একটি ভাঙা মাটির পাত্রের এক পাত্রে কাঠকয়লা, একপাত্রে আকরিক নির্দিষ্ট
মাত্রায় মিশিয়ে চুল্লির ভেতরে ফেলা শুরু হয়। হাওয়া দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানিও
ক্রমাগত যোগান দেওয়া হতে থাকে। আকরিক মোটামুটি গুলির আকারের কৃস্টালাইন
ফ্রাকচারওয়ালা শুদ্ধ হেমাটাইট। এই গুলিআকৃতির লোহাকে বাড়ির বয়স্কা মেয়েরা গুঁড়ো
করে চুল্লিতে দেওয়ার উপযোগী করে তলে। টুয়ারের হাওয়া থেকে কার্বন মনোক্সাইড পুড়ে
নীল শিখা হয় এবং চুল্লির মুখে সাদা আগুন জ্বলে। টুয়ারের গায়ে লেগেথাকা ভিজে
বালুমাটিতে একটি রোগা লাঠি খোঁচানো হয় ঘন্টা দেড়েক পর। টুইয়ারের একটি মুখ দিয়ে
কিছু গলিত বর্জ্য পদার্থ বেরিয়ে আসে।
প্রত্যেক আধ ঘণ্টা অন্তর অন্তর এই ভাবে খুঁচিয়ে বর্জ্য বার করা হতে থাকে।
এগুলো স্বচ্ছ, কালো, ঠাণ্ডা হওয়ার পর অনেক খণ্ডে ভাগ করা হয়। যতক্ষণ না শেষ
কাঠকয়লাটি পুড়ে যাচ্ছে ততখন চুল্লিতে হাওয়া দেওয়া হয়। মোটামুটি ১ মন চারকোলে ২০
সের লোহা আকরিক মেশানো হয়। এইটি প্রক্রিয়াটি মোটামুটি তিন থেকে চারঘন্টা চলে।
এবারে টুইয়ার খোলা হয়, বালি সরানো হয়, ইত্যাদি গোটানোর ঘটনা ঘটতে থাকে। চারকোল
চুল্লি থেকে বার করা হয়, ঠাণ্ডা করা হয়। এর ভেতর থেকে কাঠের হাতলের লোহার চিমটে
দিয়ে লোহার মণ্ড টেনে বার করা হয়। এরপরে এটিকে ঘাসে রেখে হালকা হালকা হাতে পিটিয়ে
বাকি বর্জ্যও বের করে দেওয়া হয়। খুব বেশি যাতে পেটানো না হয় তার দিকে নজর রাখা হয়,
কেননা লোহা ওজনেই বিক্রি হয়। এই পদ্ধতিতে ৬/৭ সের লোহা পাওয়া যায়। এই কাঁচা লোহা
টাকায় ২০ থেকে ২৫ সের পাওয়া যায়।
জিওলজি ইন ইন্ডিয়ার তৃতীয় খণ্ডের ৩৪০ পাতায় বেল বলছেন বীরভূমের বড় ফারনেসে
যে পিগ লোহা তৈরি হয় তা পরে ইস্পাতে পরিণত করা হয়। তবে এই তথ্য বিভ্রান্তিকর।
কেননা এখনও পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে বীরভুমে ইস্পাত তৈরির কোনও বর্ননা
নেই। কিন্তু আমি নিশ্চিত এখানে এক সময় ইস্পাত তৈরি হত। ১৫০০ সাল থেকে বাংলার নানান
কাজে যে বিশাল পরিমাণ অস্ত্র প্রয়োজন হয়েছে তার সবই আমদানি করা হয়েছে, এই তথ্য আমি
বিশ্বাস করি না। ঐ পত্রিকারই নবম সংখ্যায় ম্যালে দার্জিলং জেলার, কালিম্পঙের ৫
মাইল দক্ষিণ পুর্বের শিখবার গ্রামের কথা লিখছেন, এই অঞ্চলে যে ধরণের নরম লোহা তৈরি
হত তা খুকরি এবং বান তৈরির জন্য যথেষ্ট। তবে তার পরিমাণ কিন্তু যথেষ্ট কম। এক সময়
যে সাঁওতাল পরগনায় ইস্পাত তৈরি হত তার কথাও সমীক্ষায় উল্লিখিত হচ্ছে, এখন আর বুলেট
আটকে দেওয়া সাঁওতালি ইস্পাত তৈরি হয় না।
রাজমহল পাহাড় আর সাঁওতাল পরনায় লোহা তৈরি করেন এখনও কোল সমাজ। ছোটনাগপুরেও
কিছু কোল লোহা তৈরি করেন। এরা অনেকটা সাওতালদের সঙ্গে যুক্ত। কেউ কেউ বলেন মুণ্ডা,
হো, ভুমিজ কোল অথবা সাঁওতাল প্রায় একই সমাজ বললেও অত্যুক্তি হবে না। সাঁওতালরা এখন
আর লোহা তৈরি করেন না এবং তারা লোহা তৈরি করা কোলেদের নিচু চোখে দেখে। ১৮০৭এ
ফ্রান্সিস বুকানন এদের নিরুপদ্রব সমাজ বলছেন। তারা শুধুই লোহা তৈরির জন্য কোলদের
নিচু নজরে দেখে না সম্প্রদায়গতভাবেই এই বিষয়টি ঘটে তা বলা যাবে না।
তবে ছোটনাগপুর এলাকায়
মূল লোহা প্রযুক্তিবিদেরা হলেন আগারিয়া সমাজ। লোহারিরা হিন্দু সমাজে খুবই নিচু
স্তরে বাস করে। ওল্ডহ্যাম বলছেন বীরভূমে দুই ধরণের সমাজ লোহাকাম করতেন। এরা দু
ধর্মের মানুষ। একটি মুসলমান, অন্যটি হিন্দু।
No comments:
Post a Comment