অষ্টাদশ শতকের
প্রথম দিকে গোটা মুঘল সাম্রাজ্য জুড়ে পতনের, ক্ষয়, অব্যবস্থা এবং অস্থিরতার
পরিবেশের মধ্যে বাংলার নবাবি প্রশাসন একমাত্র ব্যতিক্রমিক ভৌগোলিক এলাকা।
শুধুমাত্র করদ-রাজ্য হিসেবে বাংলার দিল্লির সঙ্গে একটা প্রায়-ছিঁড়ে যাওয়ার মত
সূক্ষ্ম সুতোয় বাঁধা থাকা হলেও বাস্তবিকভাবে দিল্লির নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত বাংলার
নবাবেরা বাংলাকে স্বাধীন ভৌগোলিক এলাকায় পরিণত করে। নবাবের ব্যক্তিগত কৃপাদৃষ্টির
পথে পড়ে শুধু কিছু জমিদার, ব্যাঙ্কার এবং অভিজাত সামরিক ব্যবসায়ীরা ক্ষমতার
কাছাকাছি এসে একটা যৌথ জোটবন্ধন তৈরি করে। এটা কোনভাবেই শ্রেণীবদ্ধতা(class alliance) নয়, বরং সময়ের প্রয়োজনে জোটের সঙ্গে জড়িয়ে
থাকা মানুষদের ব্যক্তিগতস্তরের স্বার্থ রক্ষা। এই অবস্থা বাংলাদেশে একটি স্থায়ী
রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং একটি জোরালো নিজামতের ভিত্তি তৈরি হয়। এর ফলে
আর্থিক ব্যবস্থায়, উৎপাদনে এবং লাভের পরিবেশ তৈরিতে নতুন উদ্যম গৃহীত হয়, ব্যবসা
বাণিজ্য বৃদ্ধি আর বাজারের বিস্তার ঘটে। বাংলায় অষ্টাদশ শতকের প্রথম পাদে ব্যবসার
সমৃদ্ধি এবং শান্তি শৃঙ্খলার স্থায়িত্ব এশিয়া এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বণিককে
টেনে আনে।
ইওরোপিয়দের
মধ্যে ডাচ আর ব্রিটিশ ইওরোপিয় কোম্পানি বাংলার ব্যবসা জগতে বেশ সক্রিয় ছিল। একসময়
কোম্পানিগুলো ইওরোপ আর মশলাদ্বীপপুঞ্জের মধ্যে যে দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা শুরু করেছিল,
সেটি বদলে গেল ত্রিপাক্ষিকতায় এই ব্যবসায় ভারত নামক একটি ভূখণ্ড তার দেশের নানান
এলাকায় প্রস্তুত নানান ধরণের শস্তা উৎপাদন নিয়ে ঢুকে পড়ায় – যে ভূখণ্ডের বস্ত্র
নিয়ে ইওরোপিয় কোম্পানিগুলি মশলা কিনে ইওরোপে চালান দিত। পরের দিকে এটি ইওরোপ এবং
বাংলার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ব্যবসায় রূপান্তরিত হয়, যেখানে ১৬৮০র পর থেকে বাংলা এই
কোমপানিগুলির এশিয় ব্যবসার অক্ষদণ্ড এবং উত্তমর্ণ রূপে উঠে আসে অষ্টাদশ শতকের
প্রথম পাদ পর্যন্ত। অষ্টাদশ শতকে ডাচেরা যদিও বাংলার মোট ব্যবসায় ইওরোপিয়
কোম্পানিগুলির থেকে অনেকটা এগিয়েছিল, ১৭৩০ এবং ১৭৪০এ ব্রিটিশেরা এশিয় ব্যবসায়
তাদের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে থাকে, মনে রাখতে হবে বাংলার ঘাঁটি ডাচ ব্যবসা
পরিকল্পনায় আন্তঃএশিয় খুব বড় ভূমিকা পালন করেছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ যে বাংলায়
ব্যবসা করতে গেলে দামি ধাতু বয়ে নিয়ে আসতে হত। ইওরোপিয় কোম্পানিগুলি বাংলার পণ্য
কিনতে যে সব পণ্য আমদানি করত তার মধ্যে ৭৪ থেকে ৯৪ শতাংশ পণ্যই ছিল দামি ধাতু।
এই উদ্বৃত্ত
ব্যবসাটা বাংলার সব থেকে বড় জোর ছিল। এবং এই জন্য বাংলার দখল ইওরোপিয়দের কাছে
লাভজনক ব্যবসা হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে। বহুকাল ধরে একটা ধারণা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা
হয়েছে পলাশীপূর্ব বাংলার রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থার জন্যে বাংলা দখলে ব্রিটিশেরা
নাক গলাতে পেরতেছিল। কিন্তু এই তত্ত্ব মেনে নেওয়া যায় না। এটাও বলার চেষ্টা হয়েছে
সাম্প্রতিক বেশ কিছু গবেষণায়, পলাশীর অব্যবহিত পূর্বে নতুন নবাব সিরাজের নানান
কাজে বাংলার অভিজাতদের শ্রেণীদের যুথবদ্ধ শ্রেণীগোষ্ঠীস্বার্থে আঘাত লাগে ফলে তারা
ব্রিটিশদের সাহায্যে প্রত্যাঘাত করে। বলা দরকার অখণ্ড শ্রেণী স্বার্থ বলে কোনদিন
বাংলায় কিছু ছিল না, সে অখণ্ড মঞ্চও বাংলায় গড়ে ওঠেনি, যাছিল তা হল ক্ষমতায় থাকা
সর্বোচ্চ মানুষটির প্রতি একজন বা কয়েকজনের ব্যক্তিস্বার্থপূরণের প্রতিযোগিতা। মধ্যঅষ্টাদশ
শতকে রাজনৈতিক পটভূমিতে কোন কিছুই ঘটা অস্বাভাবিক ছিল না। মুর্শিদকুলিখাঁর মৃত্যুর
পরে প্রত্যেকটি সিংহাসন আরোহনের প্রশ্নে দেশের ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা অভিজাতরা
বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ত, এই ঘটনাটা পলাশীর সময়েও ঘটেছিল। পলাশীতে
ব্রিটিশদের পাশে নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠী সিরাজের ক্ষমতা আরোহনের বিরোধিতা
করে। আবার অন্যদিকে বহু জমিদার, ব্যবসায়ী এবং সামরিক অভিজাত সিরাজেরপাশে ছিল।
মুর্শিদকুলির মৃত্যুর (১৭২৮/২৯) সময়েও একই বয়ান ছিল আবার সিরাজের সিংহাসনে ওঠার
সময়েও একই বয়ান লক্ষ্য করা যায়। ফলে পলাশীকে কোনভাবেই বাংলার অভ্যন্তরীণ গোলযোগের
কারণ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া যাবে না।
No comments:
Post a Comment