রণবীর চক্রবর্তী
সুন্দরবন থেকে পাওয়া শ্রীমদ্দমনপালের তাম্রশাসনে দেখতে
পাই, ১১৯৬ সালে গঙ্গার সমুদ্র মোহানায়
দ্বারহটক নামে একটি স্থান ছিল। এটি একটি ছোট নদী বাজার কেন্দ্র(হট্টক) ছিল যা আদতে
সমুদ্রের মুখ(আদ্বার) ছিল। রাঢ়ের দক্ষিণে
বঙ্গ-সমতটে হয়ত তাম্রলিপ্ত বা সমন্দরের থেকে কম বিখ্যাত, কিন্তু উপকূলবর্তী
অঞ্চলের সঙ্গে নদীমাতৃক বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ কেন্দ্র ছিল। গঙ্গা ও
ভাগীরথীর সঙ্গে নানান নদীর নাব্যতা এবং তাতে চলাচল
করা নানান নৌকো জাহাজের উদাহরণ আমরা বিভিন্ন লেখায়
পাচ্ছি।
বঙ্গের ভেতরে নানান এলাকায় প্রচুর হাট(হট্ট বা হট্টিকা)
ছিলই যেগুলির উল্লেখ আমরা পাচ্ছি অষ্টম শতাব্দের পরে নানান ধরণের শিলালেখ বা তাম্রশাসনে। হট্ট
আজকের লব্জে হাট। এগুলি সপ্তাহে একবার বা দুবার বসত। সে সময় বাংলায় যে ব্যবসা
ত্রিভূজ ছিল, তার ভূমিতটের ভিত্তি ছিল হাট। তবে হট্টভর কিন্তু সাধারণ হাটের তুলনায়
একটি বড় এলাকা। দেবপালদেভট্ট নালন্দার কাছের একটি হাট, এবং যেহেতু রাজার নামে এই
হাটটির নাম হয়েছে, সেহেতু আন্দাজ করা যায় সাধারণ হাটের তুলনায় এর আকার অনেক বেশি
ছিল।
মাঝেমধ্যে দোকানের(আপণ) নাম উল্লিখিত হয়েছে যেমন ধর্মপালের
খালিমপুর তাম্রশাসনে। সেন রাজত্বের শেষ দিকে যে তাম্রশাসন পাওয়া যায় তাতে চতুরক নাম
পাচ্ছি, তবে তা দ্বাদশ শতের আগে নয়। আমাদের ধারনা চতুরক নাম হল চার রাস্তার
সংযোগস্থল, হয়ত আন্তঃরাজ্য ব্যবসায় নিযুক্ত বিভিন্ন বিভিন্ন পাইকারের মিলনস্থল। এ
ধরনের একটির নাম বেতড্ডচতুরতক যার পূর্বে গঙ্গা(পূর্বি জাহ্নবীসীমা) আজকের হাওড়ার
বেতোড় হসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ফলে আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে বড় হট্ট বা
চতুরকগুলি সে সময়ের কোন বড় ব্যবসাকেন্দ্র বা কোন বন্দরের পশ্চাদভূমির যোগাযোগ
মাধ্যম ছিল। উত্তরপথে বা দাক্ষিণাত্যে এই ধরণের মাঝের ব্যবসাকেন্দ্রগুলির নাম ছিল
মণ্ডপিকা বা আজকের বাজারের
প্রতিশব্দ মাণ্ডি, পেঠনা আজকের পেঠ
বা নগরম।
এই বাজার এবং বন্দরগুলিতে বিভিন্ন শ্রেষ্ঠীর অবস্থান ছিল, তারা এই বন্দরগুলিকেই
ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে পছন্দ করতেন। চন্দ্রকেতুগড় বা অন্যান্য প্রত্নস্থলে বিভিন্ন
পোড়ামাটির সিলে ধানের শিসের ছাপ পাওয়া গিয়েছে, অর্থাৎ এই অঞ্চলের ব্যাপারীরা ধান
নিয়ে ব্যবসা করত। সংস্কৃত শব্দ বণিক বা
বৈদেহক শব্দে সাধারণত সব ধরণের পণ্য নিয়ে ব্যবসা করা ব্যবসায়ী বোঝাত। বহু জাতকের
গল্পে সার্থবাহ(বণিকদের নেতা) বণিকদের দূর দেশে যাত্রা করার গল্প বর্ণিত আছে (পুব্বন্তঅপরান্ত)
যেমন পুষ্কলাবতী থেকে(পাকিস্তানের চারসাদ্দা) তাম্রলিপ্তিতে আসা। ৪৪৪-৫৪৪ সালে প্রাপ্ত পাঁচটি দামোদরপুর
তাম্রশাসনে বলা হয়েছে কোটিবর্ষের সার্থবাহ বণিক এবং নগরশ্রেষ্ঠীদের কথা।
নগরশ্রেষ্ঠী অর্থে ধনী ব্যবসায়ী। প্রাচীন সাহিত্যে তাদের অত্যন্ত ধনী এবং
বিনিয়োগকারী রূপে বর্ণিত করা হয়েছে, যারা তাদের বিপুল অর্জিত অর্থ বিভিন্ন
ব্যবসায়িক কাজে বিনিয়োজিত করেন। এটাও বলা দরকার সার্থবাহ এবং নগরশ্রেষ্ঠী কিন্তু
অন্তত এক শতাব্দ স্থানীয় জেলা প্রশাসনের(বিষয়ধিষ্ঠানঅধিকরণ) দপ্তরের অংশ ছিলেন,
যদিও তারা কোনভাবেই স্থানীয় প্রশাসক ছিলেন না। একটা বিষয় পরিষ্কার যে সার্থবাহ আর
নগরশ্রেষ্ঠী দু ধরণের পেশাজীবি তাদের সমাজের প্রতিনিধি ছিলেন এবং সামগ্রিক সমাজে
বিপুল সম্মান লাভ করতেন। খুব বেশি লেখতেই ব্যক্তিগত ব্যপারীদের নাম উল্লিখিত হয় নি,
শুধু একবার জনৈক ভদ্রসার্থ, জম্ভলমিত্র দশম শতের শেষ পাদে সমতটে গণেশ দান করার উল্লেখ
ছাড়া।
ভদ্রসার্থ শব্দটা হয়ত এসেছে পুরনো ক্যারাভান
ব্যবসায়ীদের নাম থেকে। অথবা প্রাচীন তামিল লেখতে উল্লিখিত ভদ্দুয়াবাহারি বা প্রবীন
ক্যারাভান ব্যবসায়ী হিসেবে। অষ্টদশ থেকে ১৩০০ সাল পর্যন্ত, বিভিন্ন সাহিত্যে ব্যসায়ীদের
উল্লেখ কমে যাওয়ায় বহু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই সময় বাংলার ব্যবসায়ে ভাটার টান
এসেছিল। বাংলায় সামন্ততন্ত্রের শেকড় গাড়ার ফলে ব্যবসার অবনতি ঘটা, এই তত্ত্ব বহু
ঐতিহাসিক খারিজ করেছেন নানান সূত্রে।
No comments:
Post a Comment