রণবীর চক্রবর্তী
বাণিজ্য পথ – আমরা আগেই জেনেছি যে বাণিজ্য বাংলার ভৌগোলিক অবস্থা, বিশ্ববাণিজ্যে
তাকে নানান সুবিধার দেশ হিসেবে প্রতিপন্ন করেছিল। রাজমহল পেরিয়ে পুণ্ড্রবর্ধন
মধ্যগঙ্গার উপত্যকার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। ফলে পুণ্ড্রবর্ধন বাংলার প্রথম এলাকা
তৃতীয় চতুর্থ খ্রিপূর্বশতে যেখানে সর্বপ্রথম শহরীকরণ ঘটছিল, ফলে নর্দান ব্ল্যাক
পলিশড ওয়ার – কালো চকচকে তৈজস পাওয়া গিয়েছিল – এই দুটি উদাহরণ(শহরীকরণ ও কালো তৈজস)
থেকে প্রমান হয় মধ্যগঙ্গা উপত্যকার সঙ্গে সমুদ্র বানিজ্যের যোগ ছিল।
প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে বিভিন্ন খরোষ্টি ও ব্রাহ্মী-খরোষ্টি লিপি থেকে এই
অঞ্চল যে দীর্ঘকাল ধরে বিশ্ববাণিজ্যের সংগে যুক্ত ছিল, এই তথ্য আমরা এ সম্বন্ধে
বিস্তারিত তথ্য পেয়ে থাকি। খরোষ্টি সাধারণত উপমহাদেশের উত্তরপশ্চিম এলাকায় ব্যবহৃত
ভাষা। ফলে আজকের পশ্চিম বাংলায় যদি খরোষ্টি পাওয়া যায়, তাহলে এই তথ্য প্রমান হয় যে
এই সহস্রাব্দের প্রথম পাদে গাঙ্গেয় বদ্বীপ বাংলার সঙ্গে উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ
ছিল। এটাও সাধারণত পরিষ্কার হয়ে যায় যে বাংলার বদ্বীপ অঞ্চল মধ্যগঙ্গা উপত্যকা
মার্ফত এই যোগাযোগ রাখত – কারণ উত্তরপ্রদেশের বেনারসের চুনারে এবং কুমারাহরে
খরোষ্টি লিপি পাওয়া গিয়েছে। শ্রীচম্পা (পূর্ববিহারের ভাগলপুর) দেশের নাম প্রথম
কণিষ্কর রবতক শিলালিপিতে পাওয়া গিয়েছে। হয়ত উত্তরপশ্চিম প্রদেশ থেকে মধ্যগঙ্গা
উপত্যকা হয়ে বদ্বীপবাংলার দিকে তার সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটছিল – তাই এই অঞ্চল খুঁড়ে
খরোষ্টি লিপি পাওয়া গিয়েছে। এই কৃষ্টিগত আদানপ্রদান বাণিজ্যিক যোগাযোগেও বিস্তৃত
হয়েছিল, মনে রাখতে হবে মধ্য এশিয়ার বাংলায় যুদ্ধ ঘোড়া এই অঞ্চল হয়েই ভারতে ঢুকত।
এর পরের শতাব্দেও গঙ্গার উপকূলভূমির সঙ্গে গঙ্গার বদ্বীপের যোগাযোগ আরও ঘনিষ্ঠভাবে
বাড়তে থাকে। মগধ থেকে তাম্রলিপ্তি পর্যন্ত ফাহিয়েনের নিরুপদ্রব যাত্রা এই তথ্য
প্রমান করে। বাংলায় হিউএনসাংএর দিনলিপিও এই সূত্রকে প্রমান করে। তিনি নালন্দা থেকে
যাত্রা শুরু করে রাজমহল পাহাড় হয়ে কজঙ্গলে পৌঁছান। এখান থেকে তিনি পুণ্ড্রবর্ধন
হয়ে কামরূপের দিকে এগিয়ে যান। কামরূপ হয়ে তিনি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ধরে তিনি সমতটে
নেমে আসেন। সেখান থেকে তিনি তাম্রলিপ্তির দিকে রওনা হয়ে যান। তাম্রলিপ্তি থেকে
উত্তরদিকে রওনা হয়ে শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণে পৌঁছন।
তার উপমহাদেশের তীর্থযাত্রা তাকে শেষাশেষি ওড্র বা ওডিসার দিকে নিয়ে যায়।
আমাদের ধারণা কর্ণসুবর্ণ, আজকের রাঢের কাণসোনা থেকে তার ওড্রদেশে যাওয়ার পথ ছিল
দণ্ডভুক্তি(আজকের মেদিনীপুরের দাঁতন) মার্ফত। তাঁর গতায়াতে একটা বিষয় প্রমান হয় যে
বাংলার বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে বিভিন্ন এলাকার যোগাযোগের সুগম পথ ছিল। এ প্রসঙ্গে
মগধ, কামরূপ আর ওড্রের সঙ্গে বাংলার স্থলপথের যোগাযোগের বিষয়টি আগামী প্রসঙ্গ
আলোচনায় পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা। অষ্টম শতে তিন শ্রেষ্ঠী পুত্র অযোধ্যা থেকে
তাম্রলিপ্তির দিকে যাত্রা করে। তাদের এই যাত্রার বিবরণ দুধপাণি শিলালেখ থেকে
মোটামুটি বিশদে পাওয়া যায়। তারা অযোধ্যা থেকে শুরু করে মধ্যগঙ্গা উপত্যকার
হাজারিবাগ হয়ে আসেন। দেবপালের সময়ের ঘোষরওয়াঁ শিলালিপি থেকে আরও একটা উদাহরণ
পাচ্ছি যে সীমান্তের নগরহার(আজকের জালালাবাদ) থেকে মহাবোধি পর্যন্ত এসেছিলেন
বিরধরদেব। এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করার যে বিরধরদেব নালন্দায় এসে তাঁর
দেশের নানান মানুষকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন। এর থেকে কয়েকটা জিনিস পরিষ্কার হচ্ছে যে
দক্ষিণ বিহারের সঙ্গে নবম শতেই উপমহাদেশের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে নিয়মিত
যোগাযোগের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। উত্তরাপথ থেকে বাংলায় নিয়মিত ঘোড়া ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি
এই তথ্যই প্রমান করে যে এই দুই এলাকার সঙ্গে বাংলার ব্যবসায়িক লেনদেন গড়ে উঠেছিল। করমণ্ডল
উপকূল হয়ে বঙ্গোপসাগরের তীর ধরে উপকূল বাংলায় যে পৌঁছান যায় তার সর্বশ্রেষ্ঠ
প্রমান রাজেন্দ্রদেব চোলের গাঙ্গেয় লিপিতে(১০২২-২৩ খ্রি) উতকীর্ণ তন্ডভুক্তি(দণ্ডভুক্তি),
তক্ষণলাধম(দক্ষিণ রাঢ), উত্তীরালাধম(উত্তররাঢ) এবং বঙ্গলদেশ(বঙ্গের দিক্ষিণ এবং
উপকূলভূমি) নামগুলি থেকে। রাজেন্দ্র চোলের বাহিনী অন্ধ্র, ওডিসা উপইকূলভূমি হয়ে
মেদিনীপুর জেলা ধরে বাংলায় প্রবেশ করে। সপ্তম শতে হিউএনসাংএর যাত্রায় বাংলায় সঙ্গে
করমণ্ডল উপকূলের যোগাযোগের প্রমান আমরা দেখেছিলাম। পাল-সেন আমলে বহুবার উল্লিখিত
গমগমিকা(গতায়াতের উপরে নজর রাখা) বা শৌলকিকা(শুল্ক আদায়ের কাজে নিযুক্ত) নামক
অমাত্য(সরকারি আধিকারিক) পদগুলির বর্ণনা থেকে আমরা বুঝতে পারি সে সময়ে বাংলার
বাণিজ্য প্রচেষ্টার সঙ্গে উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকার যোগ ছিল।
No comments:
Post a Comment