সুশীল চৌধুরী
মধ্যযুগ
বাংলা থেকে পর্তুগিজ কোম্পানি বিপুল সংখ্যক পণ্য বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য নিয়ে
যেত যেমন সুতি বস্ত্র, ঘাসের তৈরি গিনঘ্যাম, বিভিন্ন রঙের রেশম, চিনি, চাল, ঘি,
নীল, লম্বা লঙ্কা, সোরা, মোম, গালা, এবং অন্যান্য পণ্যদ্রব্য সামগ্রী যা বাংলায়
বিপুল পরিমানে উৎপাদন হত। ভারত এবং ইস্ট ইন্ডিজের দেশগুলিতে মূল রপ্তানি ছিল চাল।
পাইরাড দ্য লাভাল দেখেছেন, যখন বাংলার জাহাজ নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছত না বা জাহাজ
ডুবি হত, সে সময় চাল সুমাত্রা মলুক্কাসের মত অঞ্চলগুলোয় অত্যন্ত মহার্ঘ হত এবং
মন্বন্তরের আশঙ্কা ছেয়ে যেত জনগনের মধ্যে।
পর্তুগিজদের ব্যবসার পরিমান কত ছিল? তারা আড়াই শতাংশ হারে যে চুঙ্গি শুল্ক দিত
পণ্যের রপ্তানির জন্য তার পরিমান ছিল ১ লক্ষ টাকা বাৎসরিক। এই হিসেবে মোটামুটি ৪০
লক্ষ টাকার বাৎসরিক ব্যবসা ছিল পর্তুগিজদের বাংলার ব্যবসায়। এই ব্যবসায় যেহেতু
বিপুল লাভ ছিল, তার গোটা উপকূল এবং বৈদেশিক ব্যবসা পর্তুগিজেরা প্রায় একচেটিয়া করে
নেয় এবং দেশিয় বাণিজ্যেও দেশিয় এবং অন্যান্য বিদেশিয় বণিকদের টক্কর দিতে থাকে। কিন্তু(আকবরের
সাম্রাজ্ঞী মারিয়ুজ্জামানির বা হীরাবাঈএর বাণিজ্য জাহাজ রহিমি ধ্বংস করে দেওয়ায় জাহাঙ্গির
তার মায়ের অপমানের বিরুদ্ধে পর্তুগিজদের দমন ছাড়া করেন। টুকটাক বিরোধ চলছিল, কিন্তু
এটাই পর্তুগিজদের সঙ্গে মুঘলদের সর্বপ্রথম বড়সড় বিবাদ এবং সেই বিবাদের জের ছড়িয়ে পড়ে
মুঘল সাম্রাজ্যের পরবর্তী প্রজন্মে) শাহজাহান পাদশা বাংলার নবাব কাশিম খাঁকে(যার
নামে কাশিমবাজার) নির্দেশ দেন হুগলি ছাড়া করতে এবং পর্তুগিজেদের বাংলা স্বপ্নের
চিরতরে সমাধি ঘটল(এবং ডাচ আর ব্রিটিশদের উত্থান সহজ হল)।
ডাচ আর ব্রিটিশদেরসপ্তদস শতের মাঝামাঝি থেকে বাংলায় ব্যবসা শুরু করে হুগলিতে
কুঠি তৈরি করে। আরও পরে ১৬৮০র দিকে ফরাসীরা বাংলায় আসে। ইওরোপিয়দের মধ্যে
অস্ট্রিয়া/জার্মান( the ostend
company) এবং ড্যানিশ
সওদাগরি কোম্পানি অষ্টাদশ শতকের প্রথমের দিকে আসে, এবং তারা খুব বেশি পরিমানে
ব্যবসা করতে পারে নি। ইওরোপিয়দের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার
দ্বীপপুঞ্জ থেকে মশলা কিনে ইওরোপে বিক্রি করা। তারা সেই অঞ্চলে গেল নতুন
বিশ্ব(আমেরিকা) থেকে লুঠ করে আনা রূপোর বিনিময়ে মশলা কিনতে। অবাক হয়ে দেখল সে সব
দেশে রূপোর চাহিদা বিন্দুমাত্র নেই বরং ভারতীয় মোটা কাপড় সেখানে বিপুল আভিজাত্য
হিসেবে বিক্রি হয়। তারা ভারতের দিকে জাহাজ ঘুরিয়ে নিয়ে আসে মোটা কাপড় কেনার জন্যে।
পরিকল্পনা ভারতের কাপড়ের বিনিময়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলি থেকে মশলা বিনিময়
করবে ধুলিদরে। প্রথমে তারা করমণ্ডল উপকূলে যায়, সেখানকার কাপড়ের বিপুল চাহিদা ছিল
দক্ষিনপুর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে। কিন্তু কিছু দিন পরে দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধের প্রকোপে
আর রাজনৈতিক অস্থিরতায় করমণ্ডল উপকূলে ব্যবসা করা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে
কোম্পানিগুলি বাংলার দিকে নজর দিল।
বাংলায় তাদের বিপুল বৈচিত্রের কাপড় জোগাড় করার সুযোগ করে দিল। বাংলায় যেমন
বিপুল পরিমানে মোটা কাপড় তৈরি হত – যার গুণমান অন্য অঞ্চলের কাপড়ের তুলনায় ভাল এবং
দামেও শস্তা, তেমনি যথেষ্ট পরিমানে সূক্ষ্ম কাপড়ও উৎপাদন হত। দ্বিতীয়ত বাংলার রেশম
তাদের ক্ষেত্রে বিপুল লাভের বাজার খুলে দিল ইওরোপে। এবং দিনের পর দিন ইওরোপে
বাংলার রেশমের চাহিদা বাড়তে থাকে। পারসি আর ইতালিয় রেশমকে বিশ্ববাজারে পিছনে ফেলে দিল
বাংলার কাশিমবাজারের রেশম – দাম আর গুণপনায়। এছাড়াও বাংলা সুবার পাটনার সরকার
সারণে বিপুল পরিমানে সোরা উৎপাদন হত। এটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইওরোপে বিপুল চাহিদাসম্পন্ন
পণ্য ছিল আর ইওরোপে পণ্য বহন করে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটি জাহাজ ভারি করার কাজে
লাগত।ফলে কোম্পানিগুলি বাংলায় জাঁকিয়ে ব্যবসা করতে শুরু করল।
No comments:
Post a Comment