রণবীর চক্রবর্তী
বাংলা সুদূর অতীত
থেকেই এশিয় বাংলা-বাণিজ্যের কেন্দ্রে অবস্থিত ছিল। ব্যবসা তার স্বচ্ছলতার সূত্র। নদীমাতৃক
দেশ হওয়ার সুবাদে নদীজাল নির্ভর করে আন্তঃদেশিয় এবং বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থানের
আন্তর্জাতিক সমুদ্র নির্ভর ব্যবসা ও সওদাগরি বাণিজ্যের তথ্য পাচ্ছি দ্বিতীয়
খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকেই। এই আলোচনা আমরা দুটি অংশে ভাগ করব।
প্রাচীন পর্ব- প্রাচীন
বাংলা বলতে অতীত বাংলার প্রাচীন চারটি বিভাগ পুণ্ড্রবর্ধন, রাঢ, বঙ্গ এবং
সমতট-হরিকেল এবং আজকের সীমান্তের দুপাশের বাংলা কথা বলব যার সঙ্গে জুড়ে ছিল বিহার,
ওডিসা। বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান দেশিয় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পক্ষে অনুকূল ছিল।
উপকূল অঞ্চলে গঙ্গার বদ্বীপ, এবং উত্তরসীমান্তে হিমালয় নিয়ে যে বাংলা সেটি আসলে একমাত্র
ভারতীয় অঞ্চল, যাকে আসমুদ্রহিমাচলরূপে বর্ণনা করা যায়। মধ্য গঙ্গার সমতলভুমি এবং
বিস্তৃত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা বাংলা জুড়ে নদীজালে আন্তঃবাণিজ্য চলত, আর বিশ্বের সব
থেকে সব থেকে বড় বদ্বীপ, গঙ্গার বদ্বীপ অঞ্চল দিয়ে ভূমি ঘেরা গাঙ্গেয় অঞ্চলের
বাণিজ্য পণ্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দ্বারে পৌঁছে যেত।
আগে যে চারটি
অঞ্চলের কথা উল্লেখ করা গিয়েছে, সেগুলি কোন এক রাজতন্ত্রের অধীনে একত্রীভূত না
হওয়ায় রাজনৈতিকভাবে এই অঞ্চলে অসমান রাজনৈতিক বৈষম্য দ্যাখা দিয়েছে। এই অঞ্চলের
সামাজিক, আর্থিক এবং কৃষ্টিগত ইতিহাসের মধ্যে যেমন কোন সমতা নেই, তেমনি সেগুলির
বিকাশ সরলরৈখিকও নয়। অন্য ভাষায় বাংলার বাণিজ্য উদ্যমে এই অঞ্চলগুলির সমাজ, রাজনৈতিক
এবং কৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য প্রভূত প্রভাব ফেলেছে।
বাংলার প্রাচীন
যুগের বাণিজ্যকে এই উপমহাদেশের বাণিজ্যের প্রেক্ষিতেই বিচার করতে হবে। বাংলার মূল স্বচ্ছলতা
ছিল কৃষি উৎপাদন ভিত্তিক। অর্থশাস্ত্রে বর্ত্তর(বৃত্তি বিষয়ক জ্ঞানচর্চা) মধ্যে
কৃষি আর বাণিজ্য ছিল। পালিতে লিখিত মজঝ নিকায়তে বলা হয়েছে কৃষ্টি তুলনায় বাণিজ্যে
লাভ বেশি। অঙ্গুত্তর নিকায়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে ব্যবসায় বিপুল লাভের কথা। পঞ্চম
শতাব্দের বৈয়াকরণিক পাণিনীর লেখায় ব্যবহার বা ব্যবসা সূত্রে ক্রয়-বিক্রয়ের শব্দ
দুটির উল্লেখ পাই। অতীত বাংলার ব্যবসার উল্লেখ পেতে আমাদের নির্ভর করতে হয় দেশিয়
সাহিত্যের ওপর( normative এবং
creative) এবং বৈদেশিক ভ্রমনকারীদের
লেখনি(ধ্রুপদী, চিনা, আরবি, পারসিক, ইওরোপিয়), শিলালেখ, মুদ্রা এবং বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক
উৎখনন এলাকা থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদির ওপর। বিভিন্ন উৎসের সূত্র থেকে ষষ্ঠ খ্রিষ্টপূর্ব
সময় থেকে বাংলার ব্যবসা বাণিজ্যমর্ম জানতে সাহায্য করে। আমরাও সেই সময় থেকেই
আলোচনা শুরু করব। এই তথ্যগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এবং ব্যপ্ত, কিন্তু বিপুল আলোচনার
জন্য যথেষ্ট নয়, এবং কোন সংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্য পাওয়া যায় না বলেই আমাদের গুণগত
উপাত্তের ওপর নির্ভর করতে হয়।
আবারও বলি বাংলার
বিভিন্ন অঞ্চলের যে রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থা তার সঙ্গে সর্ভভারতীয় এমনকি
উত্তরভারতীয় বাস্তবতার কোন মিল ছিল না। উত্তর এবং উত্তর পশ্চিম এলাকায় যখন ২৫০০
থেকে ১৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে শহরীকরণের প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি, বাংলায় কিন্তু তার
প্রভাব খুব সামান্যই। ষষ্ঠ খ্রিপূর আশেপাশের সময় থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকায় যখন বেশ
কিছু পরিমানে শহর তৈরির কাজ হয়ে মহাজনিপদের বিকাশ ঘটছে, তখন বাংলা নিরুত্তাপ। মনে
রাখা দরকার, sedentary agriculture (কৃষিবাণিজ্য?), বৈচিত্রময় কারিগরি ও বাণিজ্য কিন্তু
চতুর্থ খ্রিপূর্বাব্দে মৌর্য সাম্রাজ্যের আগে উদ্ভব হয় নি। মনে হয় গাঙ্গেয়
উপত্যকায় মগধ সাম্রাজ্যের বিকাশে material
culture এর বিকাশ ঘটছিল, তার
প্রভাবে বাংলায় কৃষি, বৈচিত্র্যময় কারিগরি ও বাণিজ্যের বিকাশ ঘটে বিভিন্ন শহর
কেন্দ্রে।
পণ্যাদি – কৃষিকর্ম
দিয়েই এই আলোচনা শুরু করি। তৃতীয় খ্রিপূর প্যালিওজিওগ্রাফির হিসেবে আর মহাস্থানের
শিলালেখ সূত্র পুণ্ড্রবর্ধনের ধান আর তিলের বর্ণনা পাচ্ছি। এটা উল্লেখ যে এই
দুধরণের শস্য পুণ্ড্রনগর বা আজকের বোগরার মহাস্থানের শস্যাধার(কোষ্ঠাগার)এ রাখা
হত। এটি বাংলার অন্যতম প্রাচীন শহর এবং শষ্যগুলি শহরের অধিবাসীদের ত্রাণ(আত্যয়িক)
বিতরণের জন্য রাখা ছিল। আদতে যে কোন ধরণের ত্রাণের জন্য এই পণ্যগুলি জমিয়ে রাখা হত।
অর্থশাস্ত্রে এই ধরণের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর গোলা তৈরি করার জন্য পণ্যাধ্যক্ষ
পদের উল্লেখ রয়েছে; তাদের দায়ত্ব ছিল বিভিন্ন আপৎকালে এই শস্যগুলির বিতরণ। এই
সূত্রে বলতে পারি উত্তরবঙ্গে বিভিন্ন শস্যের হয় বেশ কিছু উদ্বৃত্ত তৈরি হত, যার
একটা অংশ এই ধরণের গোলায় মজুদ রাখা হত। আন্দজ করা যেতে পারে শস্য ব্যবসায় সরকারকে
নিযুক্ত থাকতে হত। কিন্তু অন্য কোন সূত্রে সরকারের পক্ষে সরাসরিভাবে শস্য ব্যবসায়
অংশগ্রহনের কোনো রকম উল্লেখ পাচ্ছি না।
No comments:
Post a Comment