গ্রামে ছোট উত্পাদকের সংখ্যা কমিয়ে আনার প্রকল্প শুরু করেছে অল ইন্ডিয়া আর্টিজান এন্ড ক্রাফ্টওয়র্কার্স ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন। পেছনে ফ্যাব ইন্ডিয়ার প্রাক্তন প্রধান উইলিয়ম বিসল, ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর জেনারেল রতি বিনয় ঝা, দস্তকরের প্রধান লয়লা তয়বজী প্রমুখ। সংঘজুড়ে আছেন বিদেশে পড়াশোনা করে আসা যুবা, কর্পোরেটিয় কেষ্টুবিষ্টু আর ভারতের ব্যবসায়ী দালালেরা। সাহায্য আসছে ফোর্ড ফাউন্ডেশন, ইওরোপিয়ান ইউনিয়ন, ইবে ফাউন্ডেশন, ফ্যাবইন্ডিয়া, দোরাবজী টাটা ট্রাস্ট, দুর্ণীতিতে ডুবে থাকা রয়েল ব্যাঙ্ক অব স্কটল্যান্ডএরমত কর্পোরেট দাতাদের থেকে। শুরু হয়েছে ক্রাফ্টমার্ক প্রকল্প। কর্পোরেট স্বেচ্ছাব্রতীরা বড় পুঁজির স্বার্থ দেখে। টাকার বিনিময়ে সংঘের সইতে গ্রামশিল্পীদের ভবিষ্যত তৈরি হচ্ছে। এটি সরকারি প্রকল্প নয়। সামাজিক দায়বদ্ধতাও নেই। অর্থবলে আর ক্ষমতার অলিন্দে ঘোরাফেরা করা এই সংঘটি প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে সরকারগুলোকে। গ্রামশিল্পীদের উচ্ছেদ হওয়ার আশংকা বাড়ছে।
কারুশিল্পী সাহায্যের নামে চলছে একচেটিয়া ফাটকা পুঁজির অবাধে ঢোকার পরিবেশ তৈরি। আগামীতে গ্রামশিল্পীরা আর মাগনায় সরকারি মেলায় যায়গা পাবে না। জনগণের অর্থে তৈরি সরকারি হাট চলে যাচ্ছে শিল্প দালাল আর কর্পোরেটদের হাতে। সংঘের শিল্পীরা বুঝছেন সরকার-বেসরকারি উদ্যোগে তাদের সামাজিক অধিকার নষ্ট হতে বসেছে। একজোট হওয়া ছাড়া অন্য উপায় নেই।
গ্রামীণ উত্পাদকেদের সঙ্গে পথ ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক বহু পুরোনো। পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগরের ঠিকরায় চন্দনপুর গ্রামের কাঁসা-পেতল বৃহত বাঙলার প্রখ্যাত শিল্পককর্মগুলোর মধ্যে অন্যতম। রাণা, মহারাণা পদবীর শিল্পীরা সুদূর অতীত থেকেই পাইকারদের শিল্পদ্রব্য দিতেন। চন্দনপুরের উতপাদকেদের বন্ধু ছিলেন খুচরো বিক্রেতা সমাজ। তাঁরা ঝাঁকা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ওড়িশা, বিহার, অসমের গাঁয়ে গাঁয়ে। কর্জ মেটাতেন কিছুটা টাকায়, কিছুটা অন্য পণ্যে। ভারতজুড়ে খুচরো ব্যবসায়ীরা বংশ পরম্পরায় আজও গ্রামীণ উত্পাদন বিক্রি করেন বিভিন্ন হাট, মেলা, উত্সব, পরব, পুজো, বাড়ির দরজায় পৌঁছে। বাণভট্টের হর্ষচরিতে উজ্জয়ণীর হোলি উত্সবে পথের দোকানের বর্ণনা রয়েছে, অস্থায়ী পথ দোকানদারদেরও উল্লেখ আছে। নির্ভরতাবোধ ছিল নানান সেবা দেওয়া সমাজ, উত্পাদক আর পণ্য বিক্রেতাদের মধ্যে। ইংরেজদের আগের শহরের প্রশাসনও এই অর্থনীতিকে বিকাশের পথ হিসেবে দেখতেন।
এই উতপাদন-বিক্রয়ের চক্র ধংস করা হল স্বাধীণতার পর। রাজ্যের সীমান্তে ঝাঁকাওয়ালাদের কাগজপত্রদেখতে চাওয়া হয়, হিসেব চাওয়া হয়, নানানভাবে হেনস্থা করা হয়। বাধ্যহয়ে বহু পথ ব্যবসায়ী পেশা ছাড়ছেন। গ্রামের উত্পাদক ব্যবসায়ীদের অধিকাংশ শহুরে ভাষায় নিরক্ষর(শহুরে ইংরেজি শিক্ষিতরা অশিক্ষিত শব্দটি কেটেকেটে উচ্চারণ করেন)। কাগজ না থাকলেই হয় জরিমানা, নয় পণ্য বাজেয়াপ্তি। যে সমাজে মুখের কথাই ছিল হাজার কাগজের সামিল, সে সমাজকে ধংস করে নতুন শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হল। ওরাল হিস্ট্রি চর্চা গবেষণাতেই শেষ। ইতিহাস রাষ্ট্রনীতি নয়। অশিক্ষিত ফেরিওয়ালার ট্যাঁকে কাগজ না থাকলে সব ইতিহাস সব সামাজিক সম্পর্ক মিথ্যে। আর জণকল্যাণমুখী রাষ্ট্র এতসব জানতে চাইবেইবা কেন! বড় ব্যবসা-উতপাদকই-পুঁজি একমাত্র সত্যি আর সবাই অসংগঠিত। রাষ্ট্রদ্বারা বধ্য, নইলে নিয়ন্ত্রণযোগ্য। উত্পাদক-ফেরিওয়ালারা বলছেন ভিক্ষে চাই না মা, কুকুর সামলাও। গ্রামীণ উত্পাদকেদের বিক্রি কমছে, গ্রামের অর্থনীতি মারাযাচ্ছে। রাষ্ট্রের মদতে লুঠ হয়ে যাওয়া গ্রামের বাজার দখল করছে বড় পুঁজি। কার মাথাব্যথা! হয়ত সেইটাই লক্ষ্য।
No comments:
Post a Comment