য বিস্তার করে অগাধ লাভ করেছে
ব্রিটেন।
No comments:
Post a Comment