বাংলায় ১৭৫৬-৫৭য় চলা ব্রিটিশ-নবাব দ্বন্দ্বকে
বুঝতে গেলে আমাদের দুর্গ তৈরি আর দস্তক ব্যবহারের দুর্নীতির বিষয় আলোচনার বাইরেও
বেরোতে হবে। ব্রিটিশ-নবাব দ্বন্দ্ব সম্পর্কিত এই গোলযোগকে আরও ভালোভাবে বোঝা যায়
যদি কোমপানির ব্যবসা আর ব্রিটিশ ব্যক্তিগত ব্যবসাকে আমরা নবাবি প্রশাসন এবং ফোর্ট
উইলিয়াম কাউন্সিলের মধ্যের নাজুক সম্পর্কর ভিত্তিতে দেখার চেষ্টা করি। ব্রিটিশেরা
কলকাতায় বাস শুরু করার পর কলকাতা কোম্পানি আর তার আমলাদের ব্যক্তিগত আন্তঃএশিয়
ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠল। কলকাতা ১৭২০র মাঝামাঝি থেকে শুরু করে মধ্য ১৭৩০
পর্যন্ত ব্রিটিশ আমলাদের ব্যক্তিগত ব্যবসার স্বর্ণালী সময়। কিছু প্রাসঙ্গিক চলকের
প্রভাব ব্রিটিশ ব্যবসার সহায়ক হয়ে ওঠে। যে বাজারে তারা ব্যবসা করত, সেটা
তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল এবং তারা নির্ভর করত কলকাতা, বম্বে, মাদ্রাজের এক ঝাঁক
ব্যক্তিগত ঋণদান ব্যঙ্কার আর এশিয় ব্যবসায়িক সংগঠনের ওপর। তিনটি প্রেসিডেন্সির
কোম্পানি আমলাদের মধ্যে গভীর বোঝাপড়া ছিল, তাদের ব্যবসায়ীক সংগঠন এবং অংশিদারিত্ব
আর অভিজ্ঞতা ব্যবসার পরিমান বাড়াতে সহায়ক হয়েছে। এছাড়াও ডাচ ও ফরাসী ব্যবসায়ীদের
উচ্চ ৫০% লাভের বিপরীতে ব্রিটিশ ব্যক্তিগত ব্যবসায়িকরা প্রত্যেক সমুদ্রযাত্রায় মাত্র
২০% লাভ রেখে মালপত্র ছেড়ে দিতেন। এছাড়াও কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তক আর ফরমানের
আড়াল নিয়ে বিভিন্ন বন্দরে, এশিয় বণিকদের তুলনায় অনেক শস্তায় ব্যবসা করতে পারত।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, ১৭৪০ সালে হুগলির আরমেনিয় ব্যবসায়ি খ্বাজা ওয়াজিদ ফরাসী
পতাকা তুলে বসরার উদ্দেশ্যে জাহাজ ছাড়েন তার একটাই কারণ সেখানে ফরাসীরা ৩ শতাংশ
শুল্ক দিত আর এশিয়রা দিত ৬ শতাংশ শুল্ক।
কিন্তু কলকাতা থেকে ব্রিটিশ ব্যক্তিগত ব্যবসা
১৭৩০এর পরে দ্রুত কমতে শুরু করে। আর চন্দননগরের উৎসাহী ফরাসী নেতৃত্ব আর ব্যক্তিগত
ব্যবসায়ীরা ডুপ্লের নেতৃত্বে বিপুল উদ্যমে ব্যবসা করতে শুরু করলে ১৭৪০এর পরে ব্রিটিশ
ব্যক্তিগত ব্যবসা চরম দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে থাকে। মধ্য ১৭৩০ থেকে চন্দননগরের
ফরাসী কর্তৃপক্ষ ১৭২০র পরের খাদে পড়া ব্যবসা টেনে তুলতে শুরু করে এবং তার ব্রিটিশ
ব্যবসার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। প্রাথমিকভাবে ফরাসী আমলাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা নিষিদ্ধ
থাকলেও ১৭২২এর পরে তাদের সেই সুযোগ করে দেওয়া হয়। ফলে ক্রমশঃ তারা ব্রিটিশ
ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে শুরু করে। ডুপ্লে নিজে সরাসরি
আন্তঃএশিয় ব্যক্তিগত ব্যবসায় যোগ দেওয়ায় এবং ফরাসী ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের উৎসাহ
দেওয়ায় ফরাসী ব্যবসা উদ্যম বিপুল বেড়ে যায়। চন্দননগরে ডুপ্লের প্রাথমিক উদ্যম
রাজনৈতিক ছিল না, ছিল ব্যবসায়িক। ১৭৩১ সাল থেকে ১৭৪২ পর্যন্ত ডুপ্লে অন্তত ৯০টা
সমুদ্র যাত্রা আয়োজন করেছে। সে যে ধরণের জাহাজের চরিত্র বেছেছে, তা Holden Furber(John
Company)এর তত্ত্ব অনুযায়ী সে সময়ের ভারতীয় এশিয় ব্যবসার ট্রন্ড
অনুযায়ী মূলতঃ পূর্ব-পশ্চিম দিকমুখী।
বাংলার এশিয়
ব্যবসায় ফরাসিরা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ অংশিদার হয়ে উঠছে ব্রিটিশদের তুলনায়, সেটা
মোটেই ব্রিটিশদের পছন্দের বিষয় ছিল না। ফলে ব্রিটিশ-ফরাসী ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব
বাড়তে থাকল। ১৭৪০এর প্রথমের দিকে বাংলায় ব্রিটিশদের প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে
উঠতে থাকে। এই দ্বন্দ্বটির মূল সূত্রটি আমি উল্লেখ করেছি ১১.১ তালিকায় যেখানে আমরা
বাংলা থেকে ছাড়া ব্রিটিশ-ফরাসি জাহাজের তথ্য দেখব।
No comments:
Post a Comment